Alapon

আমাদের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া



ঢাবির সিন্ডিকেটে গত ৩০ ডিসেম্বর মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে তিন প্রভাষকের নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়। এরপরেই বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। অভিযোগ উঠে, শিক্ষক নিয়োগে প্রশ্নবিদ্ধ সুপারিশই বহাল রেখেছে সিন্ডিকেট। ওই তিন শিক্ষক নিয়োগে বাছাই বোর্ডের সুপারিশ নিয়ে প্রশ্ন উঠায় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সুপারিশ রিভিউ করতে কমিটি গঠন করা হয়। ১০ মাস পর জানা যায়, সুপারিশ নিয়ে ওঠা প্রশ্নের কোনো ‘যৌক্তিকতা’ পায়নি রিভিউ কমিটি।

কী ছিল অভিযোগ?

২০২০ সালে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের দুটি স্থায়ী শূন্য প্রভাষক পদ পূরণের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এ পদে চাকরির আবেদন পড়ে ২৬টি। আবেদনকারীদের মধ্যে গত বাছাই বোর্ডের সভায় মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন ১৬ জন। তাদের মধ্য থেকে তিন জনকে নিয়োগের সুপারিশ করে বাছাই বোর্ড। বাছাই বোর্ডের প্রধান ছিলেন ঢাবির তৎকালীন সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীদের নিয়োগের সুপারিশ করেছে বাছাই বোর্ড। সেসময় নিয়োগের জন্য সুপারিশ পান মো. রাফিউল ইসলাম রাঙ্গা, এস এম তানজিল শাহ ও মো. আবু সায়েম খান। তাদের কারও কোনো গবেষণা প্রকাশনা নেই।

অথচ যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস থেকে পিএইচডি করা ড. মোরশেদা মাহবুব, যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা ড. শুভ্র প্রকাশ নন্দী, ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করা ড. জিনাত জেরিন হোসাইন ও ড. জান্নাতুল ফেরদৌস এবং ঢাবি থেকে পিএইচডি করা ড. শারমিন জামান ইমনকে বাদ দেয় বাছাই বোর্ড। এ ছাড়াও, সুপারিশপ্রাপ্ত মো. আবু সায়েম খান ও এস এম তানজিল শাহর ব্যাচের স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া নাদিরা নাজনীন রাখিকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেনি বাছাই বোর্ড।

পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ১৬ জনের মধ্যে রাখিই কেবল স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন। এমনকি ওই ব্যাচে জীববিজ্ঞান অনুষদের মধ্যেও প্রথম হন তিনি। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তার দুটি প্রকাশনাও রয়েছে।

স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া একজন ও ডক্টরেট ডিগ্রিধারী পাঁচ প্রার্থীকে বাদ দিয়ে ফলাফলে চতুর্থ ও দশম প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে সুপারিশ করে বাছাই বোর্ড। এটাই মূল অভিযোগ। গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি সিন্ডিকেট সভায় ওই সুপারিশ অনুমোদনের জন্য উঠে। তবে সুপারিশ নিয়ে অভিযোগ থাকায়, তা গ্রহণ না করে অধিকতর যাচাইয়ের জন্য একটি রিভিউ কমিটি করে দেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান।

ওই বাছাই বোর্ডের প্রধান ছিলেন ঢাবির তৎকালীন সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদ। গত জুনে দায়িত্বের মেয়াদ শেষ হলে তার স্থলাভিষিক্ত হন অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল। আগের সুপারিশ ‘অধিকতর যাচাই’ করে সর্বশেষ সিন্ডিকেট সভায় বিষয়টি উত্থাপন করেন মাকসুদ কামাল।

আমাদের দেশে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া
আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া মানে হলো ডিপার্টমেন্টে যে ফার্স্ট বা সেকেন্ড হবে সেই হবে ঐ বিভাগের শিক্ষক হওয়ার জন্য সবচেয়ে যোগ্য। এই নিয়মের ব্যাতিক্রম হলো রাজনৈতিক কোটা ও পোষ্য কোটা। এটা অবশ্যই স্বীকৃত বিষয় নয়। তবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রায়ই এরকম অভিযোগ পাওয়া যায়। তারা রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশ আছে এমন প্রার্থীকে বিনা বিবেচনায় শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করেন এবং কোনো প্রভাবশালী শিক্ষকের সন্তানকে বিনা বিবেচনায় শিক্ষক হিসেবে গ্রহণ করেন। এই হলো মোটামুটি আমাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া।

অভিযোগের যৌক্তিকতা
অভিযোগকারীরা যে গ্রাউন্ডে অভিযোগ করেছেন তাতে আমার কাছে বিষয়টা আংশিক যৌক্তিক মনে হয়নি। অবশ্য আমাদের প্রচলিত নিয়োগ প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় এমন অভিযোগ আসা খুবই স্বাভাবিক। একজন মানুষ ভালো রেজাল্ট, ভালো গবেষণা থাকলেই যে তিনি ভালো শিক্ষক হবেন তা কিন্তু নয়। মানুষকে বোঝানোর ক্ষমতা এটি একটি জাদুকরী বিষয়। যারা এটা পারেন তারা মহান শিক্ষক হন। আমার দেখা মতে বেশিরভাগ সেরা ছাত্রই ভালো শিক্ষক নন। তাই সেরা ছাত্র মানেই শিক্ষক পদে নিয়োগ পাওয়ার জন্য সেরা যোগ্য এই ধারণা পরিহার করা করা উচিত। অনেক শীর্ষ রেজাল্টধারীকে দেখেছি কেবল মুখস্ত বিদ্যার জোরে ডিপার্টমেন্টে ফার্স্ট হয়ে যেতেন।

আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছিলাম। সেখানে শিক্ষক নিয়োগের আগে প্রার্থীদের ডামি ক্লাস নিতে বলা হতো। সেখানে তাদের বুঝানোর ও শেখানোর দক্ষতা দেখা হতো। এরপর সিন্ডিকেটে সুপারিশ প্রাপ্তদের অস্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হতো। তারপর তাদের অন্তত দুই সেমিস্টার অর্থাৎ এক বছর বিভিন্ন ক্লাসের দায়িত্ব দেওয়া হতো। ওই ক্লাসের ছাত্রদের দিয়ে শিক্ষকদের একটি ইভালুয়েশন তৈরি করা হতো। সেখানে শিক্ষকের টাইম সেন্স, শেখানোর দক্ষতা, আচরণ, ছাত্রদের সাথে সম্পর্ক ইত্যাদি নানান বিষয়ে প্রশ্ন থাকতো। শিক্ষকের ব্যাপারে মন্তব্য করা নিয়ে ছাত্ররা মনখুলে মন্তব্য করতে পারতেন কারণ সেখানে ছাত্রদের নাম লেখা থাকতো না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রদের মূল্যায়ন বিবেচনায় নিয়ে অস্থায়ী শিক্ষকদের স্থায়ী করতেন অথবা ছাঁটাই করতেন। এই মূল্যায়ন শুধু নতুন শিক্ষকদের জন্য নয়, পুরাতন শিক্ষকদের জন্যও ছিল। পুরাতন শিক্ষকদের পদোন্নতির জন্য ছাত্রদের মূল্যায়ন বিবেচিত হতো।

কিন্তু এটা বাংলাদেশ। এখানে ভালো সিস্টেম বেশিদিন চলে না। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালেই এই মূল্যায়নের নিয়ম বাতিল হয়ে যায়। শুনতে পেয়েছি প্রশাসনের অনেকের আত্মীয়রা এই মূল্যায়নে বার বার ধরা খেয়ে যাচ্ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে শুনেছি একজন সিনিয়র শিক্ষক যিনি এখন আওয়ামী এমপি তিনি এই নিয়মের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ভার্সিটির প্রশাসনের দূর্বলতা ও অযোগ্যদের চাপে এই সুন্দর নিয়ম বাতিল হয়ে যায়। এরপরই স্বজনপ্রীতি শুরু হয়ে গেল ভার্সিটিতে। ওমুকের ভাতিজা, ওমুকের শালা এই টাইপের যোগ্যতায় শিক্ষক হয়েছেন অনেকে।

বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগ কেমন হওয়া উচিত?
নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্চ হওয়া দরকার। যাদের গবেষণা দেশি-বিদেশী জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। তাদের জার্নাল পর্যালোচনায় আনা উচিত। তাদের থিসিস তাদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ ধারণা নিতে সহায়তা করবে। এরপর ডামি ক্লাস নিয়ে যাদের বেশি দক্ষ মনে হবে তাদেরই নিয়োগ দেওয়া উচিত। চাকুরি স্থায়ী করার আগে অবশ্যই অন্তত ৬ মাসের পারফর্মেন্স দেখা দরকার।

কীভাবে প্রচলিত সিস্টেম চেইঞ্জ হবে?
প্রচলিত সিস্টেম চেইঞ্জ যিনি করবেন তিনি হলেন শাসক। যতদিন স্বৈরাচারী ও দুর্নীতিবাজেরা ক্ষমতায় থাকবে ততদিন সিস্টেম চেইঞ্জ হবে না। তবে যার যার অবস্থান থেকে সোচ্চার হলে আংশিক ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।

পঠিত : ৩৬৮ বার

মন্তব্য: ০