Alapon

সাহিত্য সম্রাটকে জানাই জন্মদিনে শুভেচ্ছা


১৯৭০ সাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীষ্মকালীণ ছুটি দেওয়া হল। প্রায় সবাই যে যার মত বাড়ি চলে গেল। শুধু রয়ে গেল গুটি কতক ছাত্র। শহীদুল্লাহ হলের হুমায়ূনও তার জন্মস্থান নেত্রকোনা চলে গেল।


সেইদিন নেত্রকোনায় প্রায় সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল। সেই বৃষ্টিতে ভিজেই সন্ধ্যায়, হুমায়ূন বাড়ি পৌঁছাল। শরীর মাথা মুছে মায়ের সঙ্গে গল্প করতে বসে গেল। এরপর খাওয়া দাওয়া করে ঘুমানোর জন্য শুয়ে পড়ল। বাহিরে তখনও বৃষ্টি হচ্ছিল। কিন্তু এমন একটি দিনে হুমায়ূনের চোখে ঘুম নেই। তাই মাঝরাতে খাতা কলম নিয়ে লিখতে বসে গেল হুমায়ূন। সেই শুরু! এভাবে মাত্র তিন দিনেই সে একটি উপন্যাস লিখে ফেলল। সেই উপন্যাসটির নাম ‘নন্দিত নরকে’।


এতোক্ষণে নিশ্চই বুঝে ফেলেছেন, আমি জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ এর কথা বলছি। এই জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিকের প্রথম উপন্যাসের জন্মটি ঠিক এভাবেই হয়েছিল। এরপর ছুটি শেষ হলে ‍হুমায়ূন আহমেদ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন।


দেশ স্বাধীনের পরের কথা। তখন হুমায়ূন আহমেদ সহ আর কতক তরুণ আহমদ ছফার বিশেষ ভক্ত ছিলেন। তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে আহমদ ছফা প্রায় রাতেই হাটতে বের হতেন। তার এই হাটাহাটির কারণে হুমায়ূন আহমেদ তাকে ‘হন্টন পীর’ বলতেন। একদিন এই হন্টন পীর আহমদ ছফা হুমায়ূন আহমেদ এর প্রথম উপন্যাসের পান্ডুলিপিটি দেখে ফেলেন। তারপর আহমদ ছফা পান্ডুলিপিতে আবদ্ধ থাকা ‘নন্দিত নরকে’ উপন্যাসটি বই আকারে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। বাংলাবাজারের খান এন্ড ব্রাদার্স প্রকাশনী থেকে ‍প্রকাশিত হয় হুমায়ূন আহমেদ এর প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’।


তারপর থেকেই তিনি উপহার দিয়েছেন, একের পর এক বেষ্ট সেলার বই। তিনি উপহার দিয়েছেন বেশ কিছু চরিত্র। যে চরিত্রগুলো আজও সাধারণ মানুষ এবং অগণিত তরুণের মাঝে বেঁচে আছে।


১৯৯০ সালে বিটিভিতে হুমায়ূন আহমেদ এর একটি ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হত। নাটকটির নাম ছিল ‘কোথাও কেউ নেই’। নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্রটির নাম ছিল বাকের ভাই। নাটকটির শেষ পর্বে দেখা যায়, ‘দূর থেকে ফজরের আযান ভেসে আসছে আর ঠিক সেই মুহুর্তে বাকের ভাইকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসি দেওয়া হচ্ছে। নাটকটিতে দেখানো হয়, বাকের ভাই বন্ধনহীন মানুষ। তার বাবা-মা কেউই নেই। যদিও তা নাটক ছিল কিন্তু বাকের ভাই এর ফাঁসির মধ্য দিয়ে কেঁদে উঠেছিল সমগ্র বাংলাদেশ।


পৃথিবীর ইতিহাসে আর কখনো এমন হয়েছে কিনা আমি জানি না, কিন্তু ঐ দিন রাতে ঢাকা শহরের রাস্তায় মিছিল বেরিয়েছিল। বাকের ভাই এর ফাঁসির বিরুদ্ধে মিছিল। এবং এক পর্যায়ে উত্তেজিত জনতা লেখক হুমায়ূন আহমেদ এর বাড়িতে আক্রমন চালায়।
এতো গেল বাকের ভাই চরিত্রের কথা। হুমায়ূন আহমেদ এর সৃষ্টি আর একটি অনবদ্য চরিত্রের নাম হিমু। হিমু নামক এই চরিত্রটিকে লেখক বই এর পাতায় অঙ্কিত করলেও, মাঝরাতে খেয়াল করলে দেখা যাবে ঢাকার রাস্তায় হিমু বেশ কত তরুণই ঘুরছে। আর কোন তরুণী হিমুর রূপা হবার প্রতিক্ষায় দিন গুনছে।


আমরা সেই প্রতিক্ষায় না থেকে এবার একটু লজিকের দিকে যাই। এই লজিকের নাম হচ্ছে মিসির আলী। এই অনবদ্য চরিত্রটিকে রূপ দান করেছেন একই ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ।


হুমায়ূন আহমেদ এভাবেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন, সেই সাথে বাংলা সাহিত্যের বাজারকে মৌলিকত্ব দান করেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে আহমদ ছফা আফসোস করে বলেছিলেন, ‘লাইব্রেরী গুলোর তাকে তাকে ভীড় করছে পশ্চিমবঙ্গের চন্দ্র-মন্দ্র লেখকরা। সেই বইগুলোর এক ফাকে জর্জরিত অবস্থায় পড়ে আছে আমার দেশের সাহিত্যিকদের বই।’


সেই অবস্থা থেকে বাংলা সাহিত্যকে পরমুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্তিদান করেছেন, এই হুমায়ূন আহমেদ। সবাই যখন পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের পিছনে ছুটতে ব্যস্ত তখন হুমায়ূন ব্যস্ত ছিলেন আপন গন্তব্যের পথ পরিষ্কারে ব্যস্ত। দেশের সাহিত্যের বাজারকে বাংলাদেশ মুখি করাতে ব্যস্ত। তাই তো তার হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য নতুন করে পথ চলার দিশা খুঁজে পেয়েছে।


খ্যাতিমান এবং মহাশক্তিমান এই লেখকের জন্মদিনে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা।


পঠিত : ৬২৩ বার

মন্তব্য: ০