Alapon

আমাদের পরিবার ব্যবস্থা যেমন ছিলো...



আজ থেকে ৩৫ বছর আগে আব্বা আম্মাকে বিয়ে করে আনেন। আম্মার যখন বিয়ে হয়, তখন আম্মার বয়স ১৪-১৫ বছর। কিশোরীই বলা চলে। সেই কিশোরী মেয়েটাকে আব্বা তার জীবনের একটা স্বপ্নের কথা বললেন। সেই স্বপ্নটা হলো, তিনি একটা বাড়ি বানাবেন! বাড়িটা যেমনই হোক, কিন্তু তার নিজের একটা বাড়ি থাকা চাই।

এতোদিন এই স্বপ্নটা ছিল কেবল আব্বার। সেই দিনের পর থেকে স্বপ্নটা আম্মারও হয়ে যায়। এরপর অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। আমরা ৫ ভাই-বোন (৩ ভাই ২ বোন) জন্ম নিয়েছি। এরপর আব্বা দাদা বাড়ির সাথে লাগানো ১২ শতকের একটা জমি কিনলেন। জমিটা তুলনামূলক নিচু হলেও, দাদা বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় কিনে ফেললেন। তারপর টাকা জমিয়ে একটু একটু করে সেই নিচু জমিটাতে মাটি তুলে ভরাট করতে লাগলেন। তারপর একদিন বাদ ফজর আনুষ্ঠানিকভাবে দুআ করে বাড়ি বানানোর কাজ শুরু করলেন।
বাড়ি বানানোর মাঝপথে কাজ বন্ধ হয়ে গেল। আব্বার হাতে নগদ টাকা ফুরিয়ে গেল। এরপর বেশ কিছুদিন অপেক্ষার পর আবার কাজ শুরু হলো। আম্মা রান্না ঘরের জানালা দিয়ে তাদের দুজনের স্বপ্ন গড়ে ওঠা দেখেন।

বাড়ির কাজ যখন ২ তৃতীয়াংশ শেষ হয়ে গেল, তখনই আমাদের পরিবারের জন্য সবচেয়ে খারাপ সংবাদটি এলো। দাদীর ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে। এরপর থেকে মনে হলো, আম্মা যেন তার স্বপ্নের বাড়ির কথা ভুলেই গেলেন। দাদীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। দাদীকে নিয়ে আম্মার ব্যস্ততা দেখে কতক সময় মনে হতো, আম্মার যে ৫ জন সন্তান আছে, সে কথা হয়তো তার মনেই নাই! এমতাবস্থায় আমাদের দেখাশোনা করতেন নানী আর আমাদের একমাত্র খালা।

একদিকে আব্বা আর আম্মার স্বপ্নের বাড়ি তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে দাদীর অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এরপর ডাক্তারের পরামর্শনুসারে চিকিৎসার জন্য দাদীকে ঢাকায় নেওয়া হলো। আর দাদীর সঙ্গি হিসেবে থাকলেন আম্মা।

আমাদের বাড়ির কাজ যেদিন শেষ হলো এবং আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে দাদীবাড়ি ত্যাগ করে নিজেদের বাড়িতে স্থানান্তরিত হলাম, সেদিন আম্মা দাদীকে নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করছেন। মোবাইলে আম্মাকে যখন জানানো হলো আমরা নতুন বাড়িতে উঠেছি, তখন আম্মার কণ্ঠ নিরুত্তাপ ও প্রাণহীণ ছিলো। অথচ, এই দিনটার জন্য আম্মা এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করেছেন।

এর এক মাস পর আম্মা যখন দাদীকে বাড়িতে ফিরলেন, তখন আর একটি ঘটনা ঘটল। দাদী যখন বাড়িতে ফিরে দেখলেন, আমরা আর এই বাড়িতে নেই, তখন তিনি ভীষণ মন খারাপ করলেন। দাদীর এই মন খারাপ কেউ বুঝতে না পারলেও আম্মা বুঝতে পারলেন। আম্মা সারাদিন মন মরা হয়ে থাকলেন।

বিকেল বেলা দাদী হাটতে হাটতে আমাদের নতুন বাড়িতে আসলেন। বাড়ির চারদিক ঘুরে বললেন, ‘বৌমা! আমি কোন ঘরে থাকবো? তোমরা ও বাড়িতে নাই, আমার থাকতে ভালো লাগছে না। আমিও তোমাদের সাথে এই বাড়িতে থাকবো।’

দাদীর মুখে এই কথা শোনার পর আম্মা যেন কিশোরীদের মত চঞ্চল হয়ে উঠলেন। আমার দুই বোনকে ডাকতে শুরু করলেন, ‘এই তাসনিম আর সুয়াইমা! তাড়াতাড়ি তোমার দাদীর ঘরে কাপড়-চোপড় নিয়ে আসো। তোমাদের দাদী আজ থেকে আমাদের সাথেই থাকবেন।’
দাদী মারা যাওয়ার আগে আগে আম্মার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, ‘বৌমা! মা গো! আল্লাহ তোমাক দুধভাত খাওয়াক। তোমাক যতো কষ্ট দিছি, সেগুলো মনে রাইখেন না। আল্লাহ তোমাক ভালো রাখবেন, ইনশাআল্লাহ।’

আমার দাদী মারা গেছেন আজ ১৬ বছর হলো। আম্মা এখনো তার ৩ ছেলে আর ২ মেয়ের কাছে নিজের শ্বাশুড়ির গল্প করতে গিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বলেন, ‘সম্ভবত, তোমার দাদী আমার জন্য মন খুলে দুআ করেছিলো বলেই আল্লাহ আজকে আমাকে এতো ভালো রেখেছেন। আলহামদুলিল্লাহ।’

পঠিত : ৩০৭ বার

মন্তব্য: ০