Alapon

|| তাঁরা : বদলে দিয়েছে বদলে গিয়েছে-০৩



কাফিরদের নির্যাতন আর নির্মমতা থেকে রক্ষা পেতে, সুন্দর করে আল্লাহর ইবাদাত পালনের নিমিত্তে আল্লাহর রাসুলের অনুমতিক্রমে হিজরতের উদ্দেশ্যে হাবশায় রওয়ানা দিলেন তাঁরা।

যেতে যেতে অনেক দূর অবধি পৌঁছে গেলেন তাঁরা। পথেই তাদের কর্ণগোচর হলো যে, কুরাইশ গোত্রের সকলেই সন্তান-সংসার সমেত দ্বীনের ছায়াতলে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এই শুনেই তাদের সকলের মনে সৃষ্টি হয়েছে আনন্দের সুতীব্র আলোড়ন। তাই তাঁরা ভীষণ উচ্ছ্বাসে ভরা মন নিয়ে সঙ্গী-সাথিসমেত পুনরায় রওয়ানা দিলেন মাক্কাতুল মুকাররামায়।
.

কিন্তু একি! মাক্কার নিকটবর্তী এলাকায় পৌঁছেই তাঁরা জানতে পারেন এহেন সংবাদের কোনো সত্যতা নেই। এটা নিচক একটা গুজব! এখন এই পরিস্থিতিতে তাঁরা এতো এতো দূরের পথ হাবশায় কীভাবে আবারও প্রত্যাবর্তন করবেন, কিংবা কোন সাহসেই-বা মুশরিকদের থাবায় নিজেদেরকে নিবেদিত করে আবারও অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও জুলুমের জাঁতাকলে সপে দিবেন—এই যে এমন একটা সংকটময় মুহূর্ত; এহেন সংকটময় মুহূর্তে করণীয় কী—এইভাবনাটা তাঁদের ভয়াবহ রকমের অস্থির করে তুললো। এই দলের নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন আল্লাহর রাসুলের প্রিয়-প্রখ্যাত সাহাবি 'উসমান ইবনে মাজউন' রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। স্বাভাবিকভাবেই এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা-উদ্বীগ্নতা তার-ই বেশি হবার কথা!

যাই হোক, এক পর্যায়ে সকলেই গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলো নিজ নিজ মুশরিক স্বজনদের নিকটেই।
'উসমান ইবনে মাজউন' রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নিজেও ওয়ালিদ ইবনে মুগীরার নিরাপত্তায় প্রবেশ করেন মাক্কাতুল মুকাররামায়।

.

এই ওয়ালিদ ইবনে মুগীরা ছিলো প্রভাবশালী একজন মুশরিক নেতা। ছিলো একজন উঁচু মানের সাহিত্য সমালোচক এবং কবিও। মুশরিকদের এমন প্রভাবশালী নেতার হেফাজতে থাকার দরুন উসমান ইবনে মাজউন অন্যান্য মুশরিকদের নির্যাতন ও নিষ্পেষণ থেকে নিরাপদে রইলেন। রক্ষা পেলেন অন্যান্য জালিমদের জুলুমের জাঁতাকল থেকে। তিনি মুশরিকের সহায়তায় যাপন করেন নিরাপদ জীবন; অপরদিকে তার-ই ঈমানদার দ্বীনি ভাই-বন্ধুগণের ওপর চলছে তীব্র নির্যাতন-নিষ্পেণ; বিষয়টি ওনাকে দারুণ পিড়া দিতে লাগলো। তিনি শারীরিকভাবে সুখ-স্বস্তি এবং নিরাপদে থাকলেও মনের দিক থেকে একটুও সুখভোগ করতে পারছেন না। পাচ্ছেন না শান্তি-স্বস্তি।

মুশরিকের নিরাপত্তায় খুব ভালো দিন কাটানোটা ওনাকে মনের দিক থেকে অপরাধী করে তুললো। অপরাধবোধে ভুগতে লাগলেন খুব। অপরাধবোধে ওনার মনে সৃষ্টি হয়েছে দগদগে কিছু ক্ষত। প্রায়শই তিনি নিজেকে নিজেই তিরস্কারের তীক্ষ্ণ তীরে বিদ্ধ করতেন।

একপর্যায়ে তিনি ওয়ালিদ ইবনে মুগিরার আশ্রয় থেকে ভদ্রতা আর কৃতজ্ঞতাসহ সরে আসেন। ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা ভেবেছিলো তাঁকে কেউ কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু তিনি জানালেন—না, কেউই কষ্ট দেয় নি। তিনি আল্লাহর জিম্মায় নিজেকে রাখতে চান, এইছাড়া পৃথিবীর কারো থেকে কোনো উপকার-সহোযোগিতা ও ইহসান চান না!

.

এরপর এক সময় কা'বার চত্বরে দাঁড়িয়ে ওয়ালিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি মক্কার মুশরিকদের সামনে তাঁর নিজের ওপর থেকে ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা কর্তৃক ইহসান বা নিরাপত্তার রজ্জুটা খুলে ফেলার ঘোষণা দিলেন।

এখন দেখুন, একজন জাঁদ্‌রেল্‌ মুশরিক নেতার হেফাজতে নিরাপত্তার থাকার পরেও তিনি মর্মপীড়া অনুভব করেন তার অন্যান্য দ্বীনি ভাই-বোনদের জন্য। নিজে স্বস্তিতে থাকছেন, অথচ ঠিকই এই মুশরিকদের দ্বারাই অন্যান্য ভাই-বোন নিপীড়িত —এটা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। এই যে একটা সুখ আর আয়েসি এবং কাফিরদের নির্যাতনমুক্ত নিরাপদ জীবন ; এই জীবন তাঁকে পীড়া দিচ্ছিলো কেনো? কারণ, একজন মুসলিম নিজে নিরাপদ থাকবেন আর অন্যান্য মুসলিম ভাই-বোন নিপীড়িত হবেন তা তিনি মানতে পারছিলো না। আল্লাহর রাসুল স্বল্লালাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন প্রত্যেক মুসলিম একটা দেহের ন্যায়, দেহের এক অংশে কোনো কাঁটা বিধলে অন্য অংশ সেই ব্যথা অনুভব করেন। এই অনুভবটা-ই করেছেন তিনি। তাই তিনি মুশরিকের সহায়তায় সুখের জীবনকে মেনে নিতে পারেন নি। অন্যান্য ভাইদের মতো নিজেকেও আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের হেফাজতেই ছেড়ে দিলেন।

আমরা কী করি, ইচ্ছে করে আমার ভাইকে আল্লাহদ্রোহী শক্তির হাতে তুলে দিয়ে হলেও নিজের একটা দুর্দান্ত জীবন যাপন নিশ্চিত করি।
.

এরপর তিনি একদিন লাবিদ নামক এক বিখ্যাত মুশরিক কবির কবিতার মধ্যে শিরকিয়্যাতের জন্য তার কবিতার বিরোধিতা করেন। সে কারণে লাবিদ তাঁর বিরুদ্ধে উস্কে দেয় সাধারণ মুশরিকদের। এই উস্কানীর পরই অন্য আরেক মুশরিক ওনাকে স্বজরে ঘুষি মেরে নাক-চোখে আঘাত করেন। সেই আঘাতে ওনার চোখ কালো হয়ে যায়। রক্ত জমাট বেঁধে যায়।

.

তাঁর এই অবস্থা দেখে কেউ কেউ বলে ওঠেন যে, হে উসমান ইবনে মাজউন— ওয়ালিদের হেফাজতে তুমি তো এমন আঘাত আর আক্রমণ থেকে পূর্ণ নিরাপদই ছিলে। আজ যদি তার হেফাজতেই থাকতে তাহলে তো তোমার এই হাল হতো না। তোমার চক্ষুও সুস্থ থাকতো। তিনি তাদের জবাব দিলেন এই বলে যে, ‘আল্লাহর আশ্রয়-ই আমার জন্য সবচেয়ে অধিক নিরাপদ,তাঁর হেফাজত-ই বেশি সম্মানজনক।

.

এদিকে ওয়ালিদ ইবনে মুগিরাও পুনরায় জিজ্ঞেস করছে যে, তুমি কি আবার আমার হিফাজতে আসতে চাও?’ এবারও তিনি জানিয়ে দিলেন যে, ‘আল্লাহর হিফাজতই তাঁর জন্য যথেষ্ট।’

এখন দেখুন, আমরা কী করি, আমাদের ওপর সামান্য কিছু জুলুম নির্যাতন এসে ভর করলে আমরা জালিমের সাথে, আল্লাহদ্রোহী শক্তির সাথে নানাবিধ সন্ধি-সমঝোতা করে থাকি। দ্বীনের বিধান, ঈমান-আকিদা কম্প্রোমাইজ করে হলেও কাফিরের কোলে আশ্রয় গ্রহণ করি।

উসমান ইবনে মাজউন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর মতো আমরা কাফির-মুশরিকদের দয়া-দাক্ষিণ্য দৃঢ়তার সাথে ইগনোর করতে পারি না। অথচ তিনি পেরেছেন। আর এসব পেরেছেন বলেই তাঁরা পেরেছেন পৃথিবীকে বদলে দিতে। এবং নিজেরাও গিয়েছেন পুরোপুরি বদলে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা আমাদেরকে এভাবেই ঈমানের কমজোরি পরিত্যাগ করে দুর্দান্ত ঈমান নিয়ে বদলে যাওয়ার তাওফিক দান করুন। আ-মী-ন!!

|| তাঁরা : বদলে দিয়েছে বদলে গিয়েছে-০৩ ||
~ রেদওয়ান রাওয়াহা

পঠিত : ৩০৫ বার

মন্তব্য: ০