Alapon

|| কল্যাণ লাভের মূলনীতি ||



আল্লাহ তা’আলা বলেন:
لَن تَنَالُوا الْبِرَّ حَتّٰى تُنفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ ۚ وَمَا تُنفِقُوا مِن شَىْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِۦ عَلِيمٌ
﴾তোমরা কস্মিণকালেও কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যদি না তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে ব্যয় কর। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় কর আল্লাহ তা ভালোভাবেই জানেন।﴿ [সূরা আলে-ইমরান: ৯২]
এখানে ভালোবাসার জিনিস উৎসর্গের ব্যাপারে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলছেন: ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা কখনো কল্যাণ লাভ করতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু থেকে ব্যয় কর। দানের ক্ষেত্রে এটি খুবই বিখ্যাত একটি আয়াত। আমি এখান থেকে যে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে চাই সেটি - نالَ (নালা), যার অর্থ হচ্ছে যখন আপনি ভ্রমণ করছেন এবং গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য আর অপেক্ষা করতে পারছেন না। নাল বলতে এটাই বোঝায়—অবশেষে কোনো কিছু পাওয়া।

আরবরা এই ব্যাপারটার সাথে অতি পরিচিত। কারণ তাদেরকে মরুভূমিতে ভ্রমণ করতে হয়। এজন্য এই বৈরী অবস্থা থেকে তারা গন্তব্যে পৌঁছাতে অস্থির হয়ে থাকে। মরুভূমিতে গন্তব্যে না পৌঁছাতে পারাটা মৃত্যুর শামিল। সেখানে বেঁচে থাকার মতো কিছুই নেই। সমুদ্র ভ্রমণের ব্যাপারটাও ঠিক তাই। ধরুন আপনি সমুদ্র ভ্রমণ করছেন আর হারিয়ে গেলেন। অথবা যেখানে আপনার পৌঁছানোর কথা সেটা খুঁজে পেলেন না। সেক্ষেত্রে অবশ্যই টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্রের যোগান আপনার থাকতে হবে, বিশেষ করে খাবার পানি যেখানে খুব সীমিত। ফলে আপনাকে বেঁচে থাকতে হলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর তীরে পৌঁছাতে হবে। তাই আল্লাহ এই শব্দটি ব্যবহার করেছেন যা ভ্রমণে বেঁচে থাকা এবং নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছাতে ব্যবহার হয়।

কিন্তু এর সাথে আল্লাহ যে শব্দটি যোগ করেছেন তা সত্যিই চমৎকার। তিনি الخير (আল-খাইর) বা এই ধরনের শব্দ যা ভালো বোঝাতে ব্যবহার হয়, তার পরিবর্তে পরিবর্তে الْبِرّ (আল-বিররু) শব্দটি ব্যবহার করেছেন। আর আরবীতে আল-বিররু হচ্ছে البر (আল-বার) এর সবচেয়ে নিকটতম শব্দ। আল-বার শব্দটি দ্বারা মূলত জমিন বোঝায়।
সুতরাং যখন আপনি নাল (গন্তব্যে পৌঁছানো) শব্দটি শুনলেন তাৎক্ষণিক আপনার আল-বার (জমিন) এর কথা মনে পড়বে। শাব্দিকভাবে আয়াতে বলছে, আপনি তীরে পৌঁছাতে পারবেন না। আর আল্লাহ এখানে বোঝাচ্ছেন আপনি কল্যাণ লাভ করতে পারবেন না। আর এক্ষেত্রে একই উচ্চারণ বিশিষ্ট দুটি আলাদা শব্দ ব্যবহার করার মাধ্যমে আল্লাহ চাইছেন আমরা যেন এই চিত্রকল্পটি নিয়ে ভাবি।

নিজেকে সমুদ্রের অশান্ত ঢেউ এবং ঝড়ের মাঝে কল্পনা করুন। এবং আপনি জানেন না কখন গন্তব্যে (জমিনে) পৌছাবেন। অবশেষে আপনি সেই দ্বীপে পৌছালেন যেখানে আপনি নিরাপদ। আর সেই নিরাপদ দ্বীপকে বলা হয় আল-বির।
তীরে পৌঁছানো কল্যাণে পৌঁছানোর মতোই। আহ, অবশেষে আমি নিশ্চিন্ত, নিরাপদ! পাপ ও সমস্যার মধ্যে থাকা সমুদ্রের মাঝে থাকার মতোই। সমস্যাসংকুল জীবনযাপন করার মতোই। আপনি সেই নিরাপদ ভূমিতে পৌছাতে পারবেন না, حَتّٰى تُنفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ যদি না আপনি আপনাদের প্রিয় বস্তু থেকে ব্যয় করেন।

এমন একটি নৌকার কথা চিন্তা করুন যাতে ছিদ্র আছে, বা এটি অনেক ভারী। অথবা এটি অনেক অতিরিক্ত বোঝা নিয়ে চলছে। এই ধরনের নৌকাকে বাঁচাতে আপনার কি করা উচিত? আপনাকে বেঁচে থাকতে হলে আপনাকে এর থেকে অতিরিক্ত বোঝা ফেলে দিতে হবে। আল্লাহ বলেন: আপনি তীরে পৌছাতে পারবেন না যদি অতিরিক্ত বোঝা ফেলে না দেন। আর এই ক্ষেত্রে তীর বলতে কল্যাণকে বোঝানো হয়েছে। যতক্ষণ না প্রিয় বস্তু থেকে ব্যয় করেন অর্থাৎ আপনাকে হয়তো নৌকাকে বাঁচাতে, নিজেকে বাঁচাতে হলে ঐ নৌকা থেকে আপনার পছন্দের জিনিস ফেলে দিতে হবে। আর আল্লাহ এখানে বলেন—আপনাকে পছন্দের জিনিস থেকে ব্যয় করতে হবে (ফেলে দিতে হবে, অন্যকে দিয়ে দিতে হবে)।
এর অর্থ মসজিদে শুধু সাদাকা দেওয়াই নয়, এর অর্থ আপনার এমন আত্মীয়দের মাঝে ব্যয় করা যাদেরকে আপনি অপছন্দ করেন। আপনাকে হয়তো জীবনের কিছু বিলাসিতা ত্যাগ করতে হবে। এবং আপনার প্রতিবেশী ও চারপাশের যারা কষ্ট করছে তাদের জন্য ভাবতে হবে। আপনাকে হয়তো আপনার পছন্দের জিনিসগুলো বেশি বেশি দান করতে হবে; পুরাতন জামাকাপড় নয়। এমন জিনিস দেওয়া নয় যা কেউ আপনাকে দিলে আপনি সেটা বাঁকা চোখে দেখবেন। এটা আল্লাহর বোঝানো ব্যয় নয়। বরং এমন জিনিস দিতে হবে যা আপনি নিজের জন্য চান; ভালোবাসার জিনিস, কল্যাণকর জিনিস, প্রিয় জিনিস।

প্রতি বছর ঈদ আসে। আপনারা শপিং করতে যান। আপনি যে শার্ট, যে কাপড় বা যে গহনা কিনবেন, সাদাকা দেওয়ার জন্য সেই ঠিক সেই ধরনের জিনিসই কিনুন। এই ধরনের সাদাকাই হচ্ছে সত্যিকার আল-বির (কল্যাণ)। শুধুমাত্র তখনই আপনি মনে করতে পারবেন যে আপনি কোনো কল্যাণমূলক কাজ করছেন। ফলে, আপনি বুঝবেন যে যাকাতের কাপড়ের নামে সস্তা কাপড় বিলানোটা এই আয়াতের কল্যাণ লাভের মাঝে পরবে না।
কি চমৎকার আয়াত! এবং আমাদেরকে বোঝানোর জন্য কি চমৎকার রূপকল্প আল্লাহ ব্যবহার করেছেন! আমরা মনে করি আমাদের যা কিছু প্রয়োজন তার সবই জাহাজে আছে। কিন্তু আল্লাহ বলছেন এই ভ্রমণে বেঁচে থাকতে হলে আপনাকে আপনার সত্যিকারের পছন্দের কিছু জিনিস দিয়ে দিতে হবে, যদি আপনি কল্যাণের পথে যেতে চান। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কল্যাণ লাভের সুযোগ দিন।

وَمَا تُنفِقُوا مِن شَىْءٍ فَإِنَّ اللَّهَ بِهِۦ عَلِيمٌ
যা কিছু আপনি ব্যয় করেন আল্লাহ তা খুব ভালোভাবে জানেন।﴿ যা কিছু আপনি ব্যয় করুন আপনাকে সেটা ঘোষণা করতে হবে না। সুতরাং আল্লাহ এবং আপনার মাঝে তা গোপন রাখুন। আর ফেসবুকে এটা লিখবেন না যে—এই লেখাটি পড়ার পর আমি আমার প্রিয় শার্টটি দান করেছি।

আল্লাহ আমাদেরকে এই দুনিয়ার যাত্রা শেষের সেই কল্যাণ এবং নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছার তৌফিক দিন। আমীন।

সোর্স : কুর'আনের রত্ন
উস্তাদ নোমান আলী খান

পঠিত : ৪৬১ বার

মন্তব্য: ০