Alapon

হাদিসের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানিফার পাণ্ডিত্য...



ইমাম আবু হানিফা নুমান ইবনু সাবিত (রহিমাহুল্লাহ)। প্রসিদ্ধ বর্ণনামতে, তিনি তাবিয়ী ছিলেন। তাঁর জীবনকালে তিনি সাত জন সাহাবীর সাক্ষাৎ পান। তিনি মুজতাহিদ ইমাম ও ফকীহ ছিলেন। কিন্তু আমরা অনেকেই হাদিসের ক্ষেত্রে তাঁর পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে অবগত নই। আবার অনেকে হাদিসের ক্ষেত্রে তাঁর নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করি। তাঁরা বলতে চান, ইমাম আবু হানিফা হাদিস জানতেন না অথবা হাদিসের ক্ষেত্রে তিনি 'দুর্বল'। তাদের ধারণা ইমাম আবু হানিফা (রহিমাহুল্লাহ) এর পদচারণা শুধু ফিকহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যা মোটেও সঠিক নয়, তিনি আকীদা ও হাদিসের ক্ষেত্রেও তাঁর নির্ভরযোগ্যতা, পাণ্ডিত্য এবং অবদান মুসলিম উম্মাহর মাঝে চিরস্মরণীয়।

দ্বিতীয় হিজরী শতকের শুরুর দিকের ঘটনা। একবার ইরাকের প্রসিদ্ধ তাবিয়ী মুহাম্মাদ ইবনু ওয়াসি (রহিমাহুল্লাহ) খুরাসানে আগমন করেন। তখন কিছু মানুষ তাঁর নিকট সমবেত হয়ে ফিকহের বিভিন্ন বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করতে থাকে। তিনি বলেন, ফিকহের বিষয়ে পারদর্শী কূফার আবু হানিফা নামে এক যুবক। লোকেরা বলল, তিনি তো হাদিস জানেন না। তখন সেখানে উপস্থিত থাকা আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (রহিমাহুল্লাহ) সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনারা কীভাবে বলছেন তিনি হাদিস জানেন না ? খুরমা খেজুরের বিনিময়ে গাছ পাকা খেজুর ক্রয় করার বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাবে বলেন, এতে অসুবিধা নেই। তখন তাকে বলা হলো সা'দ (রদিয়াল্লাহু আনহু) এর হাদিসে এর আপত্তি (নিষেধ) রয়েছে। তিনি বলেন, এ হাদিসটি 'শায' (দুর্বল হাদিসের একটি প্রকার); এ হাদিসের একমাত্র রাবী যায়িদ ইবনু আইয়াশ অজ্ঞাত পরিচয়। এরপর ইবনুল মুবারক বললেন, যে ব্যক্তি এভাবে সনদ যাচাই করতে পারত তাঁর বিষয়ে কীভাবে বলা যায় যে, তিনি হাদিস জানতেন না !?
[মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, আল মুওয়াত্তা ৩/১৬২; সাইমারী, আখবারু আবী হানিফাহ, পৃষ্ঠা ২৬]

ইয়াযিদ ইবনু হারুন ওয়াসিতী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন,
"আবু হানিফা আল্লাহ-ভীরু, পবিত্র ও সংসারবিরাগী আলিম ছিলেন। তিনি সসত্যপরায়ণ এবং তাঁর যুগের সবচেয়ে বড় হাফিযুল হাদিস ছিলেন। তাঁর যুগের যত মানুষকে আমি পেয়েছি, সকলকেই বলতে শুনেছি- তিনি ফিকহের বিষয়ে আবু হানিফার চেয়ে অধিক পারদর্শী আর কাউকে দেখেননি।"
[সাইমারী, আখবারু আবী হানিফাহ, পৃষ্ঠা ৪৮]

শু'বা ইবনুল হাজ্জাজ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন,
"আল্লাহর কসম ! তাঁর (আবু হানিফার) অনুধাবন সুন্দর এবং তাঁর মুখস্থ শক্তি ভালো ছিলো।"
[সাইমারী, আখবারু আবী হানিফাহ, পৃষ্ঠা ২৩]
আবু হানিফার নির্ভরযোগ্যতার বিষয়ে শু'বার মনোভাব ব্যাখ্যা করে ইবনু মায়ীন বলেন, "এই তো শু'বা ইবনুল হাজ্জাজ, তিনি হাদিস বর্ণনার অনুরোধ করে আবু হানিফাকে পত্র লিখেছেন। আর শু'বা তো শু'বাই।"
[মিযযী, তাহযীবুল কামাল ২৯/৪১৭-৪৪৪; যাহাবি, সিয়ারু আ'লামিন নুবালা ৬/৩৯০-৪০৩; ইবনু হাজার, তাহযিবুত তাহযীব ১০/৪০১-৪০২]

ইবনু মায়ীন (রহিমাহুল্লাহ) বলেন,
"আবু হানিফা হাদিসে নির্ভরযোগ্য ছিলেন। যে হাদিস তাঁর মুখস্ত সে হাদিস ছাড়া অন্য কোনো হাদিস তিনি বলতেন না।" [ঐ]

ইবনুল মাদীনী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন,
"আবু হানিফা থেকে সুফিয়ান সাওরী, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক, হাম্মাদ ইবনু যায়িদ, হুশাইম, ওকী ইবনুল জাররাহ, আব্বাদ ইবনুল আউয়াম, জাফর ইবনু আউন প্রমুখ হাদিস শিক্ষা করেছেন। তিনি নির্ভরযোগ্য, তাঁর বিষয়ে কোনো আপত্তি নেই।"
[ইবনু আব্দুল বার্র, জামিউ বায়ানিল ইলম ২/২৯১-২৯২]

_________________________________
এখানে যেসব ইমাম, মুজতাহিদ এবং মুহাদ্দিসীনদের বক্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে তাদের অতি সংক্ষিপ্ত পরিচিতি :
| আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক
জন্মঃ ১১৮ হিজরী খুরাসানে
মৃত্যুঃ ১৮১ হিজরী
তিনি ছিলেন ছিলেন সুপ্রসিদ্ধ তাবিয়ী এবং দ্বিতীয় শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ফকীহ ও মুজাহিদ। সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমে তাঁর বর্ণিত হাদিস গৃহীত হয়েছে।

| ইয়াযিদ ইবনু হারুন
জন্মঃ ১১৭ হিজরী
মৃত্যুঃ ২০৬ হিজরী
তিনি ছিলেন তাবে তাবিয়ী এবং সে যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসদের একজন। ইমাম আহমাদ তাকে 'হাফিযুল হাদিস' বলতেন। ইবনুল মাদীনী বলেন, তাঁর চেয়ে বড় হাফিযুল হাদিস আমি দেখিনি।

| ইয়াহইয়া ইবনু মায়ীন
জন্মঃ ১৫৮ হিজরী পারস্যে
মৃত্যুঃ ২৩৩ হিজরী
তিনি দ্বিতীয় হিজরী শতকের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ইলমুর রিজালের বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন : ইবনুল মুবারক, ইসমাইল ইবনে ইয়াশ, আবাদ ইবনে আবাদ, ইবনে উয়াইনাহ, আবু মুয়াবিয়া, হাতিম ইবনে ইসমাইল, ইমাম ওয়াকি, আব্দুর রাজ্জাক, হাফস ইবনে গিয়াশ প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত বিদ্বান মনিষীগণ।
তাঁর বিশিষ্ট কয়েকজন ছাত্র হচ্ছে : ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল, ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিম, আবু হাতিম, আবু দাউদ প্রমুখ।

| ইবনুল মাদীনী
জন্মঃ ১৬১ হিজরী ইরাকে
মৃত্যুঃ ২৩৪ হিজরী
তিনি ছিলেন একাধারে মুহাদ্দিস, ফকীহ ও রিজাল শাস্ত্রবিদ। তাঁর সম্পর্কে ইমাম বুখারী বলেন, আমি আলী ইবনুল মাদিনীর সামনে নিজেকে যত তুচ্ছ মনে করতাম তা অন্য কারো নিকট করতাম না।

- সাফওয়ান

পঠিত : ৯৯৭ বার

মন্তব্য: ০