Alapon

মাওলানা আকরাম খাঁ




১৮৬৮ সাল থেকে ১৯৬৮, কাটায়-কাটায় একশো বছরের হায়াত পেয়েছিলেন মাওলানা আকরাম খাঁ (রাহিমাহুল্লাহ)। শতবর্ষী এই মানুষের কোন পরিচয়টা দেবো আর কোন পরিচয়টাই বা বাদ দেবো? রাজনীতির মাঠে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, শোষণের বিরুদ্ধে কলম সৈনিকের ভূমিকা পালন করেছেন, নববী ইলমের উত্তরসূরী হিশেবে পথ দেখিয়েছেন সমাজকে।
সাংবাদিক হিশেবে তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। তিনি যেনতেন সাংবাদিক ছিলেন না; তাঁকে ডাকা হতো ‘সাংবাদিকতার দাদাপীর’ বলে। ১৯০৩ সালে মাত্র ৫১ টাকার সম্বল নিয়ে শুরু করেছিলেন ‘মাসিক মোহাম্মদী’ পত্রিকা। বাংলার শিক্ষিত মুসলিমদের ইলম অর্জন করার অন্যতম মাধ্যম ছিলো এই পত্রিকা।
পত্রিকাটি প্রকাশ করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার বৃটিশদের তোপের মুখে পড়েন। কয়েকবার কারাবরণও করেন। কিন্তু কখনো দমে যাননি। শতো বাধা তাঁর মনোবলকে থামাতে পারেনি। যে ঘোড়া একবার দৌড়াতে শুরু করেছে, তাকে কি সহজে থামানো যায়?
যে পত্রিকা থেকে শোষণের কথা প্রাচারিত হচ্ছে, মজলুমদের আর্তনাদ শুনানো হচ্ছে, ইনসাফের কথা বলা হচ্ছে, শাসকশ্রেণী কি তা সহজে মেনে নিবে? সরকার বাজেয়াপ্ত করা শুরু করলো তাঁর পত্রিকা। কিন্তু তাতে কী? এক পত্রিকা বাজেয়াপ্ত করা হলে তিনি শুরু করেন আরেক পত্রিকা। এক পত্রিকায় কাজ করতে গিয়ে বাঁধার সম্মুখীন হলে, চলে যান আরেক পত্রিকায়।
সাপ্তাহিক মোহাম্মদী, দৈনিক মোহাম্মদী, দৈনিক জামানা, দৈনিক সেবক, দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ছিলো তাঁর বিচরণ। যুগের চাহিদার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে তিনি কিনে নেন মাওলানা মোহাম্মদ আলীর ইংরেজি ‘সাপ্তাহিক কমরেড (Comrade)’ পত্রিকা।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। অকুতোভয় কলম সৈনিকের ভূমিকা তিনি আজীবন পালন করে যান। বাতিলের কাছে, যালিমের কাছে কখনো নতী স্বীকার করেননি। ব্রিটিশ সরকার তাদের নীতির সমর্থনে তাঁকে লিখতে বললো। ব্রিটিশদের পক্ষে না লিখলে তাঁকে গুলি করে হত্যার হুমকি দেওয়া হলো।
রবীন্দ্রনাথ আর আকরাম খাঁ একই বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ব্রিটিশদের তবেদারী করলেও দেখুন আকরাম খাঁ ব্রিটিশদের হুমকির জবাবে কী বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলেন...
“দেখুন জনাব, আমি জীবনে অনেকবার শিকার করেছি। বন্দুকের গুলিতে অনেক পাখি মেরেছি। আমার উপর গুলি নিক্ষেপ হলে আমি মারা যাবো, সেটা আমি ভালোভাবেই জানি। কিন্তু আপনি জেনে রাখুন, আমাকে বন্দুকের গুলিতে শহীদ করা হলে, আমার শরীর থেকে যতো রক্তবিন্দু গড়িয়ে পড়বে, বাংলার বুকে ততো আকরাম খাঁ-র জন্ম হবে।”
তাঁর সময়ে অনেকে ইসলামকে ‘সেকেলে’ ভাবতো। শিখা আন্দোলন নামে উত্থান ঘটে নব্য মুতাজিলাপন্থী সম্প্রদায়। ইউরোপীয় চিন্তাচেতনাকে তারা স্ট্যান্ডার্ড ধরে ইসলামকে ব্যাকডেটেড, অযৌক্তিক ভাবতো। ঠিক সেই সময় তিনি কলম ধরেছিলেন, যুক্তির জবাবে পাল্টা যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন- ইসলাম কোনো সেকেলে ধর্ম না।
তাঁর বিখ্যাত ‘সমস্যা ও সমাধান’ বইয়ে তিনি লিখেন-
“যাহা ইসলাম তা অচল নয়, যা অচল তা ইসলাম নয়।”
বাংলা ভাষায় মৌলিক কোনো তাফসীর, সীরাত গ্রন্থের কথা বলতে গেলে সর্বাগ্রে চলে আসে মাওলানা আকরাম খাঁ-র ‘মোস্তফা চরিত’ এবং তাঁর রচিত তাফসীর।
১৮৬৮ সালের ৭ জুন মাওলানা আকরাম খাঁ পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার হাকিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

তথ্যসূত্র:
১। উত্তর আধুনিক মুসলিম মন – ফাহমিদ উর রহমান।
২। মাসিক আত-তাহরীক, অক্টোবর ১৯৯৮।

-আরিফুল ইসলাম

পঠিত : ৫৯১ বার

মন্তব্য: ০