Alapon

||ইমাম নাসা'ঈ রহিমাহুল্লাহ-০২||




তাঁর মূল নাম আহমাদ। উপনাম আবদির রহমান। পিতার নাম শু'আইব। দাদার নাম আলী।

মোটের ওপর তাঁর পুরো নাম হলো; আহমদ ইবনে শুআইব ইবনে আলী ইবনে বাহার ইবনে দিনার আন-নাসা'ঈ। তিনি খুরাসানের একটি সুপ্রসিদ্ধ শহর নাসা'তে জন্মগ্রহণ করেন। খুরাসানের নাসা'র শহরটির অবস্থান আজকের তুর্কেমেনিস্তানের মার্ভের একেবারে নিকটেই। সে কারণেই তাঁকে নাসা'ঈ বলা হয়ে থাকে। পূর্বেই তো বলা হয়েছে যে, তাঁর বাবাও জগতবিখ্যাত একজন আলিম ছিলেন। পরিবারের কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। কিন্তু তিনি তাঁর বাবাকে শৈশবেই হারান। তাঁর মা-ই তাঁকে পরম মমতায় আগলে রাখেন। লালিত পালিত করেন। পিতৃ হারানোর ব্যথা তাঁর জন্যেও দ্বীনের ইলম অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। যেমনি ভাবে দামেস্কের মাসজিদের ভেতর জালিমদের শতো আঘাত-অত্যাচারও তাঁকে সত্য থেকে একবিন্দুও টলাতে পারে নি।

মূলত মিশরের পরশ্রীকাতর আর হিংসুটে হীনমন্য মানবদের পরশ্রীকাতরতা আর হিংসের জন্যে তিনি সেখানে আর থাকেন নি। চলে এসেছেন দামেস্ক নগরীতে। এখানে এসে তিনি পড়েন মহা বিপাকে। তাদের চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা আলি ইবনে আবি তালিবের বিরুদ্ধে। আহলুল বাইতের বিরুদ্ধে। ইসলামের চতুর্থ খলিফা, আমিরুল মু'মিনিনীনের বিরুদ্ধে তাদের বিষোদগার তাঁকে কঠিন কষ্ট দিতো। দারুণ ভাবিয়ে তুলতো। তিনি তাই রচনা করেন,

‘কিতাবুল খাছায়িছ ফী ফাদ্বলে আলী ইবনি আবী তালিব ওয়া আহলিল বাইত’ নামে একটি অনবদ্য গ্রন্থ। এ গ্রন্থটি পুরো সিরিয়া-দামেশকে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি দামেশকের মসজিদে সকলকে আহলুল বাইত, আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে আনিত যে অভিযোগ, সে অভিযোগের ব্যাপারে ওনার মর্যদা নিয়ে বক্তৃতা করেন। যাতে সাধারণ লোকদের ভেতর তাঁর সম্পর্কে যে মন্দ ধারণা ও ঈমানের বিচ্যুতি তৈরি হয়েছে, তা বিদূরিত হয়ে যায়।


আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং মুআবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মধ্যে যে দন্দ্ব, যে যুদ্ধ, যে ভুল বুঝাবুঝি, সেই দ্বন্দ্ব-সংঘাত-ভুল বুঝাবুঝির বিষয়ে এখানকার মানুষের মনে মুআবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ও আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বিষয় নিয়ে উভয়ের মর্যদা, গ্রহণযোগ্যতা অবস্থান স্পষ্ট করতে দৃঢ়তার সঙ্গে কর্মে ঝাপিয়ে পড়লেন। এখানে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বিরুদ্ধে এক তরফা অপপ্রচার আর অপবাদ হচ্ছে, এজন্য সেখানে তিনি যা সত্যি তা বলার মনস্থির করলেন। আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর শাসনকে সমর্থন করেন, সাপোর্ট করেন। ইসলামি সম্রাজ্যের খলিফাতুল মুসলিমীন হিসেবে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকেই মান্য করেন। এবং লোকদের মাঝে এই বিশুদ্ধ আকিদাকে ছড়িয়ে দিতে প্রচেষ্টা করেন।


একদিন তিনি মাসজিদে গেলেন। বক্তৃতা করতে শুরু করলেন। বক্তৃতায় তিনি আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মর্যদা বর্ণনা করতে লাগলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ আলোচনার পর পরই এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি আমীরুল মুমিনীন মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মর্যদা নিয়ে কোনো কিতাব রচনা করেছেন? তিনি না সূচক জবাব দিলেন। এবং তারা মুআবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর সম্পর্কে জানতে চান। তিনি স্রেফ এতোটুকুনই বললেন যে, তিনি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু অা'লাইহি ওয়াসাল্লামের একজন সাহাবী! তাঁর মর্যদা যতোটুকু তিনি ততোটুকুনই দিয়েছেন। তা-ই দিতেন। বেশি কম করতেন না।


খলিফাতুল মুসলিমীন, আল্লাহর রাসুেলর জামাতা, হাসাইন-হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহুমার বাবা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর বিরোধী লোকজন ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়েন ওনার প্রতি। ঝাঁপিয়ে পড়লেন ওনার ওপর। অপবাদ আরোপ করলেন শিয়া বলে। তাঁকে আঘাতের পর আঘাত করতে লাগলেন। তিনি লুটিয়ে পড়লেন মাসজিদের মেঝেতে। অথচ তিনি আমীরে মুআবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি বিরাগভাজন ছিলেন না। বিদ্বেষ পোষণ করতেন না। ছিলেন না শিয়াও। তিনি সাহাবিদের মর্যদা নিয়ে একটি গ্রন্থও রচনা করেছেন। সেখানে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পক্ষ নিয়ে কোনো বাড়াবাড়িও করেন নি। করেন নি ছাড়াছাড়িও। ওনার যতোটুকু মর্যদা ততোটুকুনই দিয়েছেন। সাহাবি হিসেবে মুআবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁর গ্রন্থে তিনি আমীরে মুআবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত অনেকগুলো হাদিস নিয়েছেন। তবুও তাঁরা তাঁকে শিয়া বলে, আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর প্রকৃত মর্যদা বর্ণনা করে খেলাফতে আ'লা মিনহাজুন নবুওয়্যাকে সমর্থন করার জন্যে বেদম প্রহার করলেন। বৃদ্ধ মানুষটির চোখের জল আর রক্ত একাকার হয়ে গেছে মুখাবয়বে। বেহুশ হয়ে দীর্ঘক্ষণ পড়েছিলেন সেখানেই । এক পর্যায়ে হুঁশ আসে। হুঁশ আসার পরে তিনি সেখান থেকে চলে যাবার মনস্থির করলেন। মক্কাতে যাবার ইচ্ছে পোষণ করলেন।


এরপর ওনাকে অসুস্থ অবস্থায় মক্কায় নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে গিয়ে থাকলেন তাঁর একজন শাগরেদের নিকটে। তিনি তাঁকে সেবা-যত্ন করলেন কিছুদিন। কিন্তু তিনি আর সুস্থ হলেন না। পাড়ি দিলেন পরপারে। সাড়া দিলেন রাব্বে কারিমের ডাকে। ইন্না-লিল্লাহি ও-ইন্নাইলাইহি রাজিউন। সেদিনটি ছিলো ৩০৩ হিজরি সনের ১৩ সফর সোমবার। কারো কারো মতে তাঁকে ফিলিস্তিনে নিয়ে আসা হয় আহতাবস্থায়। দাফন করা হয় বায়তুল মাকদিসের কাছেই। তবে সর্বাধিক বিশুদ্ধ মত হচ্ছে তাঁকে সমাহিত করা হয় সাফা-মারওয়া পাহাড়ের মাঝখানে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা ইমাম নাসা'ঈ রহিমাহুল্লাহকে শহিদ হিসেবে কবুল করুন। জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। তাঁর আমলে সালিহগুলো কবুল করুন। আমাদেরকে তাঁর জীবনী থেকে শিক্ষা নিয়ে আদর্শ মানুষ হবার তাওফিক দান করুন। আ-মী-ন!!


||ইমাম নাসা'ঈ রহিমাহুল্লাহ-০২||
~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ২৬২ বার

মন্তব্য: ০