Alapon

বিয়ে ও ডিমান্ড




এই মেয়ে এক্সট্রিমলি হ্যান্ডসাম সুদর্শন সু-ছেলেও চায়, চায় টাকা এবং শিক্ষাও। আবার দ্বীনদারিতাও ! কী অদ্ভুত !! মেয়েটা আসোলে ভণ্ড। মুখোশধারী। উপরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট টাইপের মেয়ে! আসোলে মাইয়্যার জাত-ই খারাপ।

ছেলেটার গায়ে আগাগোড়া একটা জোব্বা। গালভরা দাড়ি। দ্বীন-ধর্মের স্ট্যাটাসে ফেসবুক সয়লাবও করে রাখে। কিন্তু তবুও তার সে-কি ডিমান্ড বিয়ের ক্ষেত্রে। মেয়ে অল্প বয়স্কা কচি হতে হবে। দেখতে সুদর্শন হতে হবে। ভালো ফিগার, স্লিম, ধবধবে ফর্সাত্বকওয়ালা হতে হবে। উঁচা-লম্বাও চায়। চায় শিক্ষা- পরহেজগারিতাও— একেবারে সবই চায়!
এতো কিছু একসাথে খোঁজে আবার ফেসবুকে, ময়দানে সুন্দর সুন্দর ইসলামি কথাও বলে, তালিম-তালক্বীন এবং তাবলীগ করেও বেড়ায় হরহামেশা! আসোলে এরা ভণ্ড। লেবাসধারী, মুখোশধারী। এদের বাস্তব জীবনে কথিত দ্বীনদারিতার ছিটেফোঁটাও নেই। বিয়ের ক্ষেত্রে এদের এতো এতো ডিমান্ড থাকবে কেন, হুম !! আসোলে পুরুষজাত বলে কথা! এদের নারীর রূপ-যৌবন দিয়ে নিজ নয়ন শীতল করাই লাগবে! এত্তো এত্তো লোভী এরা.....

এই যে উপরের বাক্যগুলো, এগুলো আমরা প্রায়শই শুনে থাকি। আমাদের আশপাশের অনেক লোক এই সব অভিধায় অভিযুক্ত করে আমাদের যে ভাই-বোনেরা বিয়ের ক্ষেত্রে এইসব ডিমান্ড রাখে, এবং এইসব ডিমান্ডের আলোকে পাত্র-পাত্রী খোঁজে তাদের।
আচ্ছা এই যে ডিমান্ডগুলো , এসব কারো থাকলে কি তার দ্বীনদারিতা-পরহেজগারিতা উচ্ছনে যাবে ? এসবের সাথে কি দ্বীনের কোনো কন্ট্রাডিকশন আছে নাকি ? নাহ, কখখনোই নেই! আল্লাহর রাসুল সল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন চারটি জিনিষ দেখে বিয়ে করতে । এর মধ্যে সবচে বেশি প্রাধান্য দিতে বলেছে দ্বীনদারিতাকে ।

মানে হোলো বিয়ে তো কোনো ঠুনকো ব্যপার নয়। এটা একসাথে একছাদে দুজন মানুষ সুখে-দুখে কাটিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি। জীবন সংগ্রামে একে অন্যকে সঙ্গ দেবার সুদৃঢ় এক প্রতিজ্ঞা। দুটো পরিবার, দুটো সমাযেরও সুন্দর এক বন্ধন হচ্ছে এই বিয়ে। তাই এখানে সবকিছুই আমাদের মন মতো হবে না । আমাদেরকে কিছু না কিছু কন্সিডার করতেই হবে , সেই কন্সিডার যেনো দ্বীনদারিতার সাথে না হয়, ঈমান-আমলের সাথে না হয় —আল্লাহর রাসুলের নির্দেশনা হোলো এই । কিন্তু কেউ সৌন্দর্য, অর্থকড়ি — এসব চাইলেই যে সে মহা অন্যায় করে ফেলবে বা হয়ে যাবে , বিষয়টা এমনও নয়। এসব তো আল্লাহর রাসুল-ই বিয়ের ক্ষেত্রে দেখতে নির্দেশনা দিয়েছেন। এসব তো মানুষের জন্যেই প্রয়োজনই ।

সুনানে আবু দাউদের একটা হাদিস আছে , প্রখ্যাত সাহাবি মাকাল বিন ইয়াসার (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন —তোমরা বিবাহ করো প্রেমময়ী ও অধিক সন্তান প্রসবিনী নারীকে। কেননা আমি তোমাদের (সংখ্যাধিক্যের দ্বারা ) অন্যান্য উম্মতের উপর গর্ব করবো। এই যে হাদিসটি , এর নির্দেশনাগুলো যে শুধুই ছেলেদের জন্যে — বিষয়টা মোটেও তেমন না । তো যাই হোক , এই হাদিস থেকে দুটো বিষয় আমরা জানতে পারি। (১) বিবাহ করার জন্য এমন পার্টনার অনুসন্ধান করা মুস্তাহাব , যার মাঝে মায়া-মমতা আছে , ভালোবাসার যোগ্যতা রয়েছে যার। যে হৃদয়-মনের সবটুকু উজাড় করে ভালবাসতে পা্রে। (২) ঐ মহিলাকে প্রাধান্য দেয়া উচিত, যার বংশে বেশি বেশি সন্তান হওয়ার ধারাবহিকতা রয়েছে। এরকম আরেকটা হাদিস আছে , যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন; তোমাদের উপর কুমারী রমণীদের বিবাহ করা অপিরিহার্য। (অর্থাৎ তোমরা কুমারী মেয়ে বিবাহ করো )। কেননা তাদের মুখ খুব মিষ্ট (অর্থাৎ মিষ্ট মিষ্ট কথা বলে) তাদের গর্ভাশয় অধিক গর্ভধারিণী। অর্থাৎ সন্তান বেশি বেশি হয় এবং তারা অল্পতে সন্তুষ্ট থাকে।

এখন কথা হোলো হাদিসের আলোকেই কিন্তু বিয়েতে দৈহিক সৌন্দর্যের বিষয়টি কোনো তুচ্ছ বা গৌণ বিষয় নয়। তবে এটা ঠিক — রূপ-সম্পদ-সৌন্দর্যের যে অবস্থান , তা কখখনোই দ্বীনদারি-সতীত্ব-কুমারিত্বের যে অবস্থান তা থেকে বেশি নয় ; তবে বিয়ের ক্ষেত্রে, জীবন সঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা পুরোপুরি-ই প্রাসঙ্গিক একটা বিষয়। এটা মোটেও গুরুত্বহীন বা হালকা কোনো বিষয় নয়। কারণ যাকে নিয়ে সারাজীবন একসাথে কাটিয়ে দেবার ইচ্ছেতে যুগলবন্দী হবে, তাকে তো অনুভব করতে হবে । ভালোবাসা দেয়ার মতো মন সৃষ্টি হতে হবে । তাই না ?

তবে অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় আল্লাহর রাসুল স্বল্লালাহু আলাইহিস সালাম দ্বীনদারিতাকে প্রাধান্য দিতে বলেছেন , এবং সেই বিষয়টাতেই অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন । রাসুল্লাহ স্বল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যদি স্রেফ রূপের পাগল হয়েই বিয়ে করো , তাহলে হতেও পারে যে সে রূপই তাঁর ও তোমার ধংসের কারণ হবে । আসোলেই এর বাস্তব নজির আমাদের আশেপাশে বহুই আছে। যাদের ভেতর দ্বীনের বুঝ থাকে না , তারা এই রূপ দিয়েই কি ভয়ানক কিসিমের খেলই না খেলে । নিজের এবং পাওর্টনারের জীবনটাকেও কী ভীষণ রকম দুর্বিষহ করে তোলে । তাই তো একজন সম্পদশালী স্বাধীন স্বামী/স্ত্রীর চাইতে দ্বীনদার কালো-কুতসিত দাস/দাসী-ই জীবন সঙ্গী হিসেবে অধিক ভালো। প্রিয় নবিজি কথাগুলো বলেন ইবনে মাজাহ’র এক হাদিসে— তোমরা নারীদের (কেবল) রূপ দেখে বিবাহ করো না। অসম্ভব নয় রূপই তাদের বরবাদ করে দেবে। তাদের অর্থ-সম্পদ দেখেও বিবাহ করো না। হতে পারে অর্থ-সম্পদ তাকে উদ্ধত করে তুলবে। বরং দ্বীন দেখেই তাদের বিবাহ করো। একজন নাক-কান কাটা কালো দাসীও (রূপসী ধনবতী স্বাধীন নারী অপেক্ষা) শ্রেয়, যদি সে দ্বীনদার হয়। তাই শুধু জাঁকালো রুপ দেখেই যদি কেউ বিয়ে করে তবে আল্লাহর রাসুল সে বিষয়ে বলেছেন যে , নিশ্চয়ই সেটা তোমাদের জন্য মন্দ ও অকল্যান ডেকে আনবে।

মুসলিম শরীফের আরেকটি হাদিসে , রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন— গোটা দুনিয়াই হলো সম্পদ, আর দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো নেককার স্ত্রী। আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত অন্য আরেক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন— যখন তোমাদের নিকট এমন লোক বিবাহের প্রস্তাব দেয়, যার দ্বীনদারি ও চরিত্র তোমাদের পছন্দনীয়। তখন বিবাহ দিয়ে দিও । যদি তা না করো তবে ফিৎনা ও ব্যাপক ফাসাদ দেখা দিবে। এই হাদিসের আলোকে বলা যায় যে , মানুষের দ্বীনদারি ও আখলাক দেখে যখন বিয়ে না দেয়া হবে; বরং তার অর্থ- সম্পদ কেমন আছে, সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তি কেমন আছে —এসব দেখতে যাওয়া হবে তখন সংগত কারণেই অধিকংশ সময় সমাজে চরম অসংতি দেখা যাবে । যায়ও।

আচ্ছা, আমরা এইসব আলোচনা থেকে যা বলতে বা দেখাতে চেয়েছি, তা হলো এই — কেউ যদি একসাথে সবই চায় , তা হলে চাইতে পারে । এটা শরীয়াহ বিরোধী নয় । বরং হাদিস সম্মত-ই । তবে সকলের জন্যেই— নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ইসলামের নির্দেশনা হোলো আল্লাহ ভিরুতা-দ্বীনদারিতাকেই প্রাধান্য দেয়া । বাকীগুলো চলনসই হলেই সম্পর্কের ভিত্তিস্থাপন করা উচিত। তবুও সকলের চিন্তাধারা, চাওয়া-পাওয়া, পছন্দ-অপছন্দ এক নয়। ভালোলাগা-ভালোবাসার মাপকাঠিও এক নয় । তাই যার যা ভালো লাগে , যেমন পছন্দ সে তেমনই করবে ও খুঁজবে।

এখন কেউ যদি পৃথিবীর সব চাহিদা আর চাওয়া-পাওয়াগুলোকে উপেক্ষা করে শুধুই দ্বীনদারিতা দেখেই বিয়ে করে তা হলে তিনি তা করতে পারে। শুধু দ্বীন-ইমান, আমল-আখলাক দেখেই যে বা যাঁরা বিয়ে করবেন বা বসবেন— তিনি বা তাঁরা এর জন্যে অবশ্যই আল্লাহর কাছে জাযা বা পাবেন । দ্বীনের মহিমান্বিত বুঝ যাদের নিকট আছেন তাদের নিকট পাবেন বাহবাও। কারণ তিনি একজন মানুষকে জীবন সাথি বানাবার সময় জাগতিক সব বিষয়-ই উপেখ্যা করেছেন —এটা চাট্টিখানি কথা নয়। এর জন্যে যেই দৃঢ় ঈমান-ইয়াকিন ও বুকেরপাটা দরকার এর সবটাই তাঁর আছে।কিন্তু তাই বলে যারা দ্বীনদারিতাসহ অন্যান্য বিষয়াদিও বিবেচনায় নিয়ে পাত্র/পাত্রী খোঁজে বা চায় ,সে-জন্যে আপনি আমি ওনাদেরকে মুখোশধারী , লেবাসধারী ভণ্ড ,কথিত দ্বীনদার ইত্যাদি বলে সমালোচনা করতে পারি না ,এবং পারেন না তাঁর বা তাদের জাত-পাত তুলে বকাঝাকাও করতে। কারণ, এসব চাহিদা দ্বীন বহিঃর্ভূত নয় , সোজা হিসেব । এটাও নিষ্ঠুর এক সত্য যে, ছেলেপিলে প্রেম করে, সেই প্রেমের ক্ষেত্রে এতোটা ডিমান্ড নেই, যতোটা ডিমান্ড বিয়ের ক্ষেত্রে। সেটা ভিন্ন এক হিসেব। এই নিয়ে অনেকেই কথা বলে!

‘বিয়ে ও ডিমান্ড’
~রেদওয়ান রাওয়াহা
০৬.০৩.২১

(লেখাটি কপি করার অনুমতি নেই। আল্লাহ ভীরু হলে মাথায় রাখবেন, তবে ব্লগের লিংক শেয়ার করতে পারেন)

পঠিত : ৭৩১ বার

মন্তব্য: ১

২০২১-০৩-০৭ ১১:৪২

User
তেপান্তর

মাশাল্লাহ ভাইয়া

submit