Alapon

~জান্নাতাবাদ নাকি নিয়ামত-পুর-ই দোযখ?!

বাংলার পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে প্রাচীনকাল থেকে একধরনের বিতর্ক ও ভুল ধারণা চলেই আসছে। অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে, নানা মুনির নানা মত। ইবনে বতুতার মতে, খোরাসানের অধিবাসীরা বাংলাকে দুজুখ-ই-পুর-নিয়ামাত বা সমস্ত ভালো জিনিসের নরক বলে অভিহিত করে। সম্রাট হুমায়ুন কয়েকমাস বাংলার গৌড় শহরে অবস্থান করে এর স্নিগ্ধ জলবায়ু ও মধুর পরিবেশে এতবেশি মুগ্ধ হন যে তিনি এর নামকরণ করেন জান্নাতাবাদ। আবার প্রথম যুগের মুসলমান ঐতিহাসিকগণও বাংলাকে প্লেগ, ম্যালেরিয়া, ও অন্যান্য রোগের জন্মভূমি রুপে চিত্রিত করেছেন।

উত্তর ভারতের অধীবাসীরা বাংলার জলবায়ু ও বৃষ্টিপাত ভীতির চোখে দেখত এবং তারা সাধারণত বাংলাতে চাকুরি করা এড়িয়ে চলতো। গৌড় দখল করার পর হুমায়ুন জাহিদ বেগকে বাংলার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। সমৃদ্ধশালী প্রদেশের এরকম একটি উচ্চপদে নিযুক্তির জন্যে সম্রাটের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে জাহিদ বেগ মন্তব্য করেন, "জাঁহাপনা (সম্রাট হুমায়ুন) কি আমাকে মারার জন্য বাংলা অপেক্ষা উত্তম জায়গা খুঁজে পান নি। এমনকি, সম্রাট আকবরের প্রথম দিকে মোগল সেনারা বাংলায় কাজ করতে পছন্দ করত না, যদিও তাদেরকে দ্বিগুণ বেতন প্রদান করা হয়েছিল। অস্বাস্থ্যকর জলবায়ুর কারণে, গৌড় ও পান্ডুয়ার জাঁকজমকপূর্ণ শহরগুলো পর্যন্ত মোগল রাজ প্রতিনিধি এবং রাজ কর্মচারীগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছিল। আসলে এটা বিষ্ময়কর বটে!! বাংলার জলবায়ু কি যুগে যুগে এমনই রুক্ষ ও অসহনশীল ছিল!? কেন ইবনে বতুতার দুজুখ-ই-পুর-নিয়ামাত হুমায়ুনের কাছে এসে শুধু জান্নাতাবাদ হয়ে গেল? বা প্রথমদিকে বাংলায় আসার ক্ষেত্রে মোগল সৈন্যদের এত অনীহা দেখালেও পরবর্তীতে সেটা কিভাবে স্বাভাবিক হয়ে উঠলো? আবার অনেকেই যুক্তি পেশ করেন, এই রুক্ষ আবহাওয়ার কারণে বাংলায় দূরবর্তী অঞ্চল থেকে এতটা বেশি লোক আসার সম্ভব হয়ে ওঠে নি। ফলে, বাংলার মুসলমান বৃদ্ধির অন্যতম কারণ ছিল, নিম্ন জাতের হিন্দুদের বংশধর। বাহিরের লোকদের ক্ষেত্রে আবহওয়ার রুক্ষতা ছিল সত্যিই প্রবল।

এখন আমরা সংক্ষেপে আলোচনা করে দেখবো বাংলার আবহাওয়ার ব্যপারে এই বক্তব্য কতটুকু গ্রহণযোগ্য ছিল। আর আবহওয়া যদি রুক্ষও হয়ে থাকে, আসলে যেমনটা বলা হয়ে থাকে তেমন ছিল কিনা? নাকি এটা নিয়ে একধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করা হয়েছে আমাদের জন্য?

উপরিউক্ত বক্তব্যগুলো যাচাই করলে দেখা যায় ঐসকল ঐতিহাসিক, রাজকর্মচারী কিংবা আধুনিক কালের বুর্জুয়া আধিপত্যশীল ব্যক্তিরা তাদের লেখায় এই প্রদেশের জলবায়ু সম্বন্ধে উত্তর ভারতীয় অধিবাসীদের অনুমানমূলক ধারণা প্রকাশ করেছেন। তবে এটা সত্য যে, নদী সরে যাওয়ার ফলে এবং জলাভূমি ও বিল ঝিল গুলোর অস্তিত্বের কারণে গৌড় ও পান্ডুয়ার মত কয়েকটি স্থানের জলবায়ু অস্বাস্থ্যকর হয়ে গিয়েছিল। ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে খান খানান মুনিম খানের সুবিদারীর সময়ে গৌড়ে ব্যাপকারে প্লেগ রোগ দেখা দেয়। এই মহামারীকে বহুসংখ্যক মোগল সেনাপতি, রাজকর্মচারী ও সৈনিকের মৃত্যু হয় এবং সুবাদার গৌড় থেকে তান্ডায় প্রদেশের রাজধানী স্থানান্তর করতে বাধ্য হন। কিন্তু সমগ্র প্রদেশের জলবায়ু অস্বাস্থ্যকর ছিল এরুপ উক্তি সত্য নয়। এমনকি গৌড়ের জলবায়ুও এতটা অস্বাস্থ্যকর ছিল না, যতটা উত্তর ভারতের সমসাময়িকদের মাঝে প্রকাশ পেয়েছে। তাদের বর্ণনা মত জলবায়ু যদি এতই খারাপ ছিল তাহলে কিভাবে বহু শতাব্দীকাল গৌড় বাংলার রাজধানী ও একটি সমৃদ্ধশালী শহর রুপে এর অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল? সম্রাট হুমায়ুন কয়েকমাস এই সুন্দর শহরে অবস্থান করেন এর স্নিগ্ধ জলবায়ু ও মধুর পরিবেশে এতবেশি মুগ্ধ হন যে তিনি এর নামকরণ করেন জান্নাতাবাদ। সুলতান বলবনের পুত্র নাসিরুদ্দিন বুগরাখান বাংলায় বিশুদ্ধ জলবায়ু ও সবুজ বৃক্ষরাজির সমারোহ এত ভালোবাসতেন যে তিনি দিল্লির সুলতানত অপেক্ষা এই প্রদেশের শাসনকর্তা হয়ে থাকাকে অধিক পছন্দ করেন।

আবুল ফজলের বর্ণণায় প্রকাশ পায় যে, বাংলার জলবায়ু যতটা অস্বাস্থ্যকর বলে চিত্রিত করা হয়েছে, বাস্তবিকপক্ষে তা ততটা খারাপ ছিল না : বৃষ্টিপাতের শেষে মহামারীর উৎপাদক জলবায়ুর কথা বলতে গিয়ে এই মোগল ঐতিহাসিক আরো জানিয়েছেন যে, "বর্তমান শন শাহের (সম্রাটের) আমলে এই অশুভ আবহাওয়ার অবসান হয়েছে। এটা অবশ্য সুনিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, কয়েকবছরের মধ্যে এই প্রদেশের জলবায়ু উন্নত করার জন্য সম্রাট আকবের নিকট কোন ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতা ছিল না। নদনদী, বৃষ্টিপাত ও জলাভূমিসমূহ তখনও একইরকম ছিল৷ তাহলে কিভাবে এই অসাধারণ শুভ পরিণতি ঘটে?

বাংলাদেশের জলবায়ুতে এই বিপ্লব ছিল আসলে বাংলার আবহাওয়া সম্বন্ধে উত্তরাঞ্চলীয় সমসাময়িকদের ধারনার পরিবর্তন মাত্র। কার্যত প্রদেশের দূর্যোগপূর্ণ জলবায়ুর অস্তিত্ব বাস্তব অপেক্ষা বেশি ছিল মনস্তাত্ত্বিক ; বাংলাদেশের বৃষ্টিপাত ও জলকাদা সম্পর্কে উত্তরাঞ্চলীয় ভীতি থেকে এর জন্ম হয়েছিল। বংশানুক্রমে তারা শুষ্ক আবহাওয়ায় বসবাস করতে অভ্যস্ত ছিল, ফলে স্বভাবতই এই প্রদেশের রুষ্ট ও আদ্র জলবায়ুরতে বসবাস করা তাদের পক্ষে ভীতিজনক ছিল। সুতরাং তারা বাংলা সম্বন্ধে পূর্ব থেকে এক মনগড়া ধারণা পোষন করতো। এবং সেখানে চাকরিও অবস্থান করতে অনিচ্ছা পোষণ করতো। সম্রাট আকবরের সময় তাদেরকে অবশ্য সেখানে চাকরি করা হত। তারা কয়েকবছরকাল বাংলাদেশে অবস্থান করার পর উপলব্ধি করতো যে, জলবায়ু সম্বন্ধে তারা যতটা ভেবেছিল তা ততটা খারাপ নয়৷ অপরদিকে, এই প্রদেশে তাদের বহু সুযোগ সুবিধা ছিল। এভাবে বাংলার জলবায়ু বায়ু ভীতি উত্তর ভারতীয় অধিবাসীদের মন থেকে দূর হয় এরফলে সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে এ সম্পর্কে তাদের ধারনার উন্নতি দেখা যায়।

বাবর হিন্দুস্তান পছন্দ করেন নাই কিন্তু মধ্যএশিয়ার পার্বত্য অঞ্চলের অভাব অনুভব করতেন। হিন্দুস্তানে বসবাসকারী তার বংশধরেরা এতবেশী এদেশীয় হয়ে পড়েছিলেন যে, এমনকি তারা সামান্য সময়ের জন্যেও তাদের পূর্বপুরুষদের আবাসভূমিতে অবস্থান করা পছন্দ করেন নাই। একইভাবে বাংলাদেশেও উত্তর ভারতের লোকেরা যখন একবার বসবাস করতে শুরু করে তখন তারাও এখানকার জলবায়ুতে অভ্যস্ত হয়ে এদেশীয় হয়ে ওঠে। জলবায়ু খারাপ থাকলে এবং মহামারী ব্যাধি ইত্যাদিতে সব লোকের মৃত্যু হলে বাংলা ও উপমহাদেশের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় পরিণত হতে পারতো না।

এটাও উল্লেখযোগ্য যে, উত্তর ভরতের মুসলমান ঐতিহাসিকগণ ব্যতিরেকে অন্যকোন সমসাময়িক লেখক বাংলার জলবায়ু খারাপ বলে উল্লেখ করে নাই। একদল ইউরোপীয় বণিক ও চীনদেশীয় দূত বাংলা পরিভ্রমণ করে এর সম্পর্কে চমকপ্রদ বর্ণণা রেখে গেছেন। তাদের বর্ণণায় এদেশের প্রকৃতি ও অধিবাসী এবং এর সামাজিক অর্থনেতিক জীবন প্রতিফালিত হয়েছে। তারা কিছুকালের জন্য এখানে বসবাস করেছিলেন এবং এর জলবায়ু সম্পর্কে তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছিল। অথচ, মুসলমান সমসাময়িকদের বাংলার সঙ্গে কোনরকম সংস্রব ছিল না। ইবনে বতুতা কয়েকমাস এই প্রদেশে ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি কেবল উত্তরাঞ্চলীয় অধিবাসীদের ধারণার পুনরাবৃত্তি করে বলেন যে, বাংলা সবরকম ভালো জিনিসের নরক ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় তিনি দেখতে পেয়েছেন যে, বাংলা বসবাস করার জন্য উত্তম জায়গা।

মীর্জা নাথান বহু বছর বাংলাদেশে কাটান এবং এর জলবায়ু সম্পর্কে তার প্রত্যক্ষ ও ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল। অথচ তিনি এখানকার জলবায়ু সম্পর্কে কোন অভিযোগ করেন নি। দিল্লি ইতিহাস লেখকদের বক্তব্য পরীক্ষা নিরিক্ষা ব্যাতিরেকে গ্রামের করা যায় না।

অতএব এটা প্রতীয়মান হয় যে, জলবায়ু ততটা খারাপ ছিল না যতটা সেযুগে অনুমান করা হয়েছিল। বাংলার এমন একটি জলবায়ু ছিল যা নদনদী বৃষ্টিপাত ও জলবেষ্টিত একটি দেশের পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। এদেশের জলবায়ু শুধু তাদের নিকটই অদ্ভুত মনে হত, যারা এধরণের প্রাকৃতিক পরিবেশের সহিত সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল।(পৃষ্ঠা-২১ও২৪) সুতরাং বাংলার জলবায়ু রুক্ষ ও অসহিষ্ণু বলে উত্তর ভারতের লোকদের পূর্বানুমান থাকলেও সেটা পুরোপুরি সত্য ছিল না!!তাই, বাংলা যতটুকুনা ছিল নিয়ামত পুর-ই দোজখ তারচেয়ে বেশি ছিল হুমায়ুনের জান্নাতবাদ।

[বিঃদ্রঃ লেখাটি এম এ রহিমের বাংলার সামাজিক ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে লেখা।]

~জান্নাতাবাদ নাকি নিয়ামত-পুর-ই দোযখ?!~
-কামরুজ্জামান-
-২০|১২|২০২০-

পঠিত : ৫৭১ বার

মন্তব্য: ০