Alapon

কয়েকটি প্রাচীন সভ্যতার পতন হল যেভাবে...



বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে লক্ষ্য করা যায়, পৃথিবীর ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় অনেক সভ্যতার উত্থান-পতন ঘটেছে, আবার কিছু সভ্যতা ধ্বংস মুখে পতিত হয়েছে। তবে যখনই কোন সভ্যতার পতনের দিকে লক্ষ্য করা হয়, তখন পতনের কারণ হিসেবে কয়েকটি মৌলিক বিষয় গুরুত্ব পায়। সাধারণ ভাবেই লক্ষ্যনীয় যে সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন, অবাধ যৌনতা, আর পার্থিব লালসায় ধর্মীয় অজুহাত। কালক্রমে এ বিষয়গুলোই বিভিন্ন সভ্যতাকে পতনের দিকে টেনে নিয়েছে। এখানে কয়েকটি খুবই পরিচিত সভ্যতার পতনের কারণ নিয়ে কিছু কথা

গ্রীক সভ্যতা: “ক্লাসিক্যাল(শুরু) ৫০০ খ্রিঃপূঃ – হেলেনিস্টিক(শেষ) ১৪৬ খ্রিঃপূঃ”
সভ্যতার সূতিকাগার বলা হয় গ্রীসকে, এখানেই গড়ে উঠেছিল সভ্যতার প্রথম নগর রাষ্ট্র। বিশ্বের প্রাচীন এই সভ্যতা চিন্তা-চেতনা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য আর বুদ্ধিবৃত্তিক পরিপক্বতা অর্জন করেছিল, তাদের পূর্বে আর কোন জাতি এই বিষয়ে এতো বেশি উৎকর্ষতা অভিজ্ঞতা লাভ করেনি।

এই সভ্যতায় আগমন ঘটেছিল বিশ্বচিন্তার স্তম্ভ সক্রেটিস, প্লেটো আর অ্যারিস্টটলদের মত মনীষীদের। এতো উৎকর্ষ সাধনের পরেও তাদের নানামুখী সামাজিক অপকর্ম এ সভ্যতাকে টেনে নিয়ে যায় ধ্বংসের পথে।

প্লেটো ধারণা দিয়েছিলেন নোবেল সিটির, অভিজাত এই নগরী গড়ে উঠবে তিন শ্রেণীর মানুষের সমন্বয়ে। প্রথম শ্রেনী হবে দার্শনিক, দ্বিতীয় শ্রেনিতে থাকবে সৈনিক, আর তৃতীয় শ্রেনীতে থাকবে শ্রমিক এবং কৃষক সম্প্রদায়, এবং এই নগরীর শাসনকার্য থাকবে প্রথম শ্রেনীর দার্শনিকগণের হাতে। এটি কোন বিরোধের বিষয় ছিলনা, সমস্যা সৃষ্টি হল যখন সেনাশ্রেণী এবং শ্রমিকশ্রেণীকে সকল দিক থেকে অধিকার বঞ্চিত করা হল তাঁর এই চিন্তাপ্রসূত নোবেল সিটিতে। অর্থাৎ তাদের কোন মালিকানা থাকবেনা, পরিবার গঠন করতে পারবেনা, ব্যাক্তিস্বাতন্ত্রতাও দূরীভূত করা হল।

সৈনিকদের ভোগের জন্য নির্ধারিত থাকবে একদল নারী, তাও থাকবে অনেকটা যৌথ সম্পত্তির ন্যায়। এই সকল নারীদের গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তানদের কোন পিতৃপরিচয় থাকবে না, তারা হবে রাষ্ট্রের সন্তান। অভিজাত এই নগরীতে অসুস্থতার কোন ঠাই থাকবে না, রাষ্ট্র অসুস্থদেরকে দূরে ঠেলে দিবে। সে সময়ের গ্রীক নগর রাষ্ট্রে কৃষক-শ্রমিকদের অবস্থাও ছিল খুবই করুন, তারা ছিল সমাজের দাস। অ্যারিস্টটলের চিন্তাধারা ছিল- ‘প্রকৃতি সমাজের এই দাস-মানবদের দিয়েছে শক্তিশালি দেহ, আর অভিজাত দার্শনিকদের দিয়েছে মাথা ভরা বুদ্ধি। সুতরাং নিচুশ্রেণীর এই গোষ্ঠী কেবল অভিজাতদের নিঃস্বার্থ সেবা করবে আর তাদের দ্বারা শাসিত হবে।’ এ যেন বর্ণপ্রথারই সূত্রপাত।

নির্মমতার এক জঘন্য দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিল, খাদ্যের উৎসগুলোতে অধিবাসীদের চাপ কমানোর অজুহাতে দার্শনিকগণ শিশুহত্যার বৈধতা দিয়েছিলেন।

উইল ডুরান্ট বলে গিয়েছেন- “উত্তম চরিত্রের ক্ষেতে গ্রীকরা দৃষ্টান্ত হতে পারে না, কারণ চরিত্র বলতে কোন জিনিসই তাদের ছিলনা।” ইন্দ্রিয়সুখের পিছনে ছুটতে গিয়ে তারা ব্যাপক আকারে কামচরিতার্থে নিমজ্জিত হয়ে পরে। ফলে তাদের জৈবিক শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ার সাথে সাথে সৎ মানুষের জীবন ধ্বংসের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। গ্রীক নাট্যকার মেনানদার তার নাটক গুলোতে এথেন্সের জীবনকে চিত্রায়িত করেছেন, এথেন্সের জীবন ছিল ভ্রষ্টতা, চরিত্রহীনতা, আর জৈবিক স্বেচ্ছাচারে ভরপুর। সুতরাং এই নগরসভ্যতার পতন ছিল তাদের কৃত কর্মের স্বাভাবিক পরিণাম।

পারস্য সভ্যতা:
বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে পার্সীয়রা ছিল এক অনন্য জাতি। রাজনীতি, প্রশাসন, যুদ্ধজয়, বিলাস ব্যসন আর উৎকর্ষতায় তারা ছিল সমৃদ্ধ। পার্সীয়রা বিস্তৃত সাম্রাজ্য আর দীর্ঘস্থায়ী সভ্যতা প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিল। তারা এসেরীয়দের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোতে উন্নততর রূপ দিতে গিয়ে প্রায় ২০০ বছর স্থায়ী একটি সমৃদ্ধশালী সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। সভ্য বিশ্বের কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বে তারা ছিল রোমানদের সমপর্যায়ে। রোম সাম্রাজ্যের পুর্বে আর কোন রাষ্ট্র কাঠামো পার্সীয়দের মতো সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর দিতে গিয়ে পার্সীয়গণ একটি দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো এবং একটি নতুন ধর্মীয় দর্শন রেখে যেতে পেরেছিল। তাদের ধর্মেও ছিল মৌলিকত্ব, তাদের জাতিগত ধর্মের নাম জরথুস্ত্রবাদ।

পাহলভি নামে সাহিত্যরসে ভপুর এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ একটি ভাষাও ছিল তাদের সংস্কৃতিতে। এতকিছু থাকা সত্ত্বেও তাদের সমাজে চরমপর্যায়ে চারিত্রিক এবং নৈতিকতার অবক্ষয় এই সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখে পতিত হতে বাধ্য করেছিল।

সাসানীয় যুগে পার্সীয়দের মাঝে রক্তসম্পর্কিত নিকটাত্মীয়দের মাঝে বিবাহ প্রথা চালু ছিল। এটা তাদের কাছে কোন অপরাধ বা পাপ বলে গণ্য হত না, বরং তাদের কাছে এটি ছিল একটি পুণ্যময় কাজ। পারস্যের ষোড়শ সাসানীয় সম্রাট দ্বিতীয় ইয়াযদিরগারদ (৪৩৯-৪৫৭ খ্রিঃ) নিজ কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন, আবার তাকে হত্যাও করেছিলেন। খ্রিষ্টীয় ষষ্ট শতাব্দীর সাসানীয় সম্রাট বাহরাম চুবিন নিজ বোনকে বিয়ে করেছিলেন। এছাড়া কামলালসা আর অবাধ যৌনতা ছড়িয়ে পড়েছিল ব্যপক পরিসরে।

খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতকে মানির আবির্ভাব হল, তিনি এই অবাধ যৌনতার বিরুদ্ধে এক আন্দোলনের ডাক দিলেন। প্রয়োজনে কুমারব্রত পালনের আহবান জানালেন। সম্রাট বাহরাম তার প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে হত্যা করলো, এবং তার শিক্ষার বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ ঘোষণা করা হল।

এর পরে আবির্ভাব হল বিখ্যাত পারসীক দার্শনিক ও জরথুস্ত্রীয় পুরোহিত মাযদাকের। তিনি এসে ঘোষণা দিলেন সম্পদ এবং নারী দুটোই ভোগের জন্য হালাল। তার এ আহবানে যুবশ্রেনী, ধনীক শ্রেণী আর বিলাসীদের জন্যে খুবই আনন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়ালো। মাযদাকও রাজ সুরক্ষা লাভ করলো। অন্যদিকে এই আহবানের প্রভাবে পারস্যে নৈতিক বিপর্যয় ও যৌন স্বেচ্ছাচারিতায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল। মূলত জৈবিক বিলাস, সমরশক্তি অর্জন, আর রাজ ক্ষমতা অর্জনই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। এমনকি প্রভুকে ছেড়ে সম্রাটদেরকেই তারা উপাস্যের স্থানে সমাসীন করে নিয়েছিল।

রোমান সভ্যতা:
বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে আরেকটি ঐশ্বর্যশালী সভ্যতার নাম রোমান সভ্যতা। সভ্যতার কথা মাথায় এলেই জ্বলজ্বল করে উঠে প্রাচীন এক বৈভবময় সভ্যতার কথা। প্রাচীন কলোসিয়ামে যুদ্ধরত দুর্দান্ত সাহসী আর অকুতোভয় গ্ল্যাডিয়েটরদের কথা। ধারণা করা হয় গ্রীক সভ্যতার পর এটিই ছিল ইউরোপের সবচেয়ে বড় সভ্যতা।

তারা সভ্যতার অগ্রগতির শিখরে পৌঁছে গিয়েছিল, ক্ষমতা আর প্রতাপের সাথে সভ্য এই পৃথিবীকে শাসনের ক্ষেত্রে পারসিকদের সমকক্ষ হয়ে উঠেছিল। মানুষকে তারাই প্রশাসনিক শৃঙ্খলা আর নতুন নগরকেন্দ্রিকতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। রোমান সভ্যতা যে চিন্তা-চেতনা, দার্শনিক জ্ঞান আর অভিজ্ঞতার কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল এ বিষয়ে তাদের শাসনবিধি থেকে স্পষ্ট হওয়া যায়।

যে নগরের ঐশ্বর্য আর প্রাচুর্যের কোনো শেষ ছিলনা, বড় বড় দালান আর সম্পদে পরিপূর্ণ এক স্বর্গরাজ্য। তারও আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিষাদময় ইতিহাস। ধর্মীয় সেচ্ছাচারিতা আর সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতন এই সভ্যতাকে ধাবিত করেছিল ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

সম্রাট কনস্টান্টাইন তার শাসনকালে (৩০৬-৩৩৭ খ্রিঃ) এমন কিছু নীতি গ্রহণ করেছিলেন, যার ফলে খৃষ্টধর্ম দৃঢ় ভিত্তি স্থাপনের মাধ্যমে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছিল। তবে তার এই নীতি সমূহ গির্জার কর্ণধারদের কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি, অর্থাৎ তাদের আরো চাই। তারা সম্রাটের নামে Donation of Constantine তৈরি করে পোপতন্ত্র সৃষ্টি করলো। এখানে বলা হল সম্রাট পোপদের পার্থিব ক্ষমতা দিয়েছেন। এ ক্ষমতার প্রভাবে পঞ্চম খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে গির্জার কর্ণধারেরা সাম্রাজ্যের বহু বিষয় নিয়ন্ত্রনে নিতে সক্ষম হয়। ধর্মীয় অজুহাত দেখিয়ে নানা দিকে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে চেষ্টা করে, কয়েকটি উল্লেখযোগ্য-

১. ইহকাল ও পরকালের সবকিছুই বাইবেলে বর্ণিত আছে। সুতরাং এই পবিত্র গ্রন্থই সমস্ত চিন্তাধারার ভিত্তি, এবং কেবলমাত্র ধর্মগুরুরাই এটি ব্যাখ্যার অধিকার রাখেন। আর সাধারণ জনগণকে কোন প্রশ্ন ছাড়াই তাদের ব্যাখ্যা মেনে নিতে হবে।

২. গির্জার ধর্মগুরুরা পৃথিবীতে সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধি, এবং তার আইন বাস্তবায়নকারী। সুতরাং ধর্মগুরুরা তাদের চিন্তাধারার বিরোধিতা কারীদের শাস্তি প্রদান এবং আনুগত্যকারীদের পুরস্কার প্রদানের অধিকার রাখেন।

৩. তাদের মসীহের মুজেযা আর অলৌকিকতার উপর তাদের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠিত ছিল। যা প্রাকৃতিক নিয়মনীতি আর মৌলিকতা থেকে ভিন্ন বিষয়। ফলে তারা জ্ঞানের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। একসময় তারা বহুবিধ জ্ঞানের এবং সমাজের জ্ঞানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। তারা চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা সহ নানামুখী জ্ঞানধারার অসংখ্য পুস্তক জ্বালিয়ে দেয়। অবশিষ্ট গ্রন্থসমুহ মাটিগর্ভে বিলিন করে দেয়া হয়। যে গুলো ধ্বংসকরা সম্ভব হয়নি এই গ্রন্থগুলো খ্রিষ্টানদের জন্য পাঠকরা ধর্মীয়ভাবে নিসিদ্ধ করা হল। মূলত এসব গ্রন্থগুলো ছিল গির্জা আর ধর্মগুরুদের গুমোর ফাঁসকারী।
একপর্যায়ে তাদের মধ্যে ধর্মীয় মৌলিক ও পার্শ্বিক বিষয়াবলী নিয়ে কূটতর্ক এবং তুমুল বিবাদের সৃষ্টি হয়। যা কখনো কখনো আক্রমণ, উৎপীড়ন, লুণ্ঠন, হত্য, বিনাশ ও গুপ্তহত্যায় রূপ নিয়েছিল। শিক্ষালয় থেকে উপাসনালয় এবং আবাসস্থল হয়ে উঠেছিল রণক্ষেত্র।

সমাজের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় এখানে দুইটি শ্রেণী, অভিজাত এবং দাস। এখানেও সকল অধিকারের হর্তা-কর্তা কেবল অভিজাত ব্যাক্তিবর্গ, দাস শ্রেণী কেবল অধিকার বঞ্চিত ব্যাক্তিত্বহীন প্রাণী। অভিজাত ব্যাক্তিগণের কাছে তারা ছিল পণ্যের ন্যায়।

তাদের মালিকানা কিংবা উত্তরাধিকার কোনটিই ছিল না, তারা স্ত্রী গ্রহণ করতে পারতো না। দাসীদের ক্ষেত্রেও ছিল একই পরিণতি, কোন ক্ষতিপূরণ ছাড়াই তাদের সাথে অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার অধিকার ছিল। তাদের সাথে যত অত্যাচারই হোক না কেন, বিচার চাওয়ার কোন অধিকার কিংবা সুযোগ ছিলনা। মনিব ইচ্ছে করলেই তাদের বন্দি করে রাখা, বনজঙ্গলে হিংস্র জন্তু জানোয়ারের সাথে লড়াইয়ের নির্দেশ প্রদান, বিনা অজুহাতে দাসকে হত্যা করতে পারতো। রোমান আইন মনিবদেরকে দাসদের মৃত্যুদণ্ড কিংবা জীবনদানের অধিকার দিয়েছিল।

রোমান সমাজে নারীদের ইতিহাস আরো করুণ, তারা ছিল যেন আত্মাহীন কাঠামো। তাদের ধারণা- নারী হল অপবিত্র, তাদের পরকালীন জীবন বলতে কিছুই নেই। তাদের মাংশ খাওয়ার অধিকার ছিলনা, হাসার অধিকার এমনকি স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকারও ছিলনা। তারা নারীর মুখে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। মানবিক গুনাবলির ভিত্তিসমুহ ধ্বসে পড়ার সাথে সাথে চরিত্র ও নৈতিকতার অবলম্বনগুলো ধ্বংস হয়ে পড়েছিল। ফলশ্রুতিতে রোমান সভ্যতার সূর্যও অস্তমিত হতে শুরু করলো।

ভারতীয় সভ্যতা:
খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে ভারতীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটে, মানবজাতির অভিযাত্রায় এ সভ্যতার অবদান ব্যাপক। জ্ঞান-বিজ্ঞানে এই সভ্যতা যথেষ্ট অবদান রেখেছে। চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা আর গণিতে যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধন করেছে ভারতীয় সভ্যতা। বলা হয় গাণিতিক সংখ্যার (০-৯) এর আবিষ্কার এই সভ্যতারই অবদান, এছাড়া বিজোড় সংখ্যার অর্ধেক বা ভগ্নাংশের ব্যাবহার সর্বপ্রথম এখান থেকেই শুরু হয়েছিল। এছাড়াও জ্যামিতির ত্রিকোণমিতির (sine) এর সারণী এই সভ্যতারই আবিষ্কার। উন্নতি আর উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছা সত্ত্বেও ভারতীয় সভ্যতা খ্রিষ্টীয় ষষ্ট শতক থেকে ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্র সহ প্রায় সকল ক্ষেত্রেই দ্রুত গতিতে অধঃপতনের দিকে নেমে যেতে থাকে।

কারণ হিসেবে দেখা যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩ শতাব্দীকালে ভারতবর্ষে ব্রাহ্ম-সভ্যতার সুচনা ঘটে। এসময় ভারতীয় সমাজব্যবস্থার জন্য নতুন নির্দেশনা (মনুশাস্ত্র) প্রস্তুত করা হয়। এই আইনে দেশের মানুষকে চার শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। ১. ব্রাহ্মণ ২. ক্ষত্রীয়, ৩. বৈশ্য, ৪. শূদ্র। এই মনুশাস্ত্রের ভাষায় ব্রাহ্মণরা হলেন বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রভু, পৃথিবীতে যা কিছু আছে সব তাদের অধীন। তারা তাদের দাসদের কাছ থেকে যত খুশি সম্পদ নিতে পারবে, কারণ দাস কখনো সম্পদের মালিক হতে পারেনা। এই আইন ভারতীয় সমাজে শূদ্রদের অবস্থান রেখছিল পশু-প্রাণীর কাতারে। একটি প্রাণী হত্যায় যে শাস্তি নির্ধারিত ছিল, শুদ্র হত্যায় একই শাস্তির বিধান ছিল।

নারীদের অবস্থান ক্রীতদাসীর চেয়ে বেশি কিছুই ছিল না। জুয়া খেলায় পুরুষেরা নারী/ নিজ স্ত্রীদের বাজি রাখতো। কোন কোন সময় এক নারীর একাধিক স্বামী থাকতো। স্বামী মারা গেলে সে নারী হত চিরকালের বিধবা, মৃত স্বামীর বাড়িতে তার অবস্থান হত দাসীর ন্যায়। এমন অজ্ঞতা, পৌত্তলিকতা, আর সামাজিক অন্যায়-অবিচারের দৃষ্টান্ত সভ্যতার ইতিহাসে বিরল।

এই আলোচনা থেকে মোটামুটি ভাবে স্পষ্ট হওয়া যায় যে, বিশ্বের বড় বড় সভ্যতাগুলোও স্থায়ী হয়নি। এ পতনের ক্ষেত্রে যে কারণগুলোকে দায়ী করা যায় সে গুলো হচ্ছে... ধর্মকে ব্যাবহার করে স্বার্থসিদ্ধি, অবাধ যৌনতা, বর্ণভেদ, নারীর অবমূল্যায়ন, এবং সর্বক্ষেত্রে নৈতিক চরিত্রের চরম পর্যায়ের অবক্ষয়। যদিও ইতিহাসের চরম শিক্ষা হল "ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না" তার পরেও ইতিহাসের মাপকাঠিতে আমাদের নৈতিক শিক্ষা আর চারিত্রিক অবস্থান এবং গতিপথ নির্ণয় জরুরী।

- সংগৃহিত

পঠিত : ৯৪১ বার

মন্তব্য: ০