Alapon

ওসি প্রদীপ কি আজ খিচুড়ি পাবে?



রাতে ২ নং হলের শিবির সভাপতিকে ফোন করে বললাম ভাই সকালে আপনার হলে ৩০ জন খাবো। খাবার রান্নার ব্যবস্থা করেন। মেনু হবে ডিম খিচুড়ি। এই হলটা রাস্তার খুব কাছে। এখান থেকে মিছিল বের করা ইজি হবে।

ঘটনা অনেক আগের। আমাদের নেতা শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা'র রায় দেবে ক্যাঙ্গারু ট্রাইব্যুনাল। নির্দেশ ছিল যদি খালাস ছাড়া অন্য কোন রায় আসে তবে আমরা প্রতিবাদ মিছিল বের করবো। আমরা এই রাজনৈতিক মামলাকে আইনী ও রাজনৈতিক সবভাবেই মোকাবেলা করতে চেয়েছিলাম। আমরা আমাদের সব অপশনকেই ফাংশনাল করতে চেয়েছি।

যাই হোক, বারোটার দিকে রায় আসলো যাবজ্জীবনের। আমরা বিক্ষোভ নিয়ে রাস্তায় নেমে আসলাম। সাড়ে বারোটায় চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে তখন প্রায় দুইহাজার মানুষ জমায়েত হয়ে গেছি। মুরাদপুরের দিকে আমাদের মিছিল যাত্রা শুরু করলো।

বহদ্দারহাটে চাঁদ্গাঁও থানার পুলিশের উপস্থিতি ছিল। তারা আমাদের বড় সাইজ দেখে কিছু বলেনি। শুলকবহরে আসা মাত্রই পাঁচলাইশ থানার পুলিশ আমাদের ওপর কথাবার্তা ছাড়াই গুলি করতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে মিছিলের পেছনে থাকা চাঁদ্গাঁওয়ের পুলিশও টিয়ার শেল নিক্ষেপ করে।

কয়েকমুহূর্ত আমরা থমকে দাঁড়াই। কিন্তু সেটা মুহুর্তের জন্য। শিবিরের ছেলেরা দুইদিকেই ছুটে গেল ইট পাথর মারতে মারতে। অল্প কিছুক্ষণ পরই চাঁদ্গাঁও থানার পুলিশ পালিয়ে গেল। কিন্তু পাঁচলাইশ থানা তাদের ঢালগুলো দিয়ে বাংকারের মত করে সমানে গুলি করতে লাগলো।

টপাটপ ১০-১৫ জন আত্মার ভাই লুটিয়ে পড়লো। আল্লাহর কসম! আমরা এতে ভয় পাইনি। কিছু ভাই আহত ভাইদের নিয়ে হসপিটালে চলে গেলেন। বাকীরা প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছিল। আমরা রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে প্রচুর ইট পাথর মারছিলাম পুলিশের দিকে। আর পুলিশ গুলি করছিলো। এভাবে তাদের ব্যস্ত রেখে ফুটপাথ দিয়ে কিছু জিন্দাদিল ভাই পুলিশের কাছাকাছি হয়ে গিয়েছিল ইট পাথর নিয়ে।

হঠাত এক আওয়াজ শুনতে পেলাম পুলিশের বুলেট শেষ। শুধু ফাঁকা শব্দ করছে। হই হই করে আমরা দৌড়ে গেলাম। পুলিশ ঢাল ফেলে পালাতে শুরু করলো। আমাদের মিছিল মুরাদপুর চলে আসলো। মুরাদপুরে আমাদের মহানগর নেতারা মিছিল সমাপ্ত করে সবাইকে ফিরে যাওয়ার জন্য বলেছিল।

চলে যাওয়ার সময় আবার পাঁচলাইশ থানার পুলিশ আক্রমণ করলো। তৎকালীন বায়েজিদ থানার সভাপতি ভাই (পরে কেন্দ্রীয় নেতা হন) আমাদের ভাইদের সাহায্যে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু মির্যারপুল ব্রিজে একঝাঁক গুলি এসে ভাইকে আক্রমণ করলো। লুটিয়ে পড়লেন ভাই।

পরিস্থিতি খারাপ দেখে আমরা অল্প কিছু মানুষ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলাম "নারায়ে তাকবির"। দিগবিদিক ছুটে চলা ভাইয়েরা সাড়া দিলো আল্লাহু আকবার বলে। আবারো শ'খানেক ভাই একত্র হয়ে গেলাম। পাঁচলাইশ থানা অভিমুখে মিছিল শুরু হলো। আমাদের ঘুরে দাঁড়ানো দেখে পুলিশ পিছু হটলো।

আমরা এর সুযোগ নিলাম। জনশক্তিদের নিরাপদে পার করে দিতে থাকলাম। নিজে নির্মানাধীন কাতালগঞ্জ মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে সবাই ডাক দিয়ে পার করে দিচ্ছিলাম। জনশক্তিদের অধিকাংশ কিং অব চিটাগং পাহাড়ে উঠে গেল।

আমি পুলিশের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। আমার সামনে মসজিদে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। পাঁচলাইশ থানার সাহায্যে চকবাজার ও পুলিশ লাইন্স থেকে প্রচুর পুলিশ এসেছে। আমি মসজিদের অযুখানায় গিয়ে ভালো করে মুখে পানি দিলাম। ঘন্টাখানেকের যুদ্ধে পুরো শরীরে ধুলো মাখামাখি হয়ে গেছে। মুখে পানি দিলাম ও অনেক পানি খেলাম।

এমন সময় পাঁচলাইশ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস আমাকে পেছন থেকে আঘাত করে ও এরেস্ট করে। মাথায় রিভলভার ঠেকিয়ে রাখে। আমি এটাকে সাধারণ এরেস্ট মনে করেছি। কিন্তু সে আমাকে মসজিদ থেকে বের করে পাশে একটা চিপায় নিয়ে যায়। তখন আমি ভেবে নিয়েছি এ মনে হয় আমাকে খুন করবে। কারণ হিংস্রতার ব্যাপারে আমাদের আগেই জানা ছিল।

আমি ইস্তেগফার পড়তে শুরু করলাম। একইসাথে জীবনের সামারি টানতে লাগলাম। যে কয়টা অপরাধের কথা মনে পড়লো তার জন্য ক্ষমা চাইলাম প্রভুর কাছে। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। এর মধ্যে পর পর তিনটে গুলি। সবগুলো ফায়ার আমার মাথার সাথে পিস্তল লাগিয়ে।

আমি তো ভেবেছি আমি মরে গেছি। কিন্তু প্রদীপ আসলে আমাকে গুলি করে নাই। সে লোক সরানোর জন্য এটা করেছে। প্রতিটা বুলেট মনে হয় আমার মাথার এক ইঞ্চি ওপর দিয়ে গেছে। বুলেটের বাতাস আমার চুল ছুঁয়ে গেছে।

এরপর সে পিস্তল মাথা থেকে পায়ে নামিয়ে আনলো। গালি দিয়ে বললো আর মিছিল করবি? তোর মিছিলের *** মেরে দিচ্ছি। সারাজীবন পঙ্গু হয়ে থাকবি। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করছিলাম গুলির। গুলির শব্দ হলো। কিন্তু ব্যাথা পেলাম না। চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি ডান পায়ের উরুতে প্যান্ট ছেঁড়া। গলগল করে রক্ত পড়ছে।

তবে আমি কোনো ব্যাথা পাইনি। আমি ডান পা দিয়ে মাটিতে ঠুকলাম। মনে হয়েছে পায়ের কিছুই হয়নি। সব ঠিক। আমার নির্লিপ্ততা দেখে পেছনে থাকা পুলিশরা প্রদীপকে উদ্দেশ্য করে বললো, স্যার মনে হয় গুলি লাগে নাই। আবার করেন। এবার প্রদীপ সাথে সাথেই বাম পায়ে গুলি করলো। এবার একেবারে আমার চোখের সামনেই। চোখ বন্ধ করার সুযোগ পাইনি। একই পরিস্থতি বাম পায়েও।

তারপর প্রদীপ আমাকে অন্যান্য পুলিশদের হাতে তুলে দেয়। তারা আমাকে আবার মসজিদের সামনে নিয়ে আসে। সেখানে তখন কিছু সাংবাদিক জড়ো হয়ে গেছে। তাদের সামনেই আরো কিছু পুলিশ জড়ো হয়ে গণধোলাই দিতে লাগলো। তারপর তারা টেনে হিঁচড়ে পাঁলাইশ থানায় নিয়ে গেল।

প্রথমে আমাকেই আনা হলো। এরপর একে একে আরো ১০-১২ জন আসলো। পুলিশ আমাদের গোল করে পেটাতে লাগলো। একজন ক্লান্ত হয়ে গেলে আরেকজন। এভাবে চলতে লাগলো। এরমধ্যে আমিসহ তিনজনের অবস্থা ছিল বেগতিক। পুরো থানার মেঝে ভেসে গিয়েছে আমাদের রক্তে। আমার শরীর অস্বাভাবিকভাবে ফুলে গেছে।

অবশেষে পুলিশরা ভাবলো আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। একটা টেম্পোতে দুইজন মারাত্মক আহত ভাইকে তোলা হলো। আমাকে বার বার বললো উঠতে। কিন্তু আমি দেখলাম আমি উঠবো কি! পা নাড়াতেই পারিনা। তারপর উঠছিনা দেখে একজন জোরে আঘাত করে। আমি ভেলার মতো টাইলস করা কক্ষের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পিছলিয়ে চলে গেলাম।

তখন তারা বুঝেছে, আমার ওঠার সামর্থ নেই। অবশেষে তারা আমাকে টেনে টেম্পুর মেঝেতে শুইয়ে দিল। কাছেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। দশমিনিটের মধ্যেই হসপিটালে পৌঁছে গেলাম। আল্লাহ তায়ালা আমাকে আবার বাঁচিয়ে তুললেন। আরো প্রবলভাবে। আরো শক্তিশালীভাবে। আমি মনে করি এই অতিরিক্ত লাইফ নিয়ে চলা আমাকে এই পৃথিবীর জন্য কিছু কাজ অবশ্যই করতে হবে। নইলে বোনাস লাইফের কী ফায়দা!

সেদিন আমাদের প্রায় ৫০-৬০ জন ভাই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আহত হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু এরেস্ট হয়েছেন সে তুলনায় অনেক কম। মাত্র ১৮ জন। আমি সেদিন আমাদের ভাইদের ঈমান দেখেছি। এক ভাইয়ের প্রতি অন্য ভাইয়ের প্রবল মমত্ববোধ ও ভালোবাসা দেখেছি। আমি সেদিন আল্লাহর সাহায্য দেখেছি। আল্লাহর গোলামদের প্রতি আল্লাহর মহব্বত দেখেছি।

আজ ৫ ফেব্রুয়ারি। ৮ বছর আগে এই দিনে ২০১৩ সালের ঘটনা এটা। সেদিন ঢাকায় শাহবাগ আন্দোলন তৈরি হয়েছে। তাদের ঠেকাতে আবার হেফাযত তৈরি হয়েছে। দুইটা খুব পপুলার আন্দোলন তৈরি ও খতম হয়েছে। মাঝখানে জামায়াত বাইরের চাপ ও আভ্যন্তরীণ চাপ হজম করে বহাল তবিয়তে আছে আলহামদুলিল্লাহ।

চোখের সামনে শত শত ঘটনা পার হয়ে গেছে। যদিও প্রত্যক্ষদর্শী অনেক ঘটনার মূল কারণ জানতে আরো অপেক্ষা করতে হবে। প্রত্যক্ষদর্শী হলেই যে আদ্যোপান্ত জানা যায় তা কিন্তু না।

৮ বছর আগে এই দিনে সকালে ফেবারিট খিচুড়ি খেয়েছি। আজও খিচুড়ি খেলাম আলহামদুলিল্লাহ। ঐদিন সালাম ভাই রান্না করেছিলেন। আজ আমি নিজেই প্রস্তুত করেছি। আজ একটা আয়েশি ছুটি কাটানোর ইচ্ছে, ইনশাআল্লাহ। দুইটা অনলাইন মিটিং আছে। শুয়ে শুয়ে সেগুলোতে এটেইন করছি।

অন্যদিকে আজকে প্রদীপের কী খবর? সেও কি আজ খিচুড়ি খাবে? আমরা চট্টগ্রাম কারাগারে মাঝেমধ্যে খিচুড়ি খেতাম শুক্রবারে। প্রদীপ কি আজ খিচুড়ি পাবে? কে জানে!

সে কারাগারে আর আমি বাইরে। অথচ হাসিনার মাফিয়া সরকার এখনো ক্ষমতায়! কত কিছু সাক্ষী হয়ে যাচ্ছি!

পঠিত : ৩৩০ বার

মন্তব্য: ০