Alapon

আমাদের শৈশব-কৈশোরের শীতকাল যেমন ছিলো

১.
তখন আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠেই সবাই রৌদ পোহাতে বসতাম। নাহ! রোদের তেজ কম, এতে কাজ হচ্ছে না। বিকল্প ব্যবস্থা করা লাগবে। কাঠ, গাছের গুড়ি, খড় দিয়ে উঠানে আগুন জ্বালাতাম, চারপাশে সবাই মোড়া নিয়ে বসে আগুনে হাত গরম করতাম।

আমাদের এই উষ্ণতাকে দিগুণ করে দিতে, মা আগের বানানো শক্ত ভাঁপা পিঠা এনে আগুনে দিতো, পুড়ে পুড়ে খেতাম। নানু মাটির পাতিলে চিটা আর কয়লার আগুন নিয়ে বসতেন, তাতেই হাত গরম করতেন, আর একটু পর পর গরম হাত আমাদের গালে লাগাতেন, তুলতুলে গালগুলো গরম হয়ে যেতো৷ আহ!

২.
সকালের মিষ্টি রোদে যখন চারপাশ আলোকিত হতো, তখন বড় বড় সিলভারের কলস নিয়ে নানার সাথে খেজুরের রস আনতে বের হতাম। কিনে নয়, গাছ থেকে। নানাদের ত্রিশের অধিক খেজুর গাছ ছিলো। বিকালে ছেনি (লম্বা দা) দিয়ে খেজুর গাছের মাথার দিকের শুকনো চামড়ার এক পার্ট তুলে দিলে রস বের হতো, সেখানে নলি বসিয়ে মাটির গটি (কলস) ঝুলিয়ে রাখতেন, ফোঁটা ফোঁটায় রসে ভর্তি কলস থেকে সকালে রস ঢেলে নিয়ে আসতাম। অবশ্য মাঝে মাঝে আমাদের মতো দুষ্ট ছেলেরা রাতেই রস চুরি করে খেয়ে ফেলতো।

রস চুরি করারও বিশেষ কায়দাকানুন ছিলো। পেঁপে গাছের ঢাল নিয়ে (যার মাঝখানে ফাঁকা) কিংবা স্যালাইন দেয়ার জন্য যে স্ট্র ব্যবহার করতো (যাকে আমরা স্যালাইনের লত বলতাম) তা দিয়ে কলস থেকে টেনে রস খেয়ে নিতো। আমরাও মাঝে মাঝে শখ করে এমন করে রস খেতাম।

৩.
রস আর শীতের পিঠা খেয়েই দিতাম মাঠে দৌড়। হাতে ব্যাট-বল। শীতের এই সময়টাতে জমিন ফাঁকা থাকতো, চাষীরা ধান কেটে নিয়েছে, বৃষ্টিও নাই। জমিন শুকনো, সেখানেই আমরা ক্রিকেট খেলার মাঠ বানাতাম। তবে কিছু কিছু জমিনে সরিষা চাষ করা হতো, তা দেখতেও অসাধারণ লাগতো, মৌমাছিরা সরিষাফুল থেকে মধু সংগ্রহ করতো।

যদিও আমরা খেলতে গিয়ে ঐ সরিষাক্ষেত নষ্ট করতাম । যাইহোক, সারাদিন ক্রিকেট খেলা নিয়ে পড়ে থাকতাম আমরা। কারণ মাত্র বছরের শুরু, মাদ্রাসায় তখনো পুরোদমে ক্লাস শুরু হয়নি৷ সরকার থেকে দুই-চারটা করে বই আসছে আর আমাদেরকে দিচ্ছে, তখন একসাথে সব বই আমরা পেতাম না। তাই ক্লাস শুরু হতেও দেরী হতো।

৪.
সারাদিন মাঠে কাটিয়ে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন একদফা মাইর খেতে হতো, ঐ যে সারা শরীর ময়লা করে এসেও যখন ঠাণ্ডা পানির ভয়ে গোসল করতে চাইতাম না তাই। আম্মু মেরেছে ঠিক, কিন্তু গরম পানিও করে দিয়েছে৷ গোসল করে খেয়েদেয়ে পুরাতন ক্যালেন্ডার কাটতাম। কেন?

আরেহ, মাদ্রাসা থেকে নতুন বই দিয়েছে তো। বইগুলো সুন্দর করে বাঁধাই করতে হবে। শুধু ক্যালেন্ডার কেটে বাঁধলেই তো হবে না, সুই (ভোমর) সুতা দিয়ে সেলাইও করে নিতে হবে। এই কাজটা আমি ভালো পারতাম বলে বন্ধু-বান্ধব আর কাজিনদেরগুলোও বাঁধার দায়িত্ব আমার উপর ছিলো।

৫.
আর শীতের সন্ধায় কিন্তু আবার বাসায় লেপ-কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতাম না। আমাদের একটা গ্রুপ ছিলো, সবাই সাইকেল নিয়ে বের হয়ে পড়তাম। কেন জানেন? আর কেন, ওয়াজ শুনতে আর কি। শীতকাল ওয়াজ-মাহফিলের মৌসুম। তখন কিন্তু এখনকার মতো এত হইহট্টগোল, ঢেলে দেয়া কিংবা বৃষ্টি না হলে দেখিয়ে দেয়ার মতো বিশাল মাহফিলের কোনো ব্যবস্থা ছিলো না। রুহানিয়ত ছিলো বটে।

কেবল টাউন হল ময়দানে বড় তাফসীর মাহফিল হতো, আল্লামা আসতেন। মাসব্যাপী সবাই কালেকশন করে বাস রিজার্ভ করে উনার তাফসীর শুনতে যেতেন, আম্মুরা দিনে যেতেন আর আমরা রাতে। কোনো চিল্লাপাল্লা ছিলো না।

এছাড়া প্রতি গ্রামেই ছোটখাটো ওয়াজ মাহফিল হতো। আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে আমল-আখলাকের বয়ান শুনতাম, ছিটেফোঁটা আমল করারও চেষ্টা করতাম, তখনকার ওয়াজের একটা আছর আমাদের উপর পড়তো।

এখন সে রুহানিয়ত আছে কিনা আমার জানা নাই।মাহফিল শেষে গরম জিলাপি নিয়ে বাড়ি ফিরতাম, আম্মু জিলাপির পাগল ছিলেন। যাক, সবশেষে হাড়কাঁপানো শীত থেকে বাঁচতে কয়েকটা কাঁথা কিংবা কম্বলের উপর আরো একটা কাঁথা দিয়ে শান্তির ঘুম দিয়ে ফজরে উঠতাম।

হ্যাঁ,
এমনই ছিলো আমাদের ছেলেবেলার শীতকাল। যাদুর বাক্স মোবাইল-ইন্টারনেটবিহীন কি চমৎকার এক শৈশব ছিলো আমাদের। আর আজ আমরা কত মডার্ণ হয়েছি। সাথে সাথে আমাদের শীতকালও মডার্ণ হয়েছে। যাক, বাচ্চাদেরকে শীতের সকাল রচনা মুখস্ত করতে দিন, তাতে কিঞ্চিৎ ধারণা হলেও পাবে। (১৯৯০-২০০৭/৮ পর্যন্ত আমাদের শীতকাল এমনই ছিলো)।

|| আমাদের শৈশব-কৈশোরের শীতকাল যেমন ছিলো।।
-Md Syful Islam

||

পঠিত : ৫৮৭ বার

মন্তব্য: ০