Alapon

শামস তাবরিজি ও মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি




শেখার জন্য তুমি পড়াশোনা করো, কিন্তু বুঝতে হলে তোমার প্রয়োজন ভালবাসা
- শামস তাবরিজি
মাওলানা রুমির জন্ম অত্যন্ত সচ্ছল পরিবারে। মায়ের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল, বাবাও বেশ সম্মানিত কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। অপরদিকে শামস তাবরিজি ছিলেন সমাজ থেকে একটু আলাদা, যিনি নিজেকে সম্পদ থেকে সবসময় দূরে রেখেছেন। আধ্যাত্মিকতা আর সম্পদের মোহ থেকে মুক্ত থাকার দরুণ তিনি সবসময় কিছু মানুষের কাছে অন্যরকম মর্যাদা পেতেন। মানুষ তাকে ‘পাখি’ বলে ডাকত, কারণ তিনি এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতেন না, দ্রুত জায়গা পরিবর্তন করতেন। লোক মুখে প্রচলিত ছিল, তিনি একজন শিষ্য খুঁজতেন যে কি না তার পরে আধ্যাত্মিকতার কাজটি এগিয়ে নেবে।

শামস তাবরিজির সাথে যখন রুমির প্রথম সাক্ষাৎ হয় তখন রুমির বয়স মাত্র ২১ বছর। সেই সময় মাওলানা রুমিকে শিষ্য হিসেবে পছন্দ করেন তাবরিজি, কারণ বয়স কম হলেও তিনি রুমির ভেতর জ্ঞানের বিশালতা আর গভীরতা খুঁজে পান, তবে আরও একটু পরিপক্ব বয়সের আশায় তাবরিজি তখনও রুমিকে কোনোপ্রকার শিষ্যত্বের ইঙ্গিত দেননি!
অনেক বছর পর যখন মাওলানা রুমির বয়স ৪০ বছর হয়, তখন শামস তাবরিজি আবার রুমিকে খুঁজে নেন। কারণ তিনি মনে করতেন এটাই সেই বয়স যখন রুমি নিজেকে মেলে ধরতে পারবেন আকাশের বিশালতায়! তার সাথে আলাপ-আলোচনায় রুমি যেন অন্য এক জগতের সন্ধান পান, যেখানে দুনিয়ার অনেক বড় বিষয়গুলো ক্ষুদ্র মনে হতে থাকে। নিজেদের আলাপে ভর করে জ্ঞানের নতুন আলোর আরও গভীরে যেতে রুমি তাবরিজিকে বাসায় নিয়ে আসেন, আলাপ-আলোচনায় জ্ঞান গ্রহণের ভেতর দিয়ে সময় কাটাতে থাকেন।

রুমির সাথে তাবরিজির জ্ঞানের সম্পর্ক মানুষ মেনে নিতে চায়নি! একে তো তাবরিজি সমাজ থেকে পুরোপুরি আলাদা, সমাজের অধিকাংশ নিয়ম-কানুনকে তিনি সবসময়ই একরকম প্রত্যাখ্যানই করেন। তার উপর রুমির পরিবার সমাজে সুপরিচিত এবং প্রতিষ্ঠিত। যদিও তাবরিজি জ্ঞানের আলোয় আলোকিত এক বাদশা, তবে অধিকাংশ মানুষ সেই হিসেবে কোনোদিন তাকে বিচার করতে যায়নি। তাদের কাছে তাবরিজি এক নিঃস্ব মানুষ ব্যতীত আর কিছুই ছিল না!
সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই এগিয়ে যান রুমি। যখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, ঠিক তখন রুমি করে বসলেন এক অদ্ভুত কাজ! তিনি তার সৎ মেয়ে কিমিয়ার সাথে তাবরিজির বিয়ে দিয়ে দেন। এতে করে সেই সমাজে তাবরিজির একটা শিকড় জন্মে, যা প্রত্যাখ্যান করে কেউ আর তাকে ছুঁড়ে ফেলার সাহস করবে না।
তবে তাবরিজির সাথে রুমির এই জ্ঞানসাধনা বেশি দিন টেকেনি। তার সাথে কিমিয়ার বিয়ের অল্প কিছুদিন পরই কিমিয়া মারা যায়। ফলে তার শিকড় আবারও আলগা হয়ে যায়। কথিত আছে, তাবরিজিকে হত্যা করা হয়। সে যা-ই হোক, তাবরিজি যেন হয়ে ওঠেন বনের সেই পাখিটি, যে কি না আবার হারিয়ে যায়, যা মাওলানা রুমিকে প্রচন্ড ব্যথিত করে।

তাবরিজির হারিয়ে যাওয়া অথবা মৃত্যুর অনেক দিন পর অবধি মাওলানা রুমি তাকে ফিরে পাওয়ার আশায় বিভোর ছিলেন। তারপর যখন বুঝতে পারলেন জ্ঞানের সাগরের সাথে তার আর দেখা হচ্ছে না, তখন তিনি তাবরিজির মৃত্যুর ঘোষণা দিলেন। তাকে হারিয়ে ফেলার শোকে রুমি লিখলেন ‘দেওয়ান-এ শামস-এ তাবরিজি’। এখান থেকেই যেন এক অন্যরকম রুমির আবির্ভাব ঘটে। নতুন রুমি সবার কাছে আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হতে থাকেন। হৃদয়ের আলো-অন্ধকারের কথা, সুফিবাদের কথা এমনভাবে বলতে থাকেন যে দৃষ্টিকোণ থেকে এসব বিষয় তখন কেউ দেখেনি। মানুষে-মানুষে সম্পর্ক, মানুষের হারিয়ে যাওয়া, সৃষ্টিকর্তার সাথে মানুষের সম্পর্কের ভাবনা নিয়ে হাজির হন এক অন্য রুমি।

জীবনের ভাবনাগুলো তখন শুধু জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, সেগুলো হয়ে উঠেছিল নীরব আর গভীর। যেমন শামস তাবরিজিকে খুঁজে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার বিপরীত দিকে গিয়ে তিনি লেখেন,
আমি কেন তাকে খুঁজব?
সে আর আমি তো একই
তার অস্তিত্ব আমার মাঝে বিরাজ করে
আমি নিজেকেই খুঁজছি।
শামস তাবরিজিকে নিজের আলোয় অমর করতে তার গ্রন্থ ‘দেওয়ান–এ শামস-এ তাবরিজি’তে একে একে যোগ করতে থাকেন গজল, কবিতা, যা আধ্যাত্মিকতার এক নতুন পাঠ হিসেবে সবার কাছে প্রকাশিত হয়।লোকমুখে তখন প্রচলিত হয় যে, তাবরিজির মৃত্যুর পর মাওলানা রুমিই তাবরিজি হয়ে ওঠেন! কারণ ততদিনে মাওলানা রুমির লেখা একেকটি লাইন মানুষের ভেতর নাড়িয়ে দিতে থাকে, ক্ষমতাশীল পৃথিবীকে তুচ্ছ করে দেয়ার মতো সব লেখা লিখতে থাকেন তিনি।

নোটঃ
আমার লেখা মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমিঃ সুফিবাদ এবং হৃদয়ের ভাষার এক মহাগুরু থেকে নেয়া।পুরো লেখাটির লিংক কমেন্ট বক্সে দিয়ে দিচ্ছি।
ছবি- 'দেওয়ান-এ শামস-এ তাবরিজি’র ১৫০৩ সালের পৃষ্ঠার অনুকরণ।


~সাজ্জাদ হোসাইন খান

পঠিত : ৩৯০৬ বার

মন্তব্য: ০