Alapon

মাওলানা মওদূদীর সাথে সাক্ষাৎকার

.
সুদানের প্রফেসর ড. মালিক বদরী হাফি. এ যুগের অন্যতম একজন মনস্তত্ত্ববিদ। শুধু এতটুকুই উনার পরিচয়ের জন্য যথেষ্ট নয়। বরং তিনি মনস্তত্ত্বের মত জটিল একটি বিষয়ের ‘ইসলামিকরণ’ এর সর্বপ্রথম অগ্রদূত। বিংশ শতকে বিশেষ করে ফ্রয়েডের পর থেকে মনস্তত্ত্ব পাশ্চাত্যের কাছে ধর্মের মত মর্যাদা পায়। তাছাড়া বিষয়টি সত্যিই ভীষণ Crucial, মানুষের ওয়ার্ল্ডভিউয়ের অন্যতম ভিত্তি মানুষ ও মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা। যদি কোনোভাবে এই উপাদানটিকে বদলে দেওয়া যায় তবে গোটা ওয়ার্ল্ডভিউ পাল্টানো কেবল সময়ের ব্যাপার। তো ইসলামের মৌলতত্ত্ব অনুযায়ী মনস্তত্ত্বের ধারা বদলানোর ব্যাপারে ড. মালিক বদরীর ভূমিকা অত্যন্ত দৃঢ়। ড. বদরীর ছোট একটি লেখা আছে উনার সাথে মাওলানা মওদূদীর স্মৃতিচারণ বিষয়ে। বাহিরের দেশ এবং ইখওয়ানুল মুসলিমীন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা ড. বদরীর মাওলানা মওদূদীর ব্যাপারে মতামত বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
.
ড. বদরী তখন বৈরুতের অ্যামেরিকান ইউনিভার্সিটিতে পড়ছেন, সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টে। একদিক থেকে খ্রিস্টানদের অকারণ উৎপাত আরেকদিকে মর্ডানিটির সংস্কৃতিগত ও জ্ঞানগত চাপ যুবক বদরীর মনে দ্বন্দ্ব তৈরী করেছিলো। তিনি ওইসময়ই মুহাম্মাদ কুতুবের ‘শুবুহাত হাওলাল ইসলাম’ (বঙ্গানুবাদঃ ভ্রান্তির বেড়াজালে ইসলাম) বইটি পড়েছিলেন। এরপর তিনি প্রথমবারের মত মাওলানা মওদূদীর ‘রিসালায়ে দ্বীনিয়াত’ (ইংরেজীতে Towards Understanding Islam ও বাংলায় ‘ইসলাম পরিচিতি’ নামে অনূদিত, ড. বদরী ইংরেজীটাই পড়েছিলেন)। এ বইটি পড়ে ড. বদরী অন্তরে এক আশ্চর্য পরিবর্তন অনুভব করেন, তাঁর ভাষায়,
.
“এ বইটির প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা পড়েই ইসলাম সম্পর্কে এতদিনের আমার ধারণা সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেলো। মহাবিশ্বের সকল কিছুই আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট পরিকল্পনায় আবদ্ধ আছে। সূর্য, চন্দ্র, তারকা, ঘূর্ণায়মান পৃথিবী সকল কিছুই নির্দিষ্ট অক্ষে রয়েছে। মানবাঙ্গ থেকে শুরু করে মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের ক্ষুদ্রতম কোষ পর্যন্ত আল্লাহর নির্ধারিত আইনের জালে বন্দি......এসব কথাবার্তা অনেকের কাছে আবেগহীন কথা মনে হলেও তা আমার গোটা বিশ্বদৃষ্টি পরিবর্তন করে দিলো। যুবক বয়সে Towards Understanding Islam পড়ার মাধ্যমেই যেন আমার প্রকৃত ইসলামে প্রত্যাবর্তন ঘটলো.........এর মাধ্যমে আমার পূর্বেকার সংশয় দূর হয়ে গেলো।”
.
ওপরের ঘটনার মাধ্যমে ড. বদরীর বুঝে আসলো ইখওয়ানুল মুসলিমীনের মাঝে জ্ঞানগত ও ব্যবহারিক ইসলামি আচরণের ক্ষেত্রে বেশ দুর্বলতা রয়েছে। এরপর সত্তরের দশকে তিনি ইখওয়ানুল মুসলিমীনের বেশ কিছু পদক্ষেপের কঠিন বিরোধীতা করলেন। এরপর তিনি মাওলানা মওদূদীর সাথে চিঠি মারফত যোগাযোগ বাড়াতে লাগলেন। ১৯৬৮ সালে তিনি সরাসরি মাওলানার সাথে দেখা করার জন্য পাকিস্তানে গেলেন। মাওলানা মওদূদীকে তিনি সরাসরি দ্বিতীয়বারের মত দেখছিলেন, তবে সরাসরি সাক্ষাত ওটাই প্রথমবারের মত ছিলো। মাওলানা সম্পর্কে উনার অভিমত ছিলো,
.
“তিনি যদিও সুদর্শন ও সৌম্য ছিলেন, তবুও সেই বয়সে (তখন মাওলানার বয়স ৬৫) তাঁর দৃঢ়চেতা ও শান্ত-আকর্ষণীয় নেতা হিসেবে আমাদের হৃদয় কেড়েছিলেন.........বয়সের ভার ও অসুস্থতা নিয়েই সেই মহান ব্যক্তিত্ব ১৯৬৮ সালের সেইদিনে বারান্দায় আমাদের সামনে বসেছিলেন, অবশ্য আমার কাছে তাঁকে মনে হচ্ছিলো যেন আধ্যাত্মিকতা ও দুনিয়াবিমুখতার জীবন্ত প্রতিচ্ছবিস্বরুপ ভারতীয় কোনো সাধক।” .
.
তিনি আরও বলেন,
.
“পূর্ববর্তী মহান মুসলিমদের জীবনী পড়ার সময় মাঝেমাঝে মনে হয় তাঁর ছাত্র-ভক্তরা মনে হয় একটু বাড়িয়ে বাড়িয়ে এসব লিখেছেন। মাওলানা মওদূদীর জীবনী পড়ার সময় ভবিষ্যত প্রজন্ম হয়ত এমনটাই অনুভব করতে পারে, কেননা তাঁর জীবনও এতটাই প্রকৃষ্ট ও অনুসরণীয়। ইছড়ায় থাকাকালীন যতটুকু সময় আমরা তাঁর সাথে ছিলাম আমরা উনাকে এসব ঘটনা সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছিলাম। ইসলামি আন্দোলনের অন্য কোনো নেতাকে আমি জানি না যিনি দুনিয়ার ওপর আখিরাতকে এভাবে প্রাধান্য দিতেন এবং যার মাঝে আল্লাহভীতি ও সমর্পণ এত প্রবল ছিলো। এমন কোনো লোকের কথা আমি জানি না যিনি যা বিশ্বাস করতেন তাকে প্রয়োগের ব্যাপারে এতটা সচেতন ছিলেন।.........নিশ্চয়ই দারিদ্র নয় বরং যুহদ বা দুনিয়াবিমুখতার কারণেই তিনি এ ধরণের (গরিবী) জীবন বেছে নিয়েছিলেন। তিনি চাইলেই পারতেন পাকিস্তানের সবচাইতে ধনী আলিম হতে......কিন্তু ১৫০ টি বইয়ের মাঝে দুটি ছাড়া অন্য সকল বই থেকে অর্জিত সকল অর্থ তিনি আন্দোলনের জন্যই ব্যয় করেছিলেন।”
.
মাওলানা মওদূদীর নেতৃত্বের দিকের সাথে তিনি ইমাম হাসানুল বান্নার তুলনা করেছেন এবং তিনি মাওলানা মওদূদী ও তাঁর দলের গোটা সিস্টেমের সাংগঠনিক হায়ারার্কিকে প্রাধান্য দেন। ইমাম হাসানুল বান্নার নেতৃত্ব পরিত্যাগের পর তাঁর অনুসারীদের ‘উগ্র’ আচরণ আর মাওলানা মওদূদীর পরিত্যাগের পর অন্যদের ‘সভ্য’ আচরণ দুটি ইসলামি আন্দোলনের মাঝে এক দৃশ্যমান পার্থক্য। অবশ্য মাওলানার মধ্যে যে ‘বাহ্যিক আত্মশুদ্ধিতা’-এর অভাব যে পরিলক্ষিত হত এ বিষয়টা তিনি লক্ষ করেন। এ কারণে তাঁর সমালোচনাও করেন এবং তা যৌক্তিকও বটে। তবে তিনি

আজীবন মাওলানার প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ ছিলেন। এমনকি ড. বদরীর ‘ইসলামি মনস্তত্ত্ব’-এর প্রথম বই ‘Islam and Alcoholism’ ও ‘Muslim Psychologists in Dilemma’ বই দুটি মাওলানার নামে ইহদা করেন। মাওলানার সম্পর্কে ড. বদরীর গোটা মূল্যায়নটুকু পড়ে দেখার মত। আগ্রহীরা চাইলে ‘A Tribute to Mawlana Mawdudi from an Autobiographical Point of View’ প্রবন্ধটি পড়ে দেখতে পারেন।

পঠিত : ২৭৫ বার

মন্তব্য: ০