Alapon

সোনালী আঁশ পাটের চমকপ্রদ ব্যবহার...



পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী পাটের জন্ম হয় বাংলাদেশে। পাট নাকি বড় মূল্যবান অর্থকড়ি সম্পদ এবং এর আশ নাকি সোনালী তন্তুর মত মর্যাদাবান! এক্কেবারে ভুল কথা, এই কথার কোন সত্যতা আমরা কোনদিন পাইনি!

পাটের চারা বাংলাদেশের সর্বত্র আগাছার মত জন্মে। "পাগলে কি না বলে আর ছাগলে কি না খায়" প্রবাদ কথাটি সবাই জানে কিন্তু ছাগলকে পাটের রসি দিয়ে বেঁধে, পাট শলাকার ঝাড়ু দিয়ে পিটালে ও ছাগল সারাদিন ম্যা ম্যা করে চিল্লাবে কিন্তু কোন অবস্থাতেই পাট পাতা খাবে না! যে পাট পাতায় ছাগলের এত অভক্তি গরীব-তোয়াঙ্গর গৃহিণী পেটের জ্বালা নিভাতে, লবণ দিয়ে এই পাট পাতা সিদ্ধ করে খায়। পাঠ দেশ ও জাতির কোন উপকারে না আসলেও, গরীবের অনেক উপকারে আসে।

ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে না পারলে গরীব-অসহায়ের একমাত্র অবলম্বন পাটের রসি। পাটের রসির ফসকা গেরোতে গলা আটকিয়ে বহু ঋণগ্রস্ত, বুদ্ধি খাটিয়ে চুপিচুপি ওপারে চলে যায়। এতে করে উল্টো ঋণের গলায় ফাঁস পড়ে যায়। সূদের কিস্তি না দেবার জন্য অনেক গৃহহীন দিন মজুর মহিলারাও শাড়ীর আচলের স্থলে পাটের মোটা দড়ির উপর নির্ভর করে থাকেন।

বাংলাদেশে দিন দিন চোরের উপদ্রব বাড়ছে। "ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়" বলে একটি প্রবাদ আছে। কোনদিন আমাদের দেশে চোর ধরা কর্মসূচি শুরু হয়ে গেলে ১৮ কোটির মধ্যে কত কোটি আটকা পড়বে, তার ইয়ত্তা নেই। এত চোরকে বেঁধে রাখা বড় দুরূহ হবে কিন্তু এত বড় মহাযজ্ঞ নিমেষে সমাধা হবে, সেই পাটের নির্মিত এক টুকরা সুতলি দিয়ে। পাটের তুচ্ছ সুতলি সেদিন সেদিন বড় কাজ দিবে। বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যাকে আবদ্ধ রাখা যাবে একটু পাট দিয়েই।

জাতীর অভাবী মানুষ শুধু পাট পাতা খায়না, আরো অনেকে খায়। এই পাট পাতার তাজা মাংস ভক্ষণ করে বেড়ে উঠে হাজারো জাতের কিট-পতঙ্গ। প্রজাপতি, শুয়ো পোকা থেকে শুরু করে বহু পতঙ্গের কদাকার শূককীটের জন্ম হয় এই পাট পাতার উপর নির্ভর করেই! দেখতে কদাকার হলেও একদিন শূককীট পাখা মেলে আকাশে উড়বে, পরিবেশকে নতুনত্ব দেবে। এ সবের পিছনে রয়েছে পাট গাছের অবদান।

বর্তমান দুনিয়ার উন্নত শিল্প কারখানাগুলোর সর্বত্রই আঁশের ব্যাপক ব্যবহার সমাদৃত। ফলে প্রচুর আঁশের যোগান না পেয়ে অনেকেই কৃত্রিম আঁশ তৈরি করে কারখানা চালায়। আর ওদিকে পাটের সারা দেহটাই তো আঁশ দিয়ে ভরা। আর আমাদের রয়েছে প্রবল দেশপ্রেম তাই তাই পাটের উপর অন্যদের নজর পড়ুক এটা তো মানা যায় না! ফলে আমরা পাটের প্রতি সম্মান দিয়ে এর আঁশকে জনজীবনে ব্যবহার করি। তাই গরু-ছাগল আটকাতে, লাকড়ির বোঝা শক্ত করে বাধতে, ধানের বস্তা বানাতে, ঠেলার গাড়ি টানতে, ঠুনির সাথে ঘরের চাল শক্ত করতে, মৃত লাশকে খাটিয়ায় বাঁধতে, পাটের দড়ি ও সুতলি ব্যবহার করে থাকি। এসব তো পাটেরই বিরাট অবদান! আমাদের দেশে দড়ি ও সুতলির কি ব্যবহার এটা লিখতে গেলে কয়েকটা প্রবন্ধ বানিয়েও লেখা শেষ করা যাবে না।

পশ্চিমা দেশে নাকি নরম কাঠকে গুড়ি করে, কৃত্রিম কাইয়ের সাথে যোগ করে উন্নত মানের হালকা পাতলা কিন্তু মজবুত তক্তা বানানো যায়। এটা দিয়ে গৃহ সামগ্রী ও ফার্নিচার বানায়। পাটখড়ি একাজের জন্য উত্তম উপাদান কিন্তু আমাদের দেশপ্রেম আমাদের গর্বিত করে রেখেছে। আমরা পাটের দেশের মানুষ, তাই পাট খড়ি দিয়ে গাছ বানানোর পিছনে মেধা লাগানোর প্রয়োজনই বা কি? তাছাড়া এই পাট খড়ি গৃহহীন মানুষের চুলার আগুনে উত্তাপ দেয়। বেশুমার পরিবার সে উত্তাপে নিজেদের রান্নার কাজ সাড়ে। পাটের এই অবদানই বা কম কিসের? দেশের বহু মানুষ শিক্ষিত হয়েছে এই পাটখড়ির আগুনে রান্না খেয়েই।

মোরা দেশপ্রেমিক উদার। উদার মানুষ শুধু দিতে জানে নিতে পারে না। কলিকাতার ও দিকের সাহেবেরা পাটের কাজ জানেনা, পাট ওদিকে তেমন একটা হয়না। আমাদের পাটের প্রতি মুখিয়ে থাকে। আমরা তাদের চাহিদা মত সরবরাহ করতে থাকি। এতে তারা ১০৮ টি পাট কলের মালিক হয়ে যায়। দলে দলে সেখানে তাদের বেকার আত্মীয় স্বজন চাকুরী করে। তারা সাহেব হিসেবে পরিচিত পায়। আমরা গৌরব ও উদারতার সাথে চাষা হিসেবে পাট সরবরাহ করতে থাকি। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হল।

সবাই তাকিয়ে দেখে ১০৮টি পাটকলের সবগুলোই তাদের ওদিকে পড়ে গেল। আমরা তো আর উদারতার হাতকে সংকোচিত করতে পারিনা! তাদের সাপ্লাই অব্যাহত রাখি। নিজেরা কিছু করতে পারলাম না তাতে কি! অন্তত প্রতিবেশীর জন্য এমন কিছু করি, যাতে করে তারা হাজার বছর উপকারের কথা মনে রাখে।

পঠিত : ৬৮৮ বার

মন্তব্য: ০