Alapon

বউ তুমি এমন কেন...?



[১]

"দোস্ত,বিয়ে কইরা জীবন ত্যানা ত্যানা হইয়া গেল রে।আমার বউ রে একটা কথা বললে সে আরও দুইলাইন বেশি বুঝে ঝগড়া শুরু করে।সেদিন বললাম,রান্নাটা দারুন হয়েছে।অন্যকেউ হলে খুশিতে গদগদ হয়ে যেত কিন্তু সে বললো,' আগে তো আমার রান্না ভালো লাগতো না সেটা বললেই পারেন।আমি সব বুঝি তো,আজ রহিমা সাহায্য করেছে বলে বেশি মজা লাগছে!'এরকম আরও কত কাহিনী আছে তোরে বলে শেষ করতে পারবো না, সাবিত ! "


লাবিবের কথা শুনে আমার কপাল বেয়ে চিকন ধারায় ঘাম গড়িয়ে পড়লো।কে বলবে এই ছেলে একসময় চিল মোডে থাকতো।কিন্তু বিয়ের দুমাস যেতেই তার চিল ইন্তেকাল করে ফেললো।আমিও তো বিয়ে করতে চাই কিন্তু লাবিবের কথা শুনে ভয় লাগছে।আমার বউটা যদি এরকম সব কথার লেজ বের করে ঝগড়া করে তাহলে আমার জীবন তো শেষ হয়ে যাবে।আমি আবার শান্তিপ্রিয় মানুষ।


ভাবনার মাঝে বিঘ্ন ঘটিয়ে লাবিব আবার বলতে লাগলো,'দোস্ত, ম্যাচিউর মেয়ে বিয়ে করাটা আসলে ঠিক হয় নাই।একটা বোকাসোকা বাচ্চামো স্বভাবের মেয়ে বিয়ে করলে জীবন সুখের হতো।কিছু হলেই হাতে চকলেট ধরিয়ে চুপ করিয়ে দিতাম।"


লাবিবের কথা শুনে চোখমুখ চকচক করে উঠলো খুশিতে।সত্যিই তো একটা বোকাসোকা মেয়ে বিয়ে করলেই তো আর এত প্যারা খাওয়া লাগবে না।কিন্তু আজকাল বাচ্চা মেয়েরাও অনেক চালাক,সিক্স সেভেনেই প্রেম শুরু করে।আমার বউ হতে হবে দ্বীনদার।ক্রাশ-প্রেম এগুলো থেকে বহুদূরে থাকতে হবে,হুম।


[২]

আজ মেয়ে দেখতে এসেছি আবার।এটা হল চল্লিশতম।কোথাও মনের মতো বোকাসোকা মেয়ে পেলাম না।মেয়ের নাম তিথি শুনেই পছন্দ হলো।তিথির সাথে কথা বলার আগে আমি তার ছোট ভাইয়ের সাথে কথা বলে নিলাম,ছোট মানুষ মিথ্যে বলবে না।সে বললো, তিথির প্রিয় খাবার চকলেট, রাগ করলেও ঝগড়া করে না,কান্না করলে চকলেট পেলে চুপ হয়ে যায়,কোন নায়ককে পছন্দ করে না,টিভিতে কার্টুন দেখে আর মোবাইলে শায়খদের লেকচার শুনে। তিথির বিবরণ শুনে আমার মনে হলো,হাতে যেন আস্ত চাঁদ পেয়েছি।কি নাই এই মেয়ের মধ্যে?যা যা চেয়েছি সব দ্বিগুন করে আছে। অতপর এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়েটা করেই ফেললাম।


বিয়ের পর আমার জীবন কি সুখময় না হলো।তিথি যেন মরুময় হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আসলো।কোন ঝামেলা করে না,সব সময় আমার কথা মেনে চলে।রাগ,কান্না, মন খারাপ যাই করুক না কেন চকলেট ধরিয়ে দিলেই প্রব্লেম সলভ।একদম বোকাসোকা বাচ্চাদের মতো।


কিন্তু বিয়ের একমাস পর দেখলাম,আমার প্রতি তিথির ভালোবাসা একটু মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে। পরপর তিনদিন একটানা সকালে করলার শরবত খাইয়েছে,দুপুরে -রাতে কিছু থাকুক না থাকুক তিতা করলা থাকবেই।জিজ্ঞেস করতেই বললো আমার স্বাস্থ্য যেন ভালো থাকে তাই এই ডায়েট ফলো করছে।বেশি না তিনদিন খেলেই নাকি শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যাবে।

বেচারি ভালোবাসার দোহাই দিয়ে আমায় এগুলো খাইয়ে দম নিলো। কিন্তু ঘটনা ছিলো অন্যকিছু। তিনদিন পর দেখি মেন্যুতে বিরিয়ানি আছে।আমি তো খুশিতে গদগদ করে খেলাম। কতদিন পর মনের মতো খাবার পেলাম, তৃপ্তির ঢেকুর তুলে তাকে বললাম,"বউ,তোমার রান্নায় জাদু আছে।এত অসাধারণ বিরিয়ানি জীবনে খাই নি।"


তিথি লজ্জারাঙা মুখে বললো, "সত্যি বলছেন?সেদিনের বিরিয়ানি থেকেও মজা হয়েছে?" আমি কিছুক্ষণ ভেবে জিজ্ঞেস করলাম, সে কোনদিনের কথা বলছে।আমার কথায় যেন সে দ্বিগুন খুশি হলো।তারপর হাসিমুখে বললো,


'আমি জানতাম আপনি সেদিনের বিরিয়ানির স্বাদ ভুলে যাবেন।এইজন্যেই তো তিনদিন তিতা করলা খাইয়েছি যাতে আপনি রিমা ভাবীর বিরিয়ানির কথা ভুলে যান।আমি চাই না, আমার স্বামী অন্যকারো রান্নায় পঞ্চমুখ হোক।' তিথির মুখে এমন কথা শুনেই বিষম খেলাম। এই মেয়ে তো দেখি বাচ্চাদের মতো মহা দুষ্টু। সেদিন বিরিয়ানি মজা হয়েছে বলায় আমায় তিনদিন ইনিয়েবিনিয়ে রাত-দিন তিতা করলা খাইয়েছে।আমি তো আর জানতাম না ওই বিরিয়ানি রিমা ভাবী রান্না করেছেন।রেগে কিছু বলাও যায় না,বললেই ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কান্না শুরু করে বলবে,'আপনাকে ভালোবাসি বলেই এত বকাঝকা করছেন?আমি তো আপনার ভালোবাসা পাওয়ার জন্যেই এমন করেছি।' এটাও ঠিক,আমার বউটা ভীষণ ভালোবাসে আমায়। যাহোক সেদিনের পর থেকে রান্না মজা হলে জিজ্ঞেস করে নিতাম রাঁধুনি কে।


[৩] আজ বিয়ের তিন মাস। তিথিকে বলেছি বাইরে ঘুরতে যাবো।কাজের চাপের আমার বউটা কে নিয়ে দুসপ্তাহ কোথাও যাওয়া হয়নি।পার্কের একটা বেঞ্চে তিথিকে বসিয়ে আমি গেলাম ফুচকা কিনতে। এসেই দেখি আমার বউয়ের হাবভাব কেমন জানি পরিবর্তন হয়ে গেল। নিকাবের আড়ালে লাল চোখ দেখেই বুঝে নিলাম সে কান্না করেছে কিন্তু কেন?হঠাৎ কি হলো? আমি ফুচকার প্লেট এগিয়ে দিতেই সে ঝাল মিশিয়ে একটা ফুচকা আমার মুখে পুরে হনহন করে হাটা শুরু করলো।


বাসায় এসেই দেখি বাচ্চাদের মতো কান্না করছে।আমি জিজ্ঞেস করতেই বললো, "আমায় কি বয়স্কা মহিলা মনে হয়?আমি কি আপনার বড় বোন?" এমন উদ্ভট প্রশ্নে খানিকের জন্যে চুপ করে গেলাম।

তিথির মুখে চকলেট ঢুকিয়ে খানিক শান্ত করলাম তাকে। সে চকলেট খেতে খেতে বললো,

" আপনার কোন বন্ধুর বোনের সাথে দেখা হলো পার্কে।নাম দিয়া না টিয়া একটা হবে।ওই মেয়ে বলে আপনার উপর ক্রাশ খেয়েছে, আমাকে আপনার বড় বোন ভেবে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। "

কথাটা বলেই কান্না শুরু করলো। এই দিয়া মেয়েটা আস্ত একটা ফাজিল। আমার সংসারে আগুন লাগানোর জন্যে ইচ্ছে করেই এমন করেছে যাতে রিজেক্ট করার প্রতিশোধ নিতে পারে। আমি তিথিকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে চুপ করালাম।তাকে বললাম মাথা থেকে এই চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে।


রাতে এসে দেখি আমার বউ কাপড় ভাজ করছে।কিন্তু আমার নীল আর কালো পাঞ্জাবীগুলো পলিথিনে ঢুকাচ্ছে কেন?আমি হন্তদন্ত হয়ে কারণ জিজ্ঞেস করলাম।সে বললো,

' আজকে থেকে এই দুই রঙের কাপড় পড়া যাবেনা।এই দুই রঙের জামাতে আপনাকে বেশি সুন্দর লাগে।আজকে ওই মেয়ে ক্রাশ খেয়েছে অন্যদিন আরেকজন খাবে।আমি কোন রিস্ক নিতে চাই না।' এতটুকু একটা কারণে সে আমার প্রিয় পাঞ্জাবিগুলো ফকির কে দিয়ে দিবে ভাবতেই রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।রেগে নিষেধ করার সাথে সাথেই কান্না শুরু করে বললো,


"হ্যাঁ, এখন আমাকে ভালো লাগবে না তো।আপনাকে ভালোবাসি বলেই এত বকাঝকা করেন।" আমি আবার তাকে শান্ত করাতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।আসলেই বউটা আমায় ভীষণ ভালোবাসে।


[৪] রাতে লাবিব কল দিয়ে হাসতে হাসতে বললো,'দোস্ত তুই কি ফিল্মের হিরো নাকি?মেয়েরা নাকি তোর জন্যে পাগল হয়ে যাচ্ছে।আমার ভাবী তো দেখি হেব্বি টেনশনে আছেন তোরে নিয়া!"


লাবিবের কথার আগা মাথা না বুঝে তাকে জিজ্ঞেস করলাম এমন কথার কারণ কী।সে যা বললো, তা শুনে আমার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হতে লাগলো।আমার বউ ফেবুতে আমায় ট্যাগ করে পোস্ট দিল,


"উনি হলেন আমার স্বামী আর আমি উনার একমাত্র বউ।উনার কোন বড় বোন নাই। আমার স্বামীর দিকে কেউ নজর দিবেন না।আপুরা দয়া করে অন্য পাত্র খুঁজেন।আর যারা জেনে শুনে আমার স্বামীর উপর ক্রাশ খাচ্ছেন তাদের বলছি,তওবা করে নিয়েন।ভুলেও যদি আর নজর দেন তাহলে চোখে ছানি পড়বে বলে দিলুম।অন্যের স্বামীর উপর নজর দেওয়া বন্ধ করুন।"


হায় আল্লাহ! পোস্টে দেখি হাহার ছড়াছড়ি। একেকজনে একেক কথা বলছে।তাড়াতাড়ি তিথিকে ডেকে পোস্ট ডিলিট করতে বলায় সে বলে দিল,এটা আজীবন থাকবে।এটা নাকি সেইফটি।আমি বুঝি না এই মেয়ের বাচ্চামোর জন্যে আমারে আর কত অপমানিত হতে হবে।রেগেমেগে কিছু বলার আগেই কান্না শুরু করে দেয়।তার সব কাজের পিছনে একটাই কারন তা হলো ভালোবাসা।এই মেয়ে এত বেশি ভালোবাসে কেন?


[৪] "দোস্ত, আমার জীবনের মুড়িঘণ্ট হয়ে গেল রে।আমার বউরে কে বলছে,এত ভালোবাসতে। আমার বউটা এমন কেন, লাবিব?" হতাশার সুরে নিজের কষ্টগুলো বলতে লাগলাম তাকে।বিয়ের ছমাস পরে আসলেই মনে হচ্ছে আমি একটা জেলখানায় বন্ধী।


"দোস্ত, তোর বউ এর মতো ভালো মেয়ে আর আছে দুনিয়ায়?আমার বউরে দেখ,কথায় কথায় ঝগড়া আর সন্দেহ করে।সুন্দর লাগছে বললেও দোষ,বান্দর লাগছে বললে মহাদোষ।যাই বলি না কেন সবকিছুতেই আমার দোষ। তোর বউ তাও ঝগড়া করে না,তোরে একটু বেশি ভালোবাসে বলে এত কেয়ার করে।" লাবিবের কথা শুনে মাথাটা দপ করে গরম হয়ে গেল।


“ ভাবী তাও ঝগড়া করে ব্যাপার খতম করে দেয়।কিন্তু আমার বউ তো ঝগড়া করবে না।সে ঘটনা এটারে পেটের মধ্যে জমিয়ে এর সমাধান বের করবে।যার ফলস্বরূপ আমার ইজ্জতের রফাদফা হয়ে যাবে।তুই জানিস, সেদিন তার কোন বান্ধবী আমার ছবি দেখে বললো আমার চুল নাকি সুন্দর।ব্যস, এই মাইয়্যা পরের দিন আমারে ব্ল্যাকমেইল কইরা ন্যাড়া করে দিল।কিছু বলতেও পারি না,বললেই ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কান্না শুরু করে।"


লাবিব একরাশ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

"দোস্ত আমার বউ এত বেশি বুঝে কেন?”


আমিও আক্ষেপের সুরে বললাম,“ আমার বউ এত ভালোবাসে কেন,এত অবুঝ কেন দোস্ত?"


“ চিরকুমার সংঘ হতে নাম কাটাইলা কেন?”

সামনে দেখি মাজহার ভাই দাঁড়িয়ে আছেন।দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে হাসছেন।


আমি আর লাবিব কিছু না বলে আকাশ দেখছি,আর উনি আমাদের কাঁধে হাত রেখে বলছেন,

“ থাক,মানুষ মাত্রই ভুল করে।আফসোস কইরা লাভ আছে?লাভ নাই।”

- জান্নাতুল ফেরদৌস ফাইজা

পঠিত : ১৩৬৯ বার

মন্তব্য: ০