Alapon

।। ধর্ষণ কেন হয়? ।।

২০২০ সনের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৬২৭ জন নারী ধর্ষিতা হয়েছেন। ধর্ষিতাদের মধ্যে ৫৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষিতা হবার পর আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ১৪ জন নারী। তাদের মধ্যে গ্যাং রেইপের স্বীকার হয়েছেন ৩১৭ জন। [আইন ও শালিস কেন্দ্র]

একটু হিসাব করুন তো, বিগত বছরে প্রতিদিন কত জন মা-বোন ধর্ষিতা হয়েছেন? -২০২০ সনে প্রতিদিন ৪ জনেরও অধিক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। প্রতিদিন ৪ জন!

বিগত বছরে আমাদের মা-বোনরা কতটা কতটা নিরাপদ ছিলেন- এ চিত্র দেখার পর আমরা একটা প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করি- “ধর্ষণ কেন হয়?” এ প্রশ্নের সহজ উত্তর হল ধর্ষকের অস্তিত্ব ও ধর্ষণ সংঘটিত হওয়ার পরিবেশ থাকা।
.
মায়ের উদর থেকে জন্মগ্রহণ করা শিশুটি ধর্ষক হয়ে আসে নি। সে ছিল নিষ্পাপ-মা’সুম। কিন্তু প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পরই এ নিষ্পাপ শিশুদের কেউ পরিণত হয় খুনী ও ধর্ষকে। কেন? তার বেড়ে উঠা ঠিকভাবে হয় নি। বাবা-মা তাকে সুশিক্ষা দিতে পারেন নি। হ্যা, ধর্ষকের বাবা-মা তাকে খাবার দিয়েছে, কাপড় দিয়েছে, ভাল স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। কিন্তু সন্ধ্যার পর টিভির পর্দায় সে দেখছে,

‘সিনেমা-নাটকের নায়করা নায়িকাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলতে টিজ করছে। তার হাত টেনে বুকের সাথে ঠেসে ধরে বলছে, “প্রিয়া! এই বুকে শুধু তোমারই বসবাস। তোমাকে ছাড়া এ বুক শুন্য।” নায়িকার পিছনে ঘুরঘুর চলতে থাকে। মজার ব্যাপার হল- এক সময় নায়িকা পটে যায়। নায়কের প্রেমে হাবুডুবু খায়। তার জন্য পরিবার, সমাজ, সম্মান- সব বিসর্জন দিয়ে ভালোবাসার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।’
.
সিনেমা-নাটকে ধর্ষণের রগরগে দৃশ্য, ধর্ষিতার চিৎকার শুনে ধর্ষকের মজা পাবার হাহা-হোহো করার দৃশ্য ছাড়া সিনেমার পুর্ণতা নেই যেন। সিনেমায় স্বাধীন নারীর ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য স্বল্প পোশাক দেখাতে হয়। তাকে নাচতে হয় নিজের বিভিন্ন অঙ্গের বৈচিত্রময় প্রদর্শনী করে। এমন কি স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোও! কেন? –এটা পুরুষ দর্শকের চোখের চাহিদা। সৃষ্টিগতভাবে নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ রয়েছে। এ আকর্ষণের চাহিদা কিছুটা হলেও সিনেমা নাটকে পূরণ হচ্ছে। ফিল্ম মেকার চায়, তারা যেন এসব ‘বিউটিফুল’ দৃশ্য দেখে। এভাবেই তাদের কাটতি বাড়বে। শরীর দেখিয়ে পুরুষ দর্শকের মন জয় করবে। নারীর মন জয় করবে কিভাবে? –নারীর ভালোবাসার জন্য কিভাবে একজন পুরুষ লড়াই করে, এটা দেখে নিশ্চিত সে প্রশান্তি পায়। নারী হিসেবে ‘স্পেশাল’ ফিল করে। আবেগী গল্পের মায়ায় পড়ে নিজেকে দামী মনে করে। সে অনুভব করে না, ওদিকে একজন নারীর স্বল্প বসনের মাধ্যমে পুরুষদের আকৃষ্ট করা হচ্ছে। এখানে নারী হয়ে উঠছে পণ্য। আর এদিকে তাকে ধর্ষণ করার প্রাথমিক পাঠ নিচ্ছে তারই পাড়ার, গ্রামের, মহল্লার ছেলেটা!
নায়ক যেভাবে নারীকে টিজ করে, তাকে জোর করে টেনে বুকে ঠেকায়, পিছু নেয়, সর্বদা ডিস্টার্ব করতে থাকে- এসবের অবশ্যই মনস্ত্বাত্তিক প্রভাব রয়েছে। পুরুষ শিক্ষা পাচ্ছে, নারীর ভালোবাসা প্রাপ্তির এটা ‘হিরোয়িক পদ্ধতি’। নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার ‘প্রাথমিক শিক্ষা’ এখানে।
.
মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের বৈধ ও স্বাস্থ সম্মত পদ্ধতির প্রতিষ্ঠা করা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার দায়িত্ব। শারীরিক চাহিদাকে মূল্যায়ন করে ‘বৈধ যৌনতা’ অবলম্বন নিশ্চিত করা। আমার জ্ঞানমতে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মের সবকটিতে বৈধ যৌনতার মাধ্যম হল ‘বিয়ে’। কিন্তু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাস্তবতা বিলম্ব বিয়েকে উৎসাহিত করে। আজকাল বিয়ে করতে করতে ২৪-৩০ বছর লেগে যায়। অথচ তার মধ্যে যৌনতার স্বাভাবিক তাড়না সৃষ্টি হয় ১৫ বছর থেকে। তার মানে, ১০-১২ বছর সে নিজের এ চাহিদাকে দমিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। নতুন গড়ে উঠা আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় তাকে স্বাভাবিক একটা চাহিদা মেটাতে ১০ বছর অপেক্ষা করতে হয়। এই ১০ বছর সে কিভাবে পার করে? হস্তমৈথুন, বিবাহ বহির্ভূত যৌনতা এবং ধর্ষণের মাধ্যমে।
.
ধর্ষণ কিভাবে বিয়ে দেরিতে হওয়ার সাথে সম্পর্কিত? দেখুন, সিনেমা-নাটকে একজন ছেলে ধর্ষণের প্রাথমিক শিক্ষা ইতিমধ্যেই নিয়েছে। ইন্টারনেটের সুবাদে পর্নগ্রাফিতে সে এ শিক্ষাকে পুর্ণতায় রূপ দিচ্ছে। আবার রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থায় নেই যথেষ্ট আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা। একইসাথে বৈধভাবে যৌনতার মত স্বাভাবিক চাহিদা মেটানো তার জন্য কঠিন করে দেয়া হয়েছে। এখন এই ছেলেটা কেমন? সে এখন ধর্ষণ করার মত বোধহীন জন্তুতে পরিণত। যাকে আমরা সহজে বলতে পারি ‘পটেনশিয়াল রেইপিস্ট’!

এই ‘পটেনশিয়াল রেইপিস্ট’ এবার সেক্যুলার পরিবেশে পড়ালেখা করে। রাস্তায়, ক্লাবে, ক্লাসে, খেলার মাঠে সে নারীকে খোলামেলা পোশাকে দেখে। বান্ধবীদের সাথে মিশে। যদি সে কারো সাথে শারীরিক সম্পর্ক গড়ার মত যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ হয় তবে সেখানেই তার লালসা চরিতার্থ করে। যেহেতু সমাজ এমন অবৈধ সম্পর্ক প্রশ্রয় দেয় না, সে অনেক সময় এতে ব্যর্থ হয়। ঘুরে বেড়ায় একজন ‘পটেনশিয়াল রেইপিস্ট’ হয়ে। আর শারীরিক সম্পর্কে যেতে ব্যর্থ ছেলেটা তার সফল বন্ধুর থেকে শুনে, কিভাবে সে তার গার্লফ্রেন্ডকে ‘খেয়ে যাচ্ছে’। নারী দেহের রগরগে বর্ণনা শুনে সে লালায়িত হয়। পরিণত হয় ‘পাগলা কুত্তা’য়। সে আরো বড় মাপের ‘পটেনশিয়াল রেইপিস্ট’ হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
.
সে এখন ধর্ষণের জন্য সুযোগ ও পরিবেশের অপেক্ষায়। একাকী নারী, ক্লাসমেট, বান্ধবীকে সে সুযোগ ও পরিবেশমত পেলে ধর্ষণ করে বসবে। পরের দিন পত্রিকার পাতায় খবর ছাপাবে- “ধর্ষণের পর সহপাঠীকে হত্যা”। ছাত্র-শিক্ষকসহ সকল শ্রেণিপেশার মানুষ প্রতিবাদ করবে। মিছিল-মিটিং, মানববন্ধন চলবে। যৌন উস্কানিমূলক উপন্যাস, গল্প,কবিতা রচয়িতা কবি-লেখকরাও পত্রিকায় কলাম লিখবে। সিনেমায় অশ্লীল নৃত্য করা সেই নায়ক-নায়িকা, গায়িকারাও প্রতিবাদ করবে। দুনিয়াপুজারি, আধ্যাত্মিকতাশুন্য সেক্যুলাররা অনেক অনেক বাণী ছাড়বে। সেগুলোর অন্তর্নিহিত বার্তা হল, “ধর্ষক তৈরী হবে এমন শিক্ষাব্যবস্থা চাই। ধর্ষণ করা যাবে এমন পরিবেশ চাই”। এ বার্তা তারা সজ্ঞানে-অজ্ঞানে প্রচার করে বেড়াবে। তাদের অন্তরে মোহর মারা থাকায় তাদের নিজেদের কথার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যও তারা বুঝবে না। সেলিব্রেটি পুজারি, মিডিয়ার ধাঁধায় আসক্ত সাধারণ মানুষও এটা বুঝবে না।

।। ধর্ষণ কেন হয়? ।।
-মুহাম্মদ খালিদ সাইফুল্লাহ
রাত ৮ টা ১২ মিনিট
মহিষমারা, মধুপুর, টাঙ্গাইল।

পঠিত : ৪৯৭ বার

মন্তব্য: ০