Alapon

ইদলিব অভিযান: তুরস্কের হিসাব-নিকাশ

ইদলিব। আলেপ্পোর পরে উত্তর সিরিয়ার সবচেয়ে বড় শহর। আলেপ্পোর দক্ষিন পশ্চিম কোনে এর অবস্থান। এর দূরত্ব যথাক্রমে আলেপ্পো থেকে ৬০ কিলোমিটার, লাজিকিয়া থেকে ১৩২ কিলোমিটার, দামেস্ক থেকে ৩৩০ কিলোমিটার, হোমস থেকে ১৬০ কিলোমিটার এবং হামা থেকে ১০৫ কিলোমিটার। ইদলিব সেসব শহরের মধ্যে অন্যতম যেগুলো বিপ্লবের শুরুর দিকেই সরকারী বাহিনীর দখলমুক্ত হয় এবং এখনও পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বিপ্লবী গ্রুপের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। সেখানে বেশ কয়েকটি বিপ্লবী উপদল সক্রিয়। তবে এগুলোর মধ্যে “হাইআতু তাহরীরিশশাম” বা “জাবহাতুন নুসরাহ” সর্বাধিক শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত। সংগঠনটির সাথে আল কায়দা কানেকশনের কারণে আন্তর্জাতিক মহল এটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে ঘোষণা করে। পরে নাম পরিবর্তন করেও কোন কাজ হয়নি। আগের মতোই এর সন্ত্রাসী পরিচয় অব্যাহত থাকে।


আস্তানা সম্মেলন শুরু হওয়ার পর থেকেই ইদলিব নিয়ে বেশ দরকষাকষি চলে আসতেছিল। শেষপর্যন্ত তুরস্কের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে শহরটি সংঘাতমুক্ত এলাকার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং ১৪ ই সেপ্টেম্বরে আস্তানা সম্মেলন-৬ এ গৃহীত সিদ্ধান্তের অংশ হিসেবে এর উপর তুরস্কের নিয়ন্ত্রণাধিকার স্বীকার করে নেয়া হয়। ২৮ শে সেপ্টেম্বর আঙ্কারায় পুতিন-এরদোগান বৈঠকে এই চুক্তির চূড়ান্ত রূপ দেয়া হয়। চুক্তির অংশ হিসেবে ইদলিবের পাশাপাশি এর পার্শ্ববর্তী সীমান্ত শহরগুলোর বেশ কিছু এলাকাও সংঘাতমুক্ত এলাকার আওতায় আসবে এবং তুরস্কের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এগুলো হচ্ছে, আলেপ্পো, লাজিকিয়া এবং হামা। গোটা অঞ্চলটির সম্মিলিত পরিধি হবে প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার, যা আয়তনে লেবাননের সমান হবে।


চুক্তির চূড়ান্ত ঘোষণা দেয়া হয় ১৪ ই সেপ্টেম্বর আস্তানা সম্মেলন-৬ এ। তারপর থেকে তুরস্ক পর্যায়ক্রমে সিরিয়া সীমান্তে ট্যাঙ্কসহ ভারী যুদ্ধ সরঞ্জাম জড়ো করতে থাকে। ১২ ই অক্টোবর তুর্কি সেনাবাহিনীর প্রথম অগ্রবর্তী দলটি ইদলিবে প্রবেশ করে। অর্থাৎ চুক্তি ঘোষণারও প্রায় এক মাস পরে তুরস্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ইদলিবে প্রবেশ করে।


কিন্তু, ইদলিবে ঢুকতে তুরস্ক কেন এতো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে?


এতো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার বড় একটি কারণ আছে। বর্তমানে ইদলিব নিয়ন্ত্রণ করছে ‘হাইয়াতু তাহরীরিশ শাম’ এবং এটিকে আল কায়দার অংশ মনে করা হয়। রাশিয়া এবং আসাদের বার বার অভিযোগ ছিল তুরস্ক গোপনে আইএস এবং নুসরাহকে সহযোগিতা করছে। তাই তারা মূলত ইদলিবকে তুরস্কের ভাগে দিয়ে দেশটিকে নুসরাহ’র মুখোমুখি দাঁড় করে দিতে চেয়েছিল। সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়ালিদ আল মুয়াল্লিম তো স্পষ্ট করেই বলেছে যে, “এবার তুরস্কের পরীক্ষা হবে। তারা কি সন্ত্রাসীদের সহযোগী, নাকি সন্ত্রাসবিরোধী শক্তির অংশ?”


তাদের নিশ্চিত ধারণা ছিল যে নুসরাহ ইদলিবে তুরস্কের প্রবেশ মেনে নিবে না এবং তুর্কি অভিযান রুখে দেয়ার জন্য তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। এভাবে তুরস্ক এবং নুসরাহ দুই পক্ষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখী স্বীকার করা সম্ভব হবে। তাদের চক্রান্ত প্রায় সফল হতে যাচ্ছিলো। আস্তানা-৬ এর ঘোষণা আসার সাথে সাথে নুসরাহ ঘোষণা দেয় যে, তারা ইদলিবে যেকোনো শক্তির প্রবেশ সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করবে। ইঙ্গিত ছিল স্পষ্টভাবেই তুরস্কের দিকে।


যদি বাস্তবেই তুরস্ক এবং নুসরাহর মধ্যে সংঘাত শুরু হতো তাহলে তার পরিণতি হতো কল্পনাতীত ভয়াভহ। তার কারণ দুটি-


১. নুসরাহ খুবই সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী একটি যোদ্ধাদল। অতীতে তারা সাহস এবং আত্মত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে। চতুর্মুখী হামলা সত্ত্বেও তারা ৫/৬ বছর ধরে ইদলিবের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পেরেছে। এ থেকেই তাদের শক্তি পরিমাপ করা যায়। এমন একটি দলের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়ানোর মুল্য অত্যন্ত চড়া হবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।


২. ইদলিব সিরিয়ার অন্যান্য এলাকা থেকে ভিন্ন। এখানে তুলনামূলক মরুভূমির সংখ্যা কম; বরং অধিকাংশ জায়গায় ঘন জঙ্গল এবং ঝোপঝাড় আছে। এজন্য এই জেলাকে সিরিয়ানরা ‘ইদলিব আল খাদরা’ (সবুজ ইদলিব) বলে। এই এলাকার পাহাড়গুলোও বেশ দুর্গম। সব মিলিয়ে ভউগলিকভাবে গেরিলা যুদ্ধের জন্য পারফেক্ট একটি এলাকা। এজন্য বিশেষজ্ঞরা ইদলিবকে ইয়েমেনের সাথে তুলনা করে থাকে। বলা হয়ে থাকে যে, যেকোনো বহিরশক্তি ইয়েমেনে প্রবেশ করেছে তাদেরকে চরম মুল্য দিতে হয়েছে। গোটা আরব জয় করতে উসমানীয়দের তত বেগ পেতে হয়নি, যতোটা শক্তি তাদেরকে ইয়েমেনের পেছনে ব্যায় করতে হয়েছে। ১৯৬২ সালে মিসরের জামাল আব্দুন নাসেরের সেনাবাহিনী ইয়েমেনে প্রবেশ করে এবং ১৫ হাজারেরও বেশী সৈনিকের প্রানের বিনিময়েও চূড়ান্ত বিজয় লাভ করতে পারে নি। আর এখন তো সৌদি আরবের নেতৃত্বে আরব মিত্রদেশগুলোর ইয়েমেন আগ্রাসনের পরিণতি সবার সামনে আছে। ৩ বছরেও তারা একটি মিলিশিয়া দলকে পরাজিত করে সানায় ঢুকতে পারেনি।


তো এই পরিস্থিতিতে যদি নুসরাহর সাথে তুরস্কের সংঘাত শুরু হতো তাহলে তার ধকল কাটিয়ে উঠা তুরস্কের জন্য অসম্ভব হতো। সিরিয়ার একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা তো বলেই দিয়েছে যে, “ইদলিবকে আমরা তুরস্কের জন্য লেলিনগ্রাদ বানাতে চাই।” ২য় বিশ্বযুদ্ধে যেমন জার্মানরা লেলিনগ্রাদের গর্ত থেকে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি, তেমনিভাবে ইদলিবকেও তারা তুরস্কের জন্য মরণ-ফাঁদ বানানোর স্বপ্ন দেখছিল।


প্রতিপক্ষের এসব হিসাব নিকাশ এবং নুসরাহর হুমকির ভয়াবহতা তুরস্কের মোটেও অজানা ছিল না। তাই দেশটি একদিকে ইদলিব সীমান্তে সৈন্যসমাবেশ করতে থাকে অন্য দিকে তুর্কি গোয়েন্দারা ইদলিবের ভেতরে আরেক কঠিন মিশনে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। তাদের মিশন ছিল তুরস্কের অভিযানের প্রতি নুসরাহর সম্মতি আদায় করা। আর এজন্য গোয়েন্দারা নুসরাহর মধ্যে ফাটল ধরানোর কৌশল নিয়ে আগায়। দীর্ঘ এক মাসের প্রচেষ্টার পর তাদের মিশন সফল হয়। নুসরাহর মধ্যে দুটি অংশ আছে। একটি সিরিয়ান যোদ্ধাদের অংশ এবং আরেকটি বিদেশী যোদ্ধাদের অংশ। প্রথম অংশটি তুরস্কের ব্যাপারে আগে থেকেই নমনীয় ছিল। এই সুযোগে তুর্কি গোয়েন্দারা তাদেরকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, তুরস্কের প্রবেশ মেনে নেয়াই হবে তাদের জন্য সবচেয়ে উত্তম। তারা তাতে রাজি হয়। পরে এই অংশটি বিদেশী অংশের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাদেরও সম্মতি আদায় করতে সক্ষম হয়। অবশেষে নুসরাহর পক্ষ থেকে তুর্কি অভিযানকে মেনে নেয়ার ঘোষণা আসে এবং তার পরেই গত ১২ ই আগস্ট তুর্কি সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী দলটি ইদলিবে প্রবেশ করে। এভাবে তুরস্ক কূটনৈতিক দক্ষতা দেখিয়ে শত্রুদের পাতানো ফাঁদ থেকে আপাতত বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়।


এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন তুরস্ক এতো ঝুঁকি নিয়েও ইদলিবে প্রবেশ করলো? তাদের লক্ষ্য কি?
মোটা দাগে এই অপারেশনের ৩ টি লক্ষ্য নির্ণয় করা যেতে পারে-


#এক.
রাশিয়ার প্রচণ্ড বিমান হামলা, স্থলভাগে ইরান হিযবুল্লাহর মদদপুষ্ট সিরিয়ার সরকারী সেনাবাহিনীর আক্রমন, রহস্যজনকভাবে আইএসের উত্থান এবং সেই সাথে আমেরিকার চরম বিশ্বাসঘাতকতার ফলে বিপ্লবীদের অগ্রযাত্রা থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হয়। চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র, নিজেদের আত্মকলহ এবং ৩ পক্ষের সর্বাত্মক আক্রমনের ফলে তারা একে একে বিজিত শহরগুলো হারাতে থাকে। কখনো আইএসের হাতে, কখনো কুর্দিদের হাতে, আবার কখনো আসাদের সরকারী বাহিনীর হাতে। যখনই কোন শহরের পতন ঘটত তখন সেখানকার অধিবাসীরা বিপ্লবীদের অধিকারে আছে এমন পার্শ্ববর্তী শহরগুলোতে আশ্রয় নিতো। এভাবে পর্যায়ক্রমে হারানো শহরগুলো থেকে মানুষ জড়ো হতে হতে এখন সবার ঠিকানা হয়েছে ইদলিব। দৃশ্যপটটি স্পেনের পতনের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে দেয়। তখনও খণ্ডরাজ্যের শাসকদের পারস্পরিক বিরোধের সুযোগ নিয়ে খ্রিষ্টানরা উত্তর স্পেন থেকে একটি একটি করে মুসলিম শহরগুলো দখল করতে থাকে। কোন একটি শহরের পতন ঘটলে আগুন আর তরবারি থেকে যারা রেহায় পেত তারা পার্শ্ববর্তী মুসলিম রাজ্যে আশ্রয় নিতো। এভাবে মুসলিম খণ্ডরাজ্যগুলোর পতনের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ১৪৯২ সালে গ্রানাডার পতনের মধ্য দিয়ে স্পেন থেকে ৮শো বছরের ইসলামী সালতানাতের চিরবিলুপ্তি ঘটে।
এখন সিরিয়ার ক্ষেত্রেও তাই ঘটছে। অন্যান্য শহরগুলো থেকে পালিয়ে আসা মানুষের বড় একটি অংশ আশ্রয় নিয়েছে এই শহরে। সব মিলিয়ে এখন ইদলিবের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০ লক্ষের উপরে।


তো, সমস্যা কী?


সমস্যাটা হচ্ছে- আজ হোক বা কাল রাশিয়া, ইরান এবং আসাদ আলেপ্পোর মতো ইদলিবেরও দখল নিবে- তাতে কোন সন্দেহ নাই। বরং আলেপ্পোর পতনের পরে এই সম্ভাবনা আরও প্রবল হয়ে উঠেছে। কারণ, আলেপ্পো থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরত্বে ইদলিবের অবস্থান। পাশাপাশি ইদলিবের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টিতে স্বীকৃত একটি সন্ত্রাসী দলের হাতে। তো, এখন যদি রাশিয়া ৩০ লক্ষ মানুষের একটি শহরে সর্বাত্মক বিমান হামলা শুরু করে তাহলে সেখানকার পরিস্থিতি কতো ভয়াবহ হবে তা সহেজেই অনুমেয়। নিশ্চিতভাবে রাশিয়া এবং আসাদ আলেপ্পোর মতো ইদলিবেও পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করবে। ৩০ লাখের মধ্যে ২০ লাখ মানুষ হত্যা করে হলেও তারা ইদলবের দখল নিবে। এজন্য তাদেরকে কোন আন্তর্জাতিক চাপও মোকাবেলা করতে হবে না। কারণ, ইদলিবের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এমন একটি দলের হাতে যে দলটি জাতিসংঘের ঘোষিত সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত। অতএব, আলেপ্পো গণহত্যার ক্ষেত্রে আমেরিকা ও পশ্চিমারা যতোটুকু মৃদু প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ইদলিবের ক্ষেত্রে সেরকম কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। 
তো এই অবস্থায় রাশিয়া এবং আসাদ সেখানে হামলা শুরু করলে তার প্রেক্ষিতে যে ভায়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে তার কারণে তুরস্ক ৩ টি ক্ষতির মুখোমুখি হবে-


১.
কয়েক লাখ মানুষ নিশ্চিতভাবে মৃত্যুর মুখে পতিত হবে। এই ঘটনার কারণে মুসলিম বিশ্বের দায়িত্বশীল ও উদীয়মান শক্তি হিসেবে এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ক প্রবল চাপের সম্মুখীন হবে। গোটা মুসলিম দুনিয়া হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য তুরস্কের কাছ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ আশা করবে। কিন্তু বাস্তবে তুরস্ক কিছুই করতে পারবে না। কারণ, রাশিয়া ইরানের মুখোমুখি দাঁড়ানোর ক্ষমতা তুরস্কের এখনও হয়ে উঠেনি। ফলে আলেপ্পোর ক্ষেত্রে যা ঘটেছিলো এখানেও তাই ঘটবে। তুরস্ক একটি দায়িত্বশীল মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে এবং প্রেসিডেন্ট এরদোগান একজন দরদী মুসলমান হিসেবে এই দৃশ্য মেনে নিতে পারবেনা। আবার কিছু করতেও পারবেনা। এর ফলে গোটা মুসলিম বিশ্বের সামনে তাদের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হবে। এক আলেপ্পোর ঘটনা মুসলামানদের একটি অংশের মধ্যে তুরস্কের ব্যাপারে ভুল ধারণার জন্ম দিয়েছে। ইদলিবেও যদি এমন কিছু ঘটে তাহলে দুনিয়ায় নিশ্চিতভাবে তুরস্কের নিন্দুকের সংখ্যাটি আরও অনেক বড় হবে। তাই ইদলিবকে আলেপ্পোর পরিণতি বরণ করা থেকে রক্ষা করতে তুরস্কের সেখানে প্রবেশ করা ছাড়া আর কোন বিকল্প ছিল না।


২.
বর্তমানে আমেরিকা এবং ইউরোপের সাথে তুরস্কের সম্পর্কের চরম অবনতি হয়েছে। সর্বশেষ কয়েকটি ঘতনাদুই পক্ষের ভঙ্গুর সম্পর্ককে আরও দুর্বল করে তুলেছে। তাই এই মুহূর্তে রাশিয়ার সাথে সুসম্পর্ক ধরে রাখা ছাড়া তুরস্কের হাতে আর কোন বিকল্প নেই। কারণ একই সময়ে সব পক্ষের সাথে বিরোধে জড়ানো আন্তর্জাতিক রাজনীতির সাধারণ নীতিতে আত্মহত্যা হিসেবে বিবেচিত হয়। এখন যদি রাশিয়া ইদলিবে হামলা করে বসে নিশ্চিতভাবে তুরস্ককে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সুর চড়া করতে হবে যা এই মুহূর্তে তুরস্কের জন্য মারাত্নক ক্ষতি ডেকে আনবে। পাশাপাশি কুর্দি সমস্যা সামাল দেয়ার জন্য ইরানের সাথে সম্পর্ক মেরামত করা তুরস্কের জন্য জরুরী হয়ে পড়েছে। এই উদ্দেশ্যে কিছু দিন আগে এরদোগান ইরান সফরও করেন। ইদলিবের সংঘাত আবারও দুই দেশকে মুখোমুখি দাঁড় করে দেবে।


৩.
তুরস্ক আজ প্রায় ৭ বছর ধরে ৩ মিলিয়ন সিরিয় শরণার্থীর ভরন-পোষণ করে আসছে। তাদের জন্য উপশহর তৈরি করা হয়েছে। এর পেছনে তুরস্কের এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ৩৩ থেকে ৩৫ বিলিয়ন ডলার। এখন ইদলিবের উপর হামলা শুরু হলে সেখানে বসবাসকারী ৩ মিলিয়ন লোকের মধ্যে নিম্মে ২ মিলিয়ন লোক তুরস্কে গিয়ে আশ্রয় নেবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। পূর্বের ৩ মিলিয়নের সাথে নতুন আরও ২ মিলিয়ন যোগ হলে তুরস্কের অর্থনীতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা সহজেই অনুমেয়। তাই সম্ভাব্য এই শরণার্থী-বন্যা ঠেকাতে হলে ইদলিবে নিজেদেরই প্রবেশ করতে হবে।


#দুই.
আগেও বেশ কয়েকবার আলোচনায় উঠে এসেছে যে, আমেরিকা, ইউরোপ এবং ইসরাইলের মাষ্টার-প্ল্যান ঘুরছে ভবিষ্যৎ বৃহত্তর কুর্দিস্তান নিয়ে। পেন্টাগনের দেয়ালে অলরেডি নতুন কুর্দিস্তানের মানচিত্র ঝুলছে। উত্তর ইরাকে কুর্দি এলাকায় গণভোটের আয়োজন করে এই প্ল্যানকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। প্ল্যান অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে ইরাক এবং সিরিয়ার কুর্দি অঞ্চল ভিন্ন ভিন্ন অথরিটির শাসনে থাকলেও পরবর্তীতে উভয় এলাকা এবং এর সাথে তুরস্ক ইরানের কুর্দি এলাকাগুলো বিচ্ছন্ন করে সেগুলোও এক সাথে সংযুক্ত করে বৃহত্তর কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠা করা হবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই রাষ্ট্রটি চতুর্দিক থেকে শত্রু রাষ্ট্র-বেষ্টিত হয়ে থাকবে। এই রাষ্ট্রের মূল সম্পদ হচ্ছে খনিজ জ্বালানি। এগুলো বহির্বিশ্বে সরবরাহ করার মতো কোন পথ এর সামনে খোলা থাকবে না। বর্তমানে উত্তর ইরাকের কুর্দি সরকার তুরস্কের উপর দিয়ে পাইপলাইন বসিয়ে তেল বিক্রি করছে। এটা তুরস্ক অচিরেই বন্ধ করে দিবে। এই কারণে এই সম্ভাব্য রাষ্ট্রটি চতুর্দিক থেকে অবরুদ্ধ হবে।


তো, এই শঙ্কার কথা কি আমেরিকার মাথায় আসেনি?


হ্যাঁ, অবশ্যই এসেছে। এই জন্যই আমেরিকার টার্গেট হচ্ছে এই রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে যেকোনো ভাবে ভুমধ্যসাগরের সাথে এর সংযোগ ঘটাতে হবে। যাতে নৌবন্দর দিয়ে রাষ্ট্রটি তেল বিক্রিসহ যাবতীয় বানিজ্য পরিচালনা করতে পারে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ইরাক সীমান্ত থেকে নিয়ে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত গোটা উত্তর সিরিয়া জুড়ে কুর্দিদের বসবাস নেই। বরণ ইরাক সীমান্ত থেকে কুবানি পর্যন্ত, অর্থাৎ ফুরাত নদির পূর্বতীর পর্যন্ত এসে কুর্দি বসতি থেমে গেছে। তারপর ফুরাতের পশ্চিমতীর থেকে আরব এবং তুর্কম্যান এলাকা শুরু হয়ছে। এগুলো হচ্ছে- মানবাজ, জারাব্লুস, বাব এবং আলেপ্পোর উত্তরাঞ্চলীয় এলাকা। তার পরে এসে একদম ইদলিব সীমান্তের সাথে লাগানো ভুমধ্যসাগরের খুব কাছে আরেকটি শহর আছে। নাম ইফরীন। এটি কুর্দি শহর। এই শহরটি অন্যান্য কুর্দি এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন। এর উত্তর আর পশ্চিমে তুরস্ক এবং দক্ষিন ও পূর্বকোনে ইদলিব। এখন আকেরিকার পরিকল্পনা হচ্ছে ফুরাতের পশ্চিম তীর থেকে নিয়ে ইফরীন পর্যন্ত সংযোগ স্থাপন করা। তারপরে ইফরীন থেকে নিয়ে ইদলিব এবং লাজিকিয়ার ভুমধ্যসাগরের তীরবর্তী এলাকাগুলো দখল করে ভুমধ্যসাগর পর্যন্ত সাপের মতো দীর্ঘ করিডোর তৈরি করে কুর্দিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম দেয়া।


ইদলিব ছিল মূলত আমেরিকার টার্গেট। তাদের ইচ্ছে ছিল সম্পূর্ণ রাক্কা শহরের স্টাইলে ইদলিবকেও নুসরাহ এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর হাত থেকে মুক্ত করার নাম দিয়ে সেখানে ইফরীনের কুর্দিদের ঢুকিয়ে দেয়া। এজন্য আমেরিকা ইফরীনে কুর্দি যোদ্ধাদের প্রস্তুতও করতেছিল। কিন্তু তারা রাক্কা শহর কুর্দিদের পূর্ণ দখলে আসার জন্য অপেক্ষা করছিলো। রাক্কার ঝামেলা মিটে গেলে সাথে সাথেই ইদলিবে হাত দিতো এবং করিডোর নির্মাণের সর্বশেষ কাজটি সেরে ফেলত।


এখন আমেরিকা, ইসরাইল এবং ইউরোপিয়ান শক্তিগুলোর এই পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করতে হলে যেকোনভাবে তুরস্ককে করিডোর তৈরির পথকে রুদ্ধ করতে হবে। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তুরস্ক ২০১৬ এর আগস্টে “অপারেশন ইউফ্রেটিস শীল্ড” নামে একটি ঝটিকা অভিযানের মাধ্যমে উত্তর সিরিয়ায় ঢুকে পড়ে এবং প্রথমে জারাব্লুস এবং তারপর বাব শহর দুটি দখল করে নেয়। এর মাধ্যমে তুরস্ক তার প্রাথমিক টার্গেটে সফল হয়। কারণ, এর দ্বারা কুর্দিদের মানবাজ থেকে পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে ইফরীন পর্যন্ত যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এটা ছিল আমেরিকার গালে বেশ বড় মাপের একটি চপেটাঘাত। কুর্দি করিডোর নির্মাণের মার্কিন ও ইসরাইলী পরিকল্পনা সর্বপ্রথম ধাক্কা খায়। 
কিন্তু এটুকু করে বসে থাকার সুযোগ নেই তুরস্কের। কারণ, এই করিডোরকে পরিপূর্ণভাবে ঠেকানোর জন্য ইফরীনকে ভুমধ্যসাগরে জুড়ে দেয়ার পরিকল্পনা নস্যাৎ করতে হবে। আর এজন্য তাদের ইফরীন এবং ভুমধ্যসাগরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা ইদলিবকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়া ছাড়া আর কোন গতি নেই।


#তিন.
সিরিয়ার বিপ্লবীদের সমর্থক-রাষ্ট্র হিসেবে সিরিয়া সংকটের যেকোনো ভবিষ্যৎ সমাধান প্রক্রিয়ায় নিজের শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করা তুরস্কের জন্য অপরিহার্য। এটা শুধু বিপ্লবীদের স্বার্থেই নয়; বরং স্বয়ং তুরস্কের জাতীয় নিরাপত্তা জড়িত রয়েছে সিরিয়া সংকটের যেকোন ভবিষ্যৎ পটপরিবর্তনের সাথে। উত্তর সিরিয়ায় প্রচুর তুর্কি উপজাতির বসবাস। এদের স্বার্থ নিশ্চিত করার পাশাপাশি ৩ মিলিয়ন সিরিয় শরণার্থীর পুনর্বাসন করা, দামেস্কের ভবিষ্যৎ সরকারের ধরণ নির্ধারণ করা এবং সিরিয়ার অখণ্ডতা ধরে রাখার মতো বিষয়গুলো তুরস্কের জন্য অনেক বড় চ্যালাঞ্জ। সিরিয়া এখন একটি বহুজাতিক লড়াইয়ের ক্ষেত্র। সেখানে বর্তমান দুনিয়ার প্রায় সবকটি প্রভাবশালী পক্ষ কোন না কোনভাবে সক্রিয়। কিন্তু সংকট যতই সমাধানের দোরগোড়ার দিকে যাবে ততোই এক পক্ষ আরেক পক্ষকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়ার চক্রান্তে মেতে উঠবে। অবস্থাতি সম্পূর্ণ আমাদের দেশের “বেলুন ফুটানো খেলা”র মতো হবে। বৃহৎ পক্ষগুলো দুর্বল পক্ষগুলোকে পূর্বেই বের করে দিবে। সবশেষে মাঠে থাকবে ৪ টি পক্ষ। আমেরিকা-ইসরাইল, রাশিয়া, তুরস্ক এবং ইরান। গেমসের দ্বিতীয় স্টেপে এসে আমেরিকা এবং রাশিয়া অপেক্ষাকৃত দুই ছোট পক্ষ তুরস্ক এবং ইরানকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করবে এবং তাতে সফল হলে দুই বড় ভাই পরস্পর বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভাগাভাগি করে আখেরি ফসল ঘরে তুলবে।


এর আলামত ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে সুর পাল্টাতে শুরু করেছে। পারমাণবিক চুক্তি যদিও এখনও বাতিল করেনি কিন্তু এমন সব নতুন শর্ত জুড়ে দিচ্ছে যা পালন করা ইরানের পক্ষে সম্ভব নয়। ইরানের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের সেই বুশীয় পরিভাষা আবারও হাজির করা হচ্ছে। উত্তর কোরিয়ার সাথে ইরানী কানেকশনের ধোঁয়া তোলা হচ্ছে। উদ্দেশ্য ইরানকে অস্থিতিশীল করা ব্যাস্ত রাখা। ইরান-ইসরাইল বা ইরান-আমেরিকার মধ্যে একটি কৃত্রিম যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে এবং পূর্বের শিতিল করা সব অবরোধ আবারও ফিরিয়ে এনে ইরানের অর্থনীতির চাকাকে রুদ্ধ করে দেয়া। যার প্রভাব পড়বে ইরানের প্রতিরক্ষানীতি এবং সামরিক ব্যায়ের উপর। ফলে সিরিয়া ইরাকসহ অন্যান্য অঞ্চলে ইরানের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকবে।


একই অবস্থা তুরস্কের ক্ষেত্রেও তৈরি করা হচ্ছে। ইরাকের কুর্দিস্তানে গণভোটের আয়োজন করা, উত্তর সিরিয়ায় কুর্দিদেরকে শক্তিশালী করে তুরস্ককে আরব দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া এবং সর্বশেষ কয়েকদিন আগে ইস্তাম্বুলের মার্কিন কনস্যুলেটে কর্মরত এক তুর্কি নাগরিকের গ্রেফতারের জের ধরে আমেরিকার পক্ষ থেকে নজিরবিহীন কূটনৈতিক সংকট সৃষ্টি করা- এগুলো সবই একই সুত্রে গাঁথা। উদ্দেশ্য- একাধিক ফ্রন্ট খুলে তুরস্কের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং দেশটির শক্তি খর্ব করা। চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে তুরস্ককে ভেঙে কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
এই ব্যাপারগুলতে আমেরিকার সাথে রাশিয়াও সমানভাবে যোগ দিবে। কারণ, একটি শক্তিশালী তুরস্ক আকেরিকার চেয়ে রাশিয়ার জন্যই বেশী হুমকি হয়ে দেখা দিবে। তাছাড়া, তুরস্ক ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার শত্রু। এখনও অটোমান-জার যুদ্ধগুলো পৃথিবীর ইতিহাসের বিশাল একটি অংশ দখল করে আছে। পিকেকে গেরিলাদের সাথে রাশিয়ার গোপন সম্পর্কের কথা কারও অজানা নয়। তাই সিরিয়া থেকে তুরস্ককে বের করার মিশনে আমেরিকার পাশাপাশি রাশিয়াও সর্বশক্তি ব্যায় করবে তাতে কোন সন্দেহ নাই।


তাই নিজের নিরাপত্তা রক্ষা করা এবং সিরিয়ার বিপ্লবীদের নুন্যতম স্বার্থ রক্ষা করার জন্য তুরস্ককে অবশ্যই সিরিয়ার মাটিতে শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে হবে। যাতে সিরিয়া এবং অত্র এলাকার ভবিষ্যৎ প্রশ্নে তুরস্কের মতামতকে কেউ ডিঙ্গিয়ে যাবার সুযোগ না পায়। এই জন্যই ইদলিবে প্রবেশ করা তুরস্কের জন্য জরুরী হয়ে পড়েছিল।


#কিন্তু, যে লক্ষ্যগুলোকে সামনে রেখে তুরস্ক ইদলিবে প্রবেশ করেছে সেগুলো অর্জন করা কি খুবই সহজ হবে? যাদের চক্রান্ত নস্যাৎ করার জন্য এই পদক্ষেপ নেয়া হল- তারা কি খুব সহজে ছেড়ে দেবে? এই বিষয়ে-

পঠিত : ৭৭৬ বার

মন্তব্য: ০