Alapon

আমরা মানুষ কতই না অসহায়, কিন্তু তারপরও দম্ভ করি!



বছর দুয়েক আগের কথা। এক সন্ধ্যাবেলা বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য প্রিয় লেখকের সাথে দেখা করা। সঙ্গত কারণেই আমি সেই লেখকের নাম উল্লেখ করছি না। তার লেখা অধিকাংশ বই-ই আমি পড়েছি, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়েছি। তার লেখায় যেন জাদু আছে।

একদিন ঘটনাপ্রসঙ্গে সেই লেখকের সাথে ফেসবুকে কথা হল। তিনি আচমকা দাওয়াত করে বসলেন। বললেন, ‘সময় থাকলে আগামীকাল আসুন। কথা বলি, আড্ডা দেই।’

দাওয়াত কবুল করলাম এবং পরেরদিন তার সাথে দেখা করলাম। প্রথম দেখাতেই তিনি আমাকে আপন করে নিলেন। আপনের মাত্রাটা হয়তো খানিকটা বেশিই ছিল। এই তিনি একবার আপনি করে বলেন, এই তুমি আবার কখনো তুই করে বলেন। তার এই উল্টাপাল্টা সম্বোধন আমার বেশ মজা লাগল।

তার লেখক হয়ে ওঠার গল্প করতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘আমি আজ লেখক হতে পারতাম না, যদি না আব্দুল মান্নান তালিব সাহেবের সোহবত পেতাম। আব্দুল মান্নান তালিব আমাকে হাতে ধরে লেখা শিখিয়েছেন। এমন বহুবার হয়েছে, কিছু একটা লিখে তালিব ভাইয়ের কাছে নিয়ে গেছি, আর তালিব ভাই এক টানে কেটে দিয়ে বলেছেন, ‘কিচ্ছু হয়নি! আবার লিখেন।’ তাঁর এই কেটে দেওয়াটা আমাকে আরও জেদি করে তুলতো, আর সেই জেদের বসেই হয়তো আজ আমি লেখক হতে পেরেছি।’

সেদিনের মত আড্ডা শেষ হল। কিন্তু কথা দিতে হল, আগামী সপ্তাহে আবার তার সাথে দেখা করতে যাবো।

পরের সপ্তাহে দেখা করতে গেলাম। আড্ডার এক ফাঁকে তাকে বললাম, ‘আব্দুল মান্নান তালিব সাহেবের স্ত্রী তো অসুস্থ। ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি আছেন। দেখতে যাবেন না?’
জবাবে তিনি বললেন, ‘নাহ, যাবো না। কারণ, আমি ব্যক্তির পূজা করি না, ব্যক্তির গুনের পূজা করি।’
তার এই কথার জবাবে বললাম, ‘আপনার এই কথার মানে বোঝাটা খুব কঠিন কিছু নয়। আপনি দায়িত্ব এড়াতে চাচ্ছেন, অথবা ভাবছেন, দেখা করতে গেলে আবার সাহায্য সহযোগিতা করতে হয় কিনা! এই ভয়েই আপনি বলছেন, ‘আমি ব্যক্তির পূজা করি না, ব্যক্তির গুনের পূজা করি।’ আর এই কথার মানে দ্বারা বোঝায়, আপনি অকৃতজ্ঞ। যে মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ হতে পারে না, সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞ নয়।’

তিনি তখন অট্টহাসি দিয়ে বললেন, ‘তোর বয়স কম, তাই আবেগ বেশি।’

তার এই কথার জবাবে বললাম, ‘আমি কিন্তু আপনার লেখার ভক্ত, আপনার না। আল্লাহ না করুন, আগামী সপ্তাহেই যদি আপনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে দেখতে আসা আমার উচিত হবে না। কারণ, আমি তো আপনার লেখার ভক্ত, আপনার না।’

উনি তখন রাগান্বিত হয়ে বললেন, ‘আসিস না! তুই না আসলে আমার মনে হয় ভারি বয়ে যাবে।’

এই সাক্ষাতের ঠিক ৩ মাস পর খবর পেলাম, সেই লেখক অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। সংবাদটা শোনা মাত্রই মনটা খারাপ হয়ে গেল। আর ঠিক তখনই তার সাথে আমার কথোপকথন মনে পড়ে গেল। কিন্তু সংবাদ পাওয়ার পরের দিনই আমি তাকে দেখতে গেলাম। তিনি যখন আমাকে দেখলেন, তখন আমার হাতটা চেপে ধরে কেঁদে ফেললেন। আর তাঁর এই অসহায় অবস্থা দেখে বার বার আফসোস হচ্ছিল, ইশ! সেদিন ওই কথাগুলো কেন যে বলেছিলাম। আমি তো চাইনি তিনি এভাবে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকুন।

তাকে দেখে বাসায় ফেরার সময় তারকাপূর্ণ আকাশের পানে চেয়ে ভাবছিলাম, আমরা মানুষ কতই না অসহায়! অথচ তারপরও আমরা কথায় কথায় দম্ভ করি।

পঠিত : ৪৪৫ বার

মন্তব্য: ০