Alapon

আরাকনে কখনো রক্ত শুকায় না।

১.
রাত তখন আনুমানিক তিনটা। হঠাৎ চারদিক থেকে প্রচন্ড গুলির শব্দ ভেসে আসতে লাগল। আশেপাশের গাছ-পালা দোমড়ানো মোচড়ানো শব্দ আর বাতাসে ভেসে আসা ‘সাঁ-সাঁ’ বলে দিচ্ছে এগুলো একে-৪৭ এর গুলি। মহামূল্যবান এই জীবনটিকে কেড়ে নিতে এর একটি মাত্র গুলেই যথেষ্ট।


এতোবেশি গুলি আসতেছিল যে, ঘর থেকে বের হবার কোন সুযোগ পাচ্ছি না। এক পর্যায়ে আব্বাসহ আমরা তিনভাই ঘরের এক কোনায় নিজেদের আড়াল করে রাখলাম। একসময় বুঝতে পারলাম ওরা আমাদের বাড়িতে প্রবেশ করেছে। তারপর বাড়ির দরজা-জানালাগুলোর দিকে এতোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে লাগল। কেউ একজন ঘরের জানালাটিতে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করছে। এই শব্দশুনে আমরা ভয়ে আরো জড়সড় হয়ে গেলাম। এক সময় বন্দুকের আঘাতে জানালাটি খুলেও যায়। সেই খোলা জানালার ভিতর দিয়ে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে ঘরের চারদিকে গুলি ছুড়তে লাগল। আচমকা একটি গুলি এসে আমার হাটুতে বিদ্ধ হয়। ব্যাথায় পুরো কুঁচকে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল পা-টা ছিড়ে যাচ্ছে। তিব্র যন্ত্রনায় পুরো শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছিল। ভয়ে চিৎকারও করতে পারছি না। কোনরকম নিজের হাত কামড়িয়ে যন্ত্রনা সহ্য করেছি।



যখন গুলি থেমে গেল তখন চারপাশের সবকিছুই থেমে গেল। চোখের সামনেই আমার তিন প্রতিবেশীর জীবন থেমে গেল। আহত এই আমি কে নিয়ে তিনদিন তিনরাত অতিক্রম করে আমার দুইভাই এবং আমি এই ক্যাম্পে এসে পৌঁছলাম। জানিনা আমার পায়ের কি অবস্থা হবে এবং আমাদের জীবনেরই বা কি অবস্থা হবে! (রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগত আহত শরীফুলের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা)


২.
সবাই ছুটছে। জীবন নিয়ে ছুটছে। এই ছুটন্ত মানুষগুলোর মধ্যে রয়েছেন মা রুশিদা হক এবং তাঁর পনের বছর বয়সী একমাত্র ছেলে আজিজুল হক। হিংস্র বৌদ্ধ জঙ্গি এবং মিয়ানমারের সেনাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য তারা বাংলাদেশের সীমানার দিকে ছুটছেন। পিছন থেকে ছুটে আসছে গুলি। এই ছুটন্ত গুলি গুলোর একটি এসে আজিজুল হকের পায়ে এসে আঘাত করে।


আজিজুল হক ছিটকে গিয়ে পড়ে যায়। পড়ে যাওয়ার সঙ্গে প্রচন্ড বিষ্ফোরনে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। যখন মা রুশদা হক তার ছেলে আজিজুলকে খুঁজে পেলেন, তখন তার সামনে প্রতিয়মান হল জগতের সবচে’ নিম্রম দৃশ্য! আজিজুল হকে উরু থেকে নিচের পা পর্যন্ত ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরও আজিজুল হক যন্ত্রনাকাতর চোখ নিয়ে মায়ের পানে চেয়ে রয়েছে। মমতাময়ী মা সেই আজিজুলকে যে কোন ‍উপায়ে বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়ে আসেন।


নিজের ছেলের এমন ছিন্নভিন্ন শরীর দেখে মা রুশদা হক এক সময় বলতে বাধ্য হলেন, ‘এর চেয়ে ওর মরে যাওয়া ভালো।’
হয়তো আজিজুল বাঁচবে না। ধীরে ধীরে সেও এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে। আর তার এই করুন মৃত্যুর প্রত্যক্ষ সাক্ষি জনম দুঃখী মা রুশদা হক।


এভাবেই নিত্যদিন আমাদের রোহিঙ্গা মুসলিম ভাইরা পঙ্গুত্ব বরণ করে নিচ্ছেন। এভাবেই আমাদের রোহিঙ্গা মুসলিম মায়েরা চোখের সামনে নিজের কলিজার টুকরা সন্তানের নিঃশ্বেস হয়ে যাওয়া দেখছেন। সেই মায়েরা নিজেদের করুন অবস্থার দেখেও কাঁদতে পারছেন না। হয়তো ভাগ্য বিড়ম্বনার সাথে সাথে তাঁদের চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। শুধু শুকায় না আরাকানের মাটিতে পড়ে থাকা মুসলমানদের রক্ত।


পঠিত : ৫৭০ বার

মন্তব্য: ০