Alapon

|| শি'য়াদের নিয়ে আমাদের মনে যত শঙ্কা || .



আমাদের অনেকেই মনে করেন, শি'য়াদের ব্যাপারে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করা বেশ কঠিন। এজন্য তাঁরা এ বিষয়ে একটুও মাথা ঘামাতে চান না। এর পেছনে অবশ্য বেশ কিছু কারণও আছে।
.

এক. অজ্ঞতা ও মূর্খতা :

অনেক মুসলমান আছেন, যারা শি'য়া মতাদর্শ সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাই রাখেন না। বলতে গেলে এ বিষয়ে তাঁরা একেবারেই অজ্ঞ। শি'য়াদের উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, অতীত কর্মপন্থা কিংবা ভবিষ্যত পরিকল্পনা সবই তাদের কাছে অজানা। আবার, অনেকের বিশ্বাস হানাফী, শাফিয়ী, মালিকী বা হাম্বালী মাযহাবের মতো শি'য়া মতাদর্শও শরীয়তসম্মত কোনো চিন্তাধারা বুঝি। তাঁরা আদৌ জানেন না শি'য়া-সুন্নী মতপার্থক্য কেবল ইসলামের শাখাগত বিষয়ে নয়; বরং মৌলিক তথা আকীদাগত বিষয়েও রয়েছে বিস্তর বিরোধ।
.

দুই. বাস্তবতা-বিমুখতা :

অনেক ভাই আছেন যাদের বাস্তবতা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান বা উপলব্ধি নেই। বরাবরই তাঁরা কল্পনাপ্রসূত কথাবার্তা বলে থাকেন। তাদেরকে সকাল-বিকাল ঐক্যের ডাক দিতে দেখা যায়। বাহ্যত তাদের কথা বেশ ভালোই শোনায়। তাঁরা বলেন, আমরা নিজেরা নিজেদের থেকে কেন দূরে থাকছি !? চলুন না, শি'য়া-সুন্নী ভেদাভেদ-মতবিরোধ ভুলে একসঙ্গে বসি, হাতে হাত রেখে চলি; আমাদের সকলেই তো আল্লাহ, তাঁর রাসুল এবং পরকালে বিশ্বাসী, তাহলে আর সমস্যা কী ?!

তাঁরা আসলে ভুলে যান এভাবে বলা যতটা সহজ, বাস্তবতা মোটেও ততটা সহজ নয়। যেমন: কেউ যদি তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে, আবার মদ-যিনাকেও হালাল মনে করে, তবে তাকে 'কাফির'ই বলা হবে। কারণ এমন সব 'হারাম'কে 'হালাল' জ্ঞান করা, কুরআন-হাদিস অস্বীকার করার নামান্তর-- যাতে মুমিন কাফিরে পরিণত হয়।

যদি আমরা এ বিষয়টি বিবেচনায় সামনে রেখে আগাই, তবে শি'য়া মতাদর্শে এমন অসংখ্য বিষয় দেখতে পাবো, যাতে আলিমদের নির্দেশনার প্রয়োজন পড়বে। শি'য়াদের ভয়ঙ্কর বিদ'আত থেকে প্রকৃত ধর্মীয় বিধান পৃথক করার ক্ষেত্রে এর কোনো বিকল্প নেই।

.

তিন. অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ও বাইরের শত্রুতা :

দুঃখজনক হলেও সত্য পৃথিবীর বহু দেশে মুসলিমরা পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত। ওদিকে ইহুদী, খ্রিষ্টান, কমিউনিস্ট, হিন্দু ইত্যাদি জাতীয় শত্রুতার কথা তো বলাই বাহুল্য। এজন্য সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন, নতুন করে আর কোনো ঝামেলা সৃষ্টি না হোক।
কিন্তু তাদের এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারত তখন, যখন শি'য়াদের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক বজায় থাকত; আর আমরা নতুন কোনো সমস্যা সৃষ্টি করতে চাইতাম। অথচ বাস্তবতা হলো, তাদের সাথে আমাদের সংঘর্ষ লেগেই আছে; তাঁরা আমাদের ওপর রীতিমতো আক্রমণও করছে।

অনেকে আবার প্রশ্ন করে, "শি'য়ারা কি ইহুদীদের চেয়েও ভয়ঙ্কর ?"। তাদের এ প্রশ্ন নিঃসন্দেহে অবান্তর। কেননা এসব প্রশ্নের উদ্দেশ্য কেবল মুসলিম উম্মাহর হিম্মত ও সাহস বৃদ্ধির পথে কাঁটা বিছানো, নিজেদের রক্ষা ও মুক্তির সংগ্রামে বাধা হয়ে দাঁড়ানো। তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলি, একই সময়ে একাধিক শত্রুর মুকাবিলা করতে কি মুসলিম জাতি অক্ষম ? তাছাড়া সুন্নী মুসলমানরা কি আগ বেড়ে শি'য়াদের ওপর কখনো হামলা করেছে বা হামলার জন্য কোনো ছুঁতো (কারণ) খুঁজেছে ? নাকি তাদের পক্ষ থেকেই ক্রমাগত আক্রমণ আরম্ভ হওয়ার অসংখ্য প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে ? 'জাবহাতু উলামায়িল মুসলিমিন আস সুন্নাহ' এর মহাসচিব হারিস আদ দারির দেওয়া তথ্যমতে, শুধু ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত শি'য়াদের হাতে এক লাখেরও বেশি সুন্নী মুসলিম প্রাণ হারিয়েছে !

সব মিলিয়ে আমার মনে হয় না তাদের অতীত ও বর্তমানের মাঝে খুব বেশি ব্যবধান রয়েছে। আমি জোর দিয়েই বলতে চাই, 'ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে, উত্তরসূরীরা পূর্বসূরীদের পদাঙ্কই অনুসরণ করে'। হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া সাহাবীদের গোটা প্রজন্মের প্রতি যারা 'কুধারণা' রাখে, তাদের মাঝে আমরা ঠিক কীভাবে ভালো কিছু আশা করতে পারি ? অথচ সাহাবীদের প্রতি মন্দ ধারণা রাখা রাসুল (ﷺ) এর হাদিসের স্পষ্ট বিরোধিতা। তিনি বলেন, "আমার এ প্রজন্মই সর্বশ্রেষ্ঠ"। [সহিহ বুখারি: ৩৪৫১; সহিহ মুসলিম: ২৫৩৩]
তাঁরা এই হাদিসকে সরাসরি অস্বীকার করে, অথচ হাদিসটি বুখারি, মুসলিমসহ অসংখ্য হাদিসগ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। শুধু অতীতের নয়, বর্তমান শি'য়াদের অবস্থাও যারপরনাই দুঃখজনক....!

রাসুল (ﷺ) এর সকল সাহাবী তথা আবু বাকর সিদ্দীক, উমার ফারুক, উসমান যিন-নূরাইন, উম্মাহাতুল মু'মিনীন বিশেষঃত আয়িশা (রদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে নিয়ে সাহাবাদের এ পুরো প্রজন্মের প্রতি শি'য়াদের অবস্থান কী -তা কারো অজানা নয়। তাদের প্রামাণ্যগ্রন্থ, তথ্যসূত্র ও আকীদা-বিশ্বাস ঘাটলে দেখা যায়, এই মহান প্রজন্মের সকলকে ঢালাওভাবে তাঁরা হয়তো 'ফাসিক' সাব্যস্ত করেছে আর নয়তো 'মুরতাদ' বলেছে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী ইসলামের বিধান গোপন ও বিকৃত করার অপরাধে তাঁরা সকলেই পথভ্রষ্ট। পাঠক, এবার আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই, এরপরেও কি আপনার কাছে উদারপন্থীদের কথা অনুযায়ী ফিতনার ভয়ে চুপ থাকাই শ্রেয় মনে হয়? বলুন তো, সাহাবীদের মতো শ্রেষ্ঠ প্রজন্মের প্রতি এমন জঘন্য ও মিথ্যা অপবাদ আরোপ করার চেয়ে ভয়ঙ্কর ফিতনা আর কী হতে পারে?
আমরা তো সাহাবীদের মাধ্যমেই দ্বীন পেয়েছি। তো, যাদের মাধ্যমে আমরা দ্বীন পেলাম, যদি তাদেরকেই সন্দেহের চোখে দেখা হয়, তাদের আমল-আখলাক নিয়ে আপত্তি তোলা যায়, তাহলে আমরা কেমন দ্বীনের অনুসরণ করছি?
সহজ কথায় ওইসব আপত্তি মেনে নেওয়ার অর্থ দাঁড়ায় দ্বীন ইসলামের বিকৃতি স্বীকার করে নেওয়া, নাবী (ﷺ) এর আদেশ-নিষেধ তথা হাদিসসমূহ সংরক্ষিত না থাকার স্বীকারোক্তি দেওয়া।

ইসনা আশারিয়া শি'য়াদের মৌলিক বিশ্বাস এই যে, "সাহাবীরা সকলে মিলে আলী, আহলে বাইত ও তাদের ইমামদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন"। এজন্য ইরান, ইরাক ও লেবাননে এই মতবাদের এমন কোনো অনুসারীকে পাওয়া যাবে না, যে সাহাবীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে না। বলতে গেলে, সাহাবী-বিদ্বেষ ব্যতিরেকে এই মতবাদের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। শি'য়া নেতারা সবসময়ই এমন পরিস্থিতি এড়িয়ে চলেন। যদিও মাঝে মাঝে কথায় মনের ভাব ফুটে ওঠে।

আল জাজিরা চ্যানেলে প্রচারিত ড. ইউসুফ কারযাবী ও (ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট) আকবার হাশিমী রাফসানজানীর 'টক-শো' তো আমরা সকলে দেখেছি। আল্লামা কারযাবী সেখানে সাহাবী ও উম্মাহাতুল মু'মিনীন সম্পর্কে তাঁর মুখ থেকে একটু 'ভালো কথা' বের করতে কী চেষ্টাই না করলেন; কিন্তু তিনি কেবল এড়িয়েই গেলেন, এড়িয়েই গেলেন !

সন্দেহ নেই, ইসলামী বিশ্বে ঝড়ের বেগে শি'য়া মতবাদ ছড়িয়ে পড়ছে। ইতিহাস ও ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে এ মতবাদ আর এখন ইরাক, ইরান ও লেবাননেই সীমাবদ্ধ নেই; যথেষ্ট উদ্যম নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিরিয়া, জর্দান, সউদী আরব, মিশর আফগানিস্তান, পাকিস্তানের মতো মুসলিম দেশগুলোতেও। এর চেয়েও আশঙ্কার কথা এই যে, ইদানিং অনেক মুসলিমই শি'য়াদের আকীদা-বিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণায় প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু সে মনে করছে, আমি শি'য়া নই ! এক্ষেত্রে চুপ থাকা নিঃসন্দেহে একসময় দ্বীনের বরবাদি বয়ে আনবে।
.
.
|| শি'য়াদের নিয়ে আমাদের মনে যত শঙ্কা ||
ড. রাগিব সারজানী (হাফিযাহুল্লাহ)

"শি'য়া মতবাদ: ধারণা ও বাস্তবতা" বই থেকে নেওয়া

#ভ্রান্ত_মতবাদ
#ভ্রান্তি_নিরসন

পঠিত : ৩৮৪ বার

মন্তব্য: ০