Alapon

-| তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেন|-০২




সত্যিই তো! ওই তো মনে হয় একটা পবিত্র আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রাজ্যের দরদ আর পবিত্রতা যেনো ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে সেই আওয়াজ থেকে। দয়াময় আল্লাহ তাঁর একজন পবিত্র বান্দাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না। সত্যিই পারেন না! তিনি অসহায় করে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিলে তাঁর এই বান্দী, পবিত্র মানবী কার কাছে যাবে! কোথায় আশ্রয় পাবে! তাই তিনি জিবরাঈল (আলাইহিসসালাম)-কে আবারও পাঠালেন তাঁর কাছে।
একটু দূরে, আঁখির আড়ালে ছিলেন তিনি আজ। তাঁর সতীত্ব আর পবিত্রতার প্রতি শ্রদ্ধার সর্বোচ্চটুকুনই যেনো তিনি ঢেলে দিয়ে বলতে লাগলেন — আললা তাহযানী! আপনি চিন্তিত হবেন না। অত্যধিক চিন্তা করে, চিন্তার কোলে ঢলে পড়ে হতাশ হওয়া আপনাকে মানায় না! আপনার আশেপাশে কেউই নেই, কোনো উপায়-উপাদান নেই, মানুষ আপনার পবিত্রতা-সতীত্বের ওপর মন্দ ধারণা করবে, আপনার ওপর অপবাদ আরোপ করবে, দুর্নাম রটিয়ে বেড়াবে—এসব নিয়ে কোনো দুঃখ আর আফসোস করবেন না। শক্ত হোন, শক্ত থাকুন। মন ভাঙবেন না! পাশেই ফিরে দেখুন, আপনার পদতলে ঝরনা সৃষ্টি করা হয়েছে। মিঠে পানির ঝরনা। আপনি পিপাসার্ত। ওখান থেকে পানি পান করুন। মনের কোণে জমে থাকা বিষণ্ণতা, শরীরে প্রতিটি অস্থিতে এঁটে থাকা ক্লান্তি আর দুর্বলতা সব কেটে যাবে! আপনি আবারও সতেজ হয়ে ওঠবেন! এতোক্ষণ বলে যাওয়া কথাগুলো তিনি শুনলেন৷ কন্ঠটা পরিচিত মনে হচ্ছে তাঁর কাছে। ভীষণ পরিচিত! ওপাশ থেকে তিনি বলেই যেতে লাগলেন, আপনি আনন্দিত থাকুন। আল্লাহর তরফ থেকে এই যে এখানকার দেয়া অনুগ্রহ, সেই অনুগ্রহের আনন্দ, অনাগত এক মর্যদাবান সন্তানের জননী হবার আনন্দ ! উপযুক্ত আর প্রিয় বান্দাদের থেকেই আল্লাহ পাক রব্বুল আলামীন পরীক্ষা নেন। আপনি তাঁর প্রিয় আর বাছাইকৃত বান্দী হবার মতোন যে একমহা সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, সেটার জন্যেও শুকরিয়া আর কৃতজ্ঞতা আদায় করুন। তাঁর বন্দনা করুন। কন্ঠটা এবার সুস্পষ্টই বুঝতে পারলেন তিনি। এ-তো রুহুল আমীনেরই কন্ঠ! পূর্বেও তাঁর কাছে নিজস্ব আকৃতিতে এসেছে। পুত্র হবার সংবাদটা তো ইনি-ই দিয়ে গেছেন।

তিনি মনে মনে যেনো বলেন ; কিন্তু সবই তো বুঝলাম, মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করবে। প্রশ্ন করবে। আমি কী জবাব দেবো, কী বলবো — এই প্রশ্নটা যেনো তাঁর মগজ উতরে উতরে বের হতে চায়। প্রশ্নটার প্রচ্ছন্ন একটা চাপ তাঁর চেহারায়ও যেনো সুস্পষ্টরূপে ফুটে আছে। কিন্তু আল্লাহ রব্বুল আলামীনের তরফ থেকে সে-ই উত্তরটাও জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরই প্রধান ফেরেশতা জিবরাঈল (আঃ)! তাঁকে ( মারইয়াম আঃ-কে) বলা হোলো — তোমার কোনো কথা বলার প্রয়োজন নেই। এর দায়িত্ব সম্পূর্ণ আল্লাহর। তিনিই এর সমাধান করবেন। কারো আপত্তি আর অভিযোগ-অনুযোগের দিকে কর্ণপাত না করে তুমি ধৈর্য ধারণ করতে থাকবে। প্রশ্ন করলে চুপ থাকবে। তাদের জানিয়ে দেবে — আমি রোজাদার। আল্লাহর উদ্দেশ্যে আমি মৌনতার নীতি অবলম্বন করলাম। করলেনও তিনি তাই।

এক পর্যায়ে তিনি মা হয়েই গেলেন। গর্ভের সন্তান এলেন দুনিয়ায়। শিশু ঈসা (আঃ)-এলেন পৃথিবীর জমীনে। তাঁকে নিয়ে কাঁপাকাঁপা বুকে রওয়ানা হলেন নিজ জনপদের উদ্দেশে।
মারিয়ামের কোলে শিশু ঈসা (আঃ)-কে দেখেই তাদের চক্ষু চড়কগাছ! তাদের কেউ কেউ তাঁর নামে মিথ্যের সর্বোচ্চ মিসাইল নিক্ষেপ করতে লাগলো। অপবাদ ছড়াতে শুরু করে দিলো। ছড়িয়ে দিলো যে— বায়তুল মাকদিসের খাদিম ইউসুফের সাথে মারিয়াম অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে। (নাঊযুবিল্লাহ)! অথচ ইউসুফ নিজেও ছিলেন একজন বড়োই আল্লাহ ভীরু মানুষ। মারিয়াম (আঃ) যখন গর্ভবতী হলেন, সেটা তিনিও টের পেলেন। তখন তিনি অত্যন্ত জড়োসড়ো হয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন; আচ্ছা বলুন তো মারিয়াম, বীজ ছাড়া কি গাছ হয়? গাছ বিহীন কি ফল হয়? মূলত মারিয়াম ( আঃ)- এর তাক্বওয়া, ফরহেজগারিতা, ইবাদাত-বান্দেগী তো তিনি সচক্ষেই দেখেছেন, তাই ভয়-ভদ্রতা, বিনয়-নম্রতার সবটুকুন ঢেলে দিয়ে তিনি প্রশ্নটা করলেন। মানুষ তো, মানুষের মনেই প্রশ্ন জাগে। তাঁর মনে জাগ্রত সেই প্রশ্নও মারিয়াম ( আঃ)-ও সর্বোচ্চ সুন্দরপন্থায় জবাব দিলেন —"হ্যাঁ, বীজ ছাড়াও গাছ হয়, গাছ ছাড়াও ফল হয়" — এরপর মানুষটি আর দ্বিতীয় কোনো প্ররশ্ন করলেন না । মেনে নিলেন, চলে গেলেন পরিপূর্ণ বিশ্বাসেভরা হৃদয় নিয়ে। এমনই একজন নিষ্পাপ পবিত্র মানুষকে নিয়ে তাকে জড়িয়ে এমন ভয়াবহ অপবাদ জড়িয়ে দিলো— ভাবতেই তাঁর চোখযুগল ছলছল করে ওঠেছে যেনো। বাস্তবে তো মানুষের তা-ই হয়।

একজনের পর একজন আসতেছে ওনার কাছে, দলে দলে। উৎসুক নেত্রে চেয়ে চেয়ে বলতে লাগলো ; এ-কি মারিয়াম। এ- করলেটা কী তুমি! তোমার নিকট তো এরকম কিছু প্রত্যাশিত ছিলো না। আমরা তো তোমাকে অনেক, অনেক ভালো জানি! এ- তুমি কীভাবে করলে? না তোমার বাবা কোনো অসৎ মানুষ ছিলো, না ছিলো তোমার মা কোনো ব্যভিচারিনী নারী। তাঁরা তো ছিলেন ফরহেজগার মানুষ। তাহলে কীভাবে তুমি এমনটা করলে? কীভাবে! বলো, জবাব দাও —তিরস্কার আর প্রশ্নবাণে জর্জরিত তিনি। কনো কথায়-ই তাঁর মুখ থেকে বের হতে চায় না যেনো। তবুও তাদের মুখে তো আর কুলুপ এঁটে দেয়া যায় না। তিনি দেখিয়ে দিলেন তাঁর কোলের ছোট্ট শিশু ঈসাকে। জবাব যা দিবে এই শিশুই দিবে— মনে মনে এই ভাবনা তাঁর। কিন্তু তারা হতবাক হয়ে বলতে লাগলো; এ-কি বলো মারিয়াম ! এই বাচ্চা শিশুর সাথে আমরা কী বলবো? ও-আমাদের কী জবাব দেবে! কীভাবে সম্ভব তা? কিন্তু আল্লাহ তো যা চান তা-ই করেন। তিনি-ই তো অসম্ভবকে সম্ভব করেন!

তাদের সবগুলো কথায়-ই তিনি শুনতে পেলেন। শিশু ঈসা (আলাইহিস সালাম) তখন দুগ্ধপানরত। সচকিত হয়ে ওঠলেন তিনি ! আল্লাহ সুবহানাহু ওতা'আলা তাঁর জবান খুলে দিলেন। তাদের সকলের উদ্দেশেই তিনি বলে ওঠলেন— আমি আল্লাহর বান্দা। আমাকে নবি হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। আমাকে কিতাব দেয়া হয়েছে। তোমরা যা বলো , তা অসত্য। অন্যায়। অপবাদ। মিথ্যে । আমার জন্মে কোনো অপবিত্রতা ও অপরাধ থাকতে পারে না! আমাকে বরাকাহ'র অধিকারী। রব্ব তাঁর বরাকাহ'র বারিধারায় আমাকে সিক্ত করেছেন । আমাকে আমার রব্ব তাঁর ইবাদত-দাসত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। স্বলাত ও যাকাত আদায়ের আদেশ দিয়েছেন। যতোদিন বাঁচি পৃথিবীতে, ততোদিন। আমাকে (আমার বাবা যেহেতু নেই) মায়ের প্রতি অনুগত্যশীল করেছেন এবং তিনি আমাকে অহংবোধ লালনকারী ও হতভাগ্য হিসেবে সৃষ্টি করেন নি! জন্মের সময় আমাকে শয়তান স্পর্শ করতে পারে নি। আমি পূর্নরূপে নিরাপদ ছিলাম। অনুরূপভাবে মৃত্যুর সময় ও পুনরুত্থানের সময়ও আমাকে পথভ্রষ্ট করতে পারবে না ইবলিস। সে- সময়ো আমি থাকবো নিরাপদ। আমি আল্লাহর সৃষ্ট বান্দাদের মধ্য হতে একজন। অন্যান্য সৃষ্টির মতো আমিও জীবন-মৃত্যুর আওতাধীন। সকলের মতো আমিও পুনরুখিত হবো। শেষ বিচারের দিন আমাকেও তাঁর আদালতে হিসেব-নিকেশ দিতে হবে। একটানা কথাগুলো তিনি বলেই গেলেন। কথা বলার সুযোগ পেয়েই তিনি যেনো তাঁর জন্মের পবিত্রতার পাশাপাশি সকলকেই আরো কিছু জানিয়ে দিলেন যে ; আমার প্রতি প্রবল বিশ্বাস-ভালোবাসা থেকে তোমরা যেনো আমাকে মানুষ এবং আল্লাহর বান্দা ও নবির বাহিরে ভিন্ন কিছু, অধিক কিছু বানিয়ে ফেলো না! যারা এতোক্ষণ প্রশ্ন তুলেছে যে, শিশুটির সাথে কীভাবে কথা বলবো। শিশুও বা কীভাবে আমাদের সাথে কথা বলবে? তাদের মুখে যেনো তালা এঁটে গেলো। প্রবল বিস্ময়ে তাঁরা “থ” বনে গেলো।

এভাবেই আল্লাহ সুবহানাহু ওতা’আলা মারিয়াম আলাইহিস সালাম ও ঈসা আলাইহিস সালামের দ্বারা প্রমাণ করে সকল বিশ্বাসী ও বিশ্ববাসীর সম্মুখে প্রমাণ কোঁড়ে দেখিয়ে দিলেন যে তিনি সকল অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। তিনি বললেই হয়ে যায়—কুন ফা-ইয়াকু-ন! তিনি যা-ই চান তা-ই পারেন। বাচ্চা শিশুর জবান দ্বারা বড়োদের মতো স্পষ্টরূপে কথা বলাতে পারেন। স্বামী-পুরুষের সংস্পর্শ ছাড়া একজন নারীকে “মা” বানাতে পারেন। সন্তান দুনিয়ায় আনাতে পারেন। অমুক-তমুক কেউই অসম্ভবকে সম্ভব করার ন্যূনতম ক্ষমতা-ও রাখে না। অসম্ভবকে সম্ভব করেন শুধুই আল্লাহ তা’আলা।


-| তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেন|-০২
~রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৫৩৩ বার

মন্তব্য: ০