Alapon

ইসলামে দায়ির গুণাবলী



একবার মক্কায় আকাল দেখা দিল। কুরাইশদের তখন ঘোর দুর্দিন। মুহাম্মদ সা. তখন যুবক। আকালের মধ্যে তাঁর চাচা আবু তালিব নিদারুণ আর্থিক সংকটে ছিলেন। মুহাম্মদ সা. আরেক চাচা আব্বাস। তিনি ছিলেন বনু হাশিম গোত্রের মধ্যে সচ্ছলতম ব্যক্তি। তাঁকে মুহাম্মদ সা. বললেন,

“চাচা! আপনার ভাই আবু তালিব অধিক সন্তানের ভারে জর্জরিত। দেখতেই পাচ্ছেন মানুষটি কী ভীষণ দুর্দশায় ভুগছে। আসুন, আমরা তাঁর সন্তান ভার লাঘব করি। তাঁর পুত্রদের মধ্য হতে একজনের দায়-দয়িত্ব আমি গ্রহণ করি আর অপর একজনের দায়িত্ব আপনি গ্রহণ করুন। এভাবে দু’টি সন্তানের দায়-দায়িত্ব থেকে তাঁকে রেহাই দেয়া যাবে।”

আব্বাস বললেন, “ঠিক আছে, চলো যাই।”

অতঃপর তাঁরা উভয়ে গিয়ে আবু তালিবকে বললেন, “যতদিন মক্কা আকাল থেকে মুক্ত হচ্ছে না ততদিনের জন্য আমরা আপনার সন্তানদের ভার লাঘব করতে চাই।” আবু তালিব বললেন, “তোমরা আকীলকে আমার কাছে রেখে যাও। আকিল ছিলেন ওনার ২য় ছেলে ও খুব প্রিয়। তারপর যাকে খুশী নিয়ে যাও।”

অতঃপর মুহাম্মদ সা. আলী রা.-কে নিলেন এবং তাঁকে নিজ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করলেন। আর আব্বাস রা. নিলেন জাফর রা.-কে এবং তাঁকে তিনি স্বীয় পরিবারের অন্তর্ভুক্ত করলেন। সেই যে আলী রা. মুহাম্মদ সা.-এর কাছে এলেন আর কখনোই পিতার পরিবারে ফেরত যাননি। রাসূল সা. তাঁকে এতোটাই স্নেহ করেছেন যে, আলী রা. মুহাম্মদ সা. থেকে আলাদা হওয়ার কথা ভাবতে পারতেন না।

এই ঘটনা রাসূল সা.-এর নবুয়্যত পাওয়ার আগের ঘটনা। এরপর আলী রা. রাসূলুল্লাহ সা.-এর নবুয়্যত প্রাপ্তির সময় পর্যন্ত তাঁর কাছেই ছিলেন। মুহাম্মদ সা. থেকে ইসলামের দাওয়াত পেয়ে বিনা দ্বিধায় আলী রা. তাঁর ওপর ঈমান আনলেন ও তাঁকে নবী হিসেবে মনে-প্রাণে মেনে নিয়ে তাঁর অনুসরন করতে লাগলেন।

নবুয়্যত পাওয়ার আগের আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। জায়েদের বয়স তখন মাত্র আট বছর। ডাকাতরা তাকে নজদ থেকে নিয়ে এসে মক্কায় বিক্রি করে দিল দাস হিসেবে। জায়েদসহ আরো কিছু দাস কিনে নিল মক্কার ব্যবসায়ি হাকিম। হাকিম তার কেনা দাসগুলোকে নিয়ে এলো ফুফু খাদিজার কাছে। এসে বললেন, আপনার জন্য হাদিয়া এনেছি ফুফু। এখান থেকে একজন দাসকে আপনি বেছে নিন।

এই খাদিজা আর কেউ নন। আমাদের আম্মাজান হযরত খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ রা.। হযরত খাদিজা রা. দাসগুলির চেহারা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করার পর জায়েদকে বাছাই করলেন। তিনি জায়েদের চেহারায় তীক্ষ্ণ মেধা ও বুদ্ধির ছাপ দেখতে পেয়েছিলেন। এ ঘটনার কিছুদিন পর মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ সা.-এর সাথে খাদিজা রা.-এর বিয়ে হয়। তিনি স্বামীকে কিছু উপহার দেওয়ার ইচ্ছা করলেন। বুদ্ধিমান জায়েদ ছিল সেই অসাধারণ উপহার। জায়েদকে তিনি স্বামীর হাতে তুলে দিলেন আর জায়েদকে বললেন যেন মুহাম্মদ সা.-এর খিদমত করে।

এ সৌভাগ্যবান বালক জায়েদ মুহাম্মাদ সা.-এর তত্ত্বাবধানে বড় হতে লাগলেন। এদিকে তার মা পুত্রশোকে অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। নানান স্থানে তিনি জায়েদের খোঁজ করতে লাগলেন। কিন্তু কোথাও জায়েদের পাত্তা পাওয়া গেল না। কয়েকবছর পর হজ্জের সময় জায়েদের গোত্রের কিছু লোক হজ্জ করতে মক্কায় এলো। কাবার চতুর্দিকে তাওয়াফ করার সময় তারা জায়েদের মুখোমুখি হলো। তারা পরস্পর পরস্পরকে চিনতে পেরে কুশল বিনিময় করলো। সেই লোকগুলি হজ্জ শেষে জায়েদের পিতা হারিসাকে তার হারানো ছেলের সন্ধান দিল।

ছেলের সন্ধান পেয়ে হারিসা ও তার ভাই মক্কায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেন। জায়েদকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য অর্থসামগ্রীও নিলেন সাথে। তারা মক্কার পথে বিরামহীন চলার পর মুহাম্মাদ সা.-এর কাছে পৌঁছলেন এবং বললেন, ‘ওহে আবদুল মুত্তালিবের বংশধর! আপনারা আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশী। অসহায়ের সাহায্যকারী, ক্ষুধার্তকে অন্নদানকারী ও আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয় দানকারী। আপনার কাছে আমাদের যে ছেলেটি আছে তার ব্যাপারে আমরা এসেছি। তার মুক্তিপণও সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করুন এবং আপনার ইচ্ছামত তার মুক্তিপণ নির্ধারণ করুন।’

এটা সেসময়ের কথা যখন মহাম্মদ সা. নবুয়্যত লাভ করেন নি। তাঁর আচার ব্যবহার, আমানতদারীতা ও বুদ্ধিমত্তায় পুরো মক্কাবাসী তার সম্মান করে। যাই হোক মুহাম্মাদ সা. তাদের কথা শুনে বললেন,

- আপনারা কোন ছেলের কথা বলছেন?

– আপনার দাস যায়িদ ইবন হারিসা।

– মুক্তিপণের চেয়ে উত্তম কিছু আপনাদের জন্য নির্ধারণ করি, তা-কি আপনারা চান?

– সেটা কী?

– আমি তাকে আপনাদের সামনে ডাকছি। স্বেচ্ছায় সে নির্ধারণ করুক, আমার সাথে থাকবে, না আপনাদের সাথে যাবে, যদি আপনাদের সাথে যেতে চায়, মুক্তিপণ ছাড়া তাকে নিয়ে যাবেন। আর আমার সাথে থাকতে চাইলে আমার কিছু করার নেই। সে অবশ্যই আমার সাথে থাকবে।

তারা অত্যন্ত খুশি হয়ে বললো, আপনি অত্যন্ত ন্যায় বিচারের কথা বলেছেন। মুহাম্মাদ সা. জায়েদকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন,

- এ দু’ব্যক্তি কারা?

- ইনি আমার পিতা হারিসা ইবনে শুরাহবিল। আর উনি আমার চাচা কা’ব।

- তুমি ইচ্ছা করলে তাদের সাথে যেতে পারো, আর ইচ্ছা করলে আমার সাথেও থেকে যেতে পার।

- (কোনো রকম ইতস্তত না করেই সঙ্গে সঙ্গে) আমি আপনার সাথেই থাকবো।

হারিসা ইবনে শুরাহবিল বললেন,

- জায়েদ, তোমার সর্বনাশ হোক! পিতা-মাতাকে ছেড়ে তুমি দাসত্ব বেছে নিলে?

- এ ব্যক্তির মাঝে আমি এমন কিছু দেখেছি, যাতে আমি কখনও তাকে ছেড়ে যেতে পারবোনা।

জায়েদের এ সিদ্ধান্তের পর মুহাম্মাদ সা. তার হাত ধরে কাবার কাছে নিয়ে আসেন এবং হাজরে আসওয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে উপস্থিত কুরাইশদের লক্ষ্য করে ঘোষণা করেন, ‘ওহে কুরাইশরা! তোমরা সাক্ষী থাকো, আজ থেকে জায়েদ আমার ছেলে। সে হবে আমার এবং আমি হবো তার উত্তরাধিকারী।

এ ঘোষণায় যায়েদের বাবা-চাচা খুব খুশি হলেন। তারা জায়েদকে মুহাম্মাদ সা.-এর নিকট রেখে প্রশান্ত চিত্তে দেশে ফিরে গেলেন।

এ ঘটনার কয়েক বছর পর মুহাম্মাদ সা. নবুয়্যত লাভ করেন। জায়েদ রা. হলেন পুরুষ দাসদের মধ্যে প্রথম মুসলিম। পরবর্তীকালে তিনি হলেন রাসূলুল্লাহর সা. বিশ্বাসভাজন সেনাবাহিনীর কমাণ্ডার এবং তার অনুপস্থিতিতে মদিনার অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক।

আরেকটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। রাসূল সা. যখন নবুয়্যত প্রাপ্ত হলেন তখন তিনি বেশ ঘাবড়ে গেলেন। বাসায় এসে খাদিজা রা.-কে বললেন, আমার কী হলো? আমি আমার নিজেকে নিয়ে শংকা বোধ করছি। তখন খাদিজা রা. একটি দারুণ কথা বললেন। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! কখনোই নয়। আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়–স্বজনের সঙ্গে সদাচরণ করেন, অসহায় দুস্থদের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সহযোগিতা করেন, মেহমানের আপ্যায়ন করেন এবং হক পথের দুর্দশাগ্রস্থকে সাহায্য করেন।

আমি মনে এই পরিবারের সদস্যদের সাথে ঘটা এই তিনটি ঘটনার মধ্য দিয়ে আমরা আল্লাহর রাসূল সা.-এর নবুয়্যতপূর্ব জীবনের চরিত্র সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা পাই। আল্লাহ তায়ালা নবী সা.-কে ইকামাতে দ্বীনের কাজের জন্য বাছাই করেছেন। তাই তাঁর মধ্যে এই গুণগুলোর সমন্বয় করেছেন। মুহাম্মদ সা. মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। একজন দায়ি হিসেবে এই গুণ থাকা আবশ্যক।

এখানে এটাই আমাদের জন্য শিক্ষা। তাবলীগের কাজ করার জন্য, মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার জন্য আল্লাহর রাসূলের এই গুণগুলো আমাদের অর্জন করতে হবে। তাতে আমাদের দাওয়াত ফলপ্রসূ হবে। আল্লাহর রাসূলের দাওয়াত তাঁর পরিবারের সদস্যরা বিনা দ্বিধায় কবুল করেছেন কারণ তারা মুহাম্মদ সা.-এর গুণ সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। এছাড়া আল্লাহর রাসূল সা. মিষ্টভাষী ছিলেন, ক্ষমা করতেন, ধৈর্য ধারণ করতেন, হুটহাট রাগান্বিত হতেন না, কারো সাথে কর্কশভাষায় কথা বলতেন না, সাহসী ছিলেন, সবার সাথে ইনসাফ করতেন, লজ্জাশীল ছিলেন, কারো সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হতেন না, আমানতদার ছিলেন। সবাই তাঁকে আল আমিন বা বিশ্বাসী বলে ডাকতেন।

আমরা যদি বিশ্বাসী না হই, আমরা যদি লেনদেনে আমানতদার না হই, আমরা যদি মানুষের অধিকার না দিই, মানুষের সাথে কর্কশ আচরণ করি, ইনসাফ না করি তবে আমাদের দাওয়াতে মানুষ ইসলামের দিকে আসবে না। একজন দায়ি হিসেবে ও ইকামাতে দ্বীনের কর্মী হিসেবে আমাদের অবশ্যই মানুষের কাছে প্রিয় ও আমানতদার হতে হবে।

পঠিত : ৪৮৫ বার

মন্তব্য: ০