Alapon

শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : স্মৃতিতে সাম্প্রদায়িকতা


০১.
“... যারা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বাধা প্রদান করেন তারা কোন সময়ে এ অঞ্চলের মানুষের কল্যাণের কথা মাথায় আনেননি। বহুকাল থেকে বাংলার পূর্বাঞ্চল শিক্ষা-দীক্ষায় অবহেলিত হতে থাকে। কলিকাতাকেন্দ্রিক ভদ্রলোক শ্রেণী কেবল কলিকাতার উন্নতিকেই দেশের উন্নয়ন হিসেবে গণ্য করেছেন। সে কারণে শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সংস্কৃতি সকল কিছুর কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কলিকাতা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তারা কোন সময়ে চাচ্ছিলেন না যে, কলিকাতার অনুরূপ আর একটি প্রতিষ্ঠান মুসলমান অধ্যুষিত ঢাকায় গড়ে উঠুক।

কলিকাতা তখন শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। পিছিয়ে পড়া মুসলমান ছাত্ররা সুদূর কলিকাতায় গিয়ে লেখাপড়া করতে পারতেন না। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলমানদের যেমন পড়ার সুযোগ কম ছিল তেমন পরিচালনা সংস্থাগুলোতেও তাদের তেমন প্রাধান্য লক্ষ কর্স যায় না। ১৯০৪ সালের পূর্বে কোন মুসলমান সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন না। এ সময় পর্যন্ত কোন মুসলমান ফেলোও প্রবেশ করতে পারেননি। ১৯১৭ সালে দেখা যায় ১১০ জন ফেলোর মধ্যে মুসলমান ছিলেন মাত্র ৭ জন। আবাসিক বা প্রশাসনিক কমিটিতে কোন মুসলমান ছিলেন না। পাঠ্যসূচিতে হিন্দু প্রভাব লক্ষ করা যায়। মুসলমানদের যে সব ইতিহাস ছিল তাও বিকৃত করা হয়। পাঠ্যতালিকা সম্পর্কে শিক্ষামন্ত্রী আজিজুল হক বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যপুস্তকসমূহ প্রায়ই সংস্কৃত উদ্ধৃতিযুক্ত পুরাণ কাহিনী এবং কিংবদন্তীতে পরিপূর্ণ। এমন কয়েকটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, মুসলমান ছাত্ররা আর সকল বিষয়ে খুব কৃতিত্বপূর্ণ নম্বর পেয়েছে, অথচ তাদের দূর্ভাগ্য কেবল মাতৃভাষার পরিক্ষাতেই অকৃতকার্য হয়েছে। মুসলমান ছাত্রদের সমস্যা সৃষ্টি করে পাঠ্যপুস্তক। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরিষদ প্রায় সম্পূর্ণরূপেই মুসলমান বর্জিত হওয়ায় মুসলমান বিষয় সম্পর্কিত পুস্তকের কিংবা মুসলমান লেখক রচিত পুস্তকের প্রতি সহানুভূতিমূলক বিবেচনা প্রদর্শিত হয়নি।" এ কারণেই ১৯০৩ সালে সৈয়দ আমীর আলী আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের লন্ডনস্থ ছাত্রদের সমাবেশে বলেন যে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আসলে হিন্দুদের বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯১৫ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির শিক্ষা সম্মিলনে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা নিয়ন্ত্রনের ভারও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর অথচ সেখানে কোন মুসলমান সিন্ডিকেট সদস্য নেই। একশত জন সাধারণ সিনেট সদস্যের মধ্যে কেবল মাত্র ৬ জন হলেন মুসলমান। কোন অফিসে মুসলমান কর্মকর্তা দেখা যায় না। ১৯১৫-১৬ সালে বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন যে, আজ পর্যন্ত সেখানে মুসলমান ছাত্র্দের কোন হল নির্মিত হয়নি। এজন্য তাদের অবর্ণনীয় কষ্ট করে থাকতে হয়। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, কলিকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ, ল কলেজ - কোথাও কোন ছাত্রাবাস ছিল না। ভারতীয় আইনসভায় ১৯২০ সালে বলেন, ২৩টী কলেজের গভর্ণিং বডিতে কোন মুসলমান প্রতিনিধি নেই, ১০৬৫ জন কলেজিয়েট শিক্ষকদের মধ্যে মাত্র ৩৭ জন মুসলমান। ল কলেজের ৭০ জনের মধ্যে কোন মুসলমান নেই। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ২ জন প্রভাষক হলেন মুসলমান। সে কারণে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে সাম্প্রদায়িক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

... পূর্বে কলিকাতাকেন্দ্রিক ভদ্রলোক শ্রেণীর ধারণা ছিল যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে মুসলমানদের বিশ্ববিদ্যালয়। কে কেউ একে 'মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়' বলে তাচ্ছিল্য করেছেন। কিন্তু আমরা যদি গঠণ প্রণালী, ছাত্র সংখ্যা, পাসের হার সব কিছু বিবেচনা করি, তাহলে দেখতে পাব যে, সেখানে হিন্দুদের প্রাধান্য কম ছিল না। প্রথম একাডেমিক কমিটির ১৯ জন সদস্যের মধ্যে ৬ জন হিন্দু, ৮ জন ইংরেজ ও ৫ জন মুসলমান। এর মধ্যে আর. সি. মজুমদার একজন সদস্য। মুসলমান সদস্যের মধ্যে ছিলেন স্যার এফ. রহমান ও মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্।

... আসলে কমিটি গঠন, ছাত্র সংখ্যা, পাসের হার সবক্ষেত্রে দেখা যায় যে, হিন্দুদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। তাহলে তারা আগাম কি করে বলেন যে, ঢাকা হবে মুসলমানদের বিশ্ববিদ্যালয়? ছাত্র হবে না, কেননা কৃষক সন্তান আর কয়জনইবা পড়তে আসবে। আসলে সুযোগ পেলে পরিস্থিতি যে আলাদা হতে পারে তা তারা বুঝতেই চাননি। অনেকে বলেছেন যে, এটা হবে 'ফাক্কা বিশ্ববিদ্যালয়' অর্থাৎ এখানে তেমন মেধাবী ছাত্র পড়তে আসবেন না। যারা সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান তারা কলিকাতায় গিয়েই পড়াশোনা করেন। এটা আসলে তেমন ফলদানকারী প্রতিষ্ঠান হবে না। কিন্তু ফলাফল বিশ্লেষণ করলে তা প্রমাণ হয় না। ১৯২২ সালে বি.এ. প্রথম শ্রেণীতে যারা পাস করেন এর মধ্যে ৫ জন ছিলেন হিন্দু, এম.এ. - তিনজন প্রথম শ্রেণীতে পাস করেন এবং তারা সবাই ছিলেন হিন্দু। তুলনামুলক আলোচনা করলে দেখা যায়, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ঢাকার ফলাফল ভাল ছিল। প্রমাণসহ বলা যায়, ১৮৫৮ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শিক্ষাবর্ষে ১০ জন বি.এ. পরীক্ষা দেন। দশজনের মধ্যে ঢাকা কলেজ থেকে ১ জন অংশ নেন। সকলেই অকৃতকার্য হন। পরে দুজনকে প্রমার্জন নম্বর দিয়ে পাস করান হয়। এর মধ্যে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একজন এবং অন্যজন হলেন যদুনাথ বসু। সেই থেকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রমার্জন নম্বরের বিধান চালু হয়। এতকিছু জানা ও বুঝার পরও অন্নদাশঙ্কর রায়ের মত ব্যক্তিও বলেছেন যে, আসলে মুসলমানদের সুবিধার জন্য নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি হযেছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন মুসলমানদের জন্য একটি ছাত্রাবাস নির্মাণের সুপারিশ করে। প্রথমে তিনটি হল ছিল। যথা: ঢাকা হল, জগন্নাথ হল ও মুসলিম হল। মুসলিম হলে ১৯২১-২২ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন ৭৫, ১৯২৩-২৪ ১২৭, ১৯২৫-২৫ ১৬০, ১৯২৬-২৭ ২০৪, ১৯২৭-২৮ ২২৯ জন। ছাত্র সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। প্রথম প্রভোস্ট ছিলেন স্যার এফ. রহমান এবং হাউজ টিউটর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। এসব ছাত্রের বিভিন্ন স্থানে আবাসন দেয়া হত। সেজন্য একটি স্বতন্ত্র বিল্ডিং নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং ১৯২৭ সালে একটি হল নির্মিত হয়। ১৯২৯ সালে এর নাম হয় এস. এম. হল বা সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। ১৯২৩ সালে এ হল নির্মাণের সংবাদ শোনার পর পরই নানা কথা বলতে থাকেন। কেউ কেউ বলেন যে, মুসলমান ছাত্র সংখ্যা কোন সময়ে এত বেশি হতে পারে না, তাই প্রকান্ড হল নির্মাণের কোনোই প্রয়োজন নেই। তারা মন্তব্য করেন যে, এ হলে ছাত্রের অভাবে এক সময়ে গরু-ছাগল থাকবে। এস. এম. হলের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে যে স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয় সেটি আমি সম্পূর্ণ পাঠ করেছি এবম স্বাভাবিকভাবেই স্তম্ভিত হয়েছি যে, ঐ হল কত পৃথিবীখ্যাত ও দেশবরেণ্য ব্যক্তিকে বুকে ধারণ করেছে।

... এসব আলোচনা থেকে একটি ভাব বেরিয়ে আসে, তাহল এ অঞ্চলের মানুষের উন্নয়নকে কোন সময়ে মনেপ্রাণে গ্র্হণ করা হয়নি। সে কারণেই একটি মহান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনকে কেন্দ্র করেও তাদের মনোভাবের প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। বঙ্গভঙ্গের ফলে যে উন্নতি হয় তা রদ হয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। এর কিছু ক্ষতি পুষিয়ে দেবার জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভোকেশনে ভাষণদানকালে লর্ড লিটন বলেছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হল বঙ্গভঙ্গ রদের কিছুটা ক্ষতি পূরণ। এ অঞ্চলের মানুষ একে মনে প্রাণে আশীর্বাদ হিসেবে গ্র্হণ করে কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল চক্র নানাভাবে ক্ষতি করতে তৎপর হয়। ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য সরকার সে সময়ে ৬৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেয় অথচ শিক্ষামন্ত্রী প্রভাস সিং তা সমগ্র বাংলাদেশের কাছে এনে সেটা সমগ্র বাংলা প্রদেশের শিক্ষা বিস্তারের জন্য বরাদ্দ দেন।

এমনিভাবে বিস্তারিত আলোচনা করলে এটা সহজে প্রমাণিত হয় যে, এ অঞ্চলের মানুষের প্রতি তাদের মনোভাব কেমন ছিল। পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের কল্যাণের জন্য কোন প্রকার দরদ প্রদর্শন করা হয়নি আর এভাবেই সহানুভূতি দেখান হয় বাঙালীকে মানুষ করার জন্য॥”

— ড. মো: মকসুদুর রহমান (অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ - রা.বি) / বঙ্গভঙ্গ ও বাঙালির ঐক্য ॥ [ প্রতীক - ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ । পৃ: ১৪৭-১৫১ ]

০২.
“... অত:পর সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বাতাবরণ তৈরীর মাধ্যমে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীদের তুমুল আন্দোলনের মুখে ১৯১১ সালে পূর্ববাঙলা আসাম প্রদেশ তথা 'বঙ্গভঙ্গ' রদ হ'ল। বৃটিশ ভারতের 'যবন' ও 'ম্লেচ্ছ' অধ্যুষিত পান্ডববর্জিত অঞ্চল পূর্ববাঙলা ও বৃহত্তর আসামের নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ আবারও ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত হ'ল।

১৯০৫ সালে পূর্ববাঙলা ও বৃহত্তর আসাম (আজকের সেভেন সিস্টার্স) নিয়ে বৃটিশ ভারতে যে নতুন প্রদেশ গঠিত হয়েছিল তা উগ্র বর্ণহিন্দু-জাতীয়তাবাদীদের আন্দোলনের মুখে বাতিল না হয়ে যদি স্থায়িত্ব লাভ করতো, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চল পূর্ববাঙলা ও বৃহত্তর আসামে, এমনকি গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় ৫টি বড় মাইলফলক তৈরি হতো। সেগুলো হ'ল :

১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল ১৯২১ সালের পনেরো বছর আগেই ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতো এবং সেই পনেরো বছরের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯২১ সালের মধ্যেই পূর্ববাঙলা ও আসাম অঞ্চলের ভয়াবহভাবে পিছিয়ে পড়া মুছলমান ও নিম্নবর্ণীয় হিন্দু-বৌদ্ধ সমাজে আধুনিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্থান ঘটে যেতো।

২. ঢাকা তখন কলকাতার হিন্টারল্যান্ড (উপনিবেশ) থেকে মুক্ত হয়ে নতুন প্রদেশের রাজধানী হিসেবে কলকাতা ও ভারতের অন্যান্য নগরীর প্রতিযোগী নগর হিসেবে বিকাশ লাভ করতো।

৩. চট্টগ্রাম বন্দরের সমৃদ্ধি তৎকালীন বোম্বাই, মাদ্রাজ, বিশাখাপত্তনম, কলকাতাসহ ভারতবর্ষের সকল সামুদ্রিক বন্দরের সমৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে যেতো। বাংলাদেশের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী-সুশীলরা যে, চট্টগ্রাম বন্দরকে মার্কিন ও ভারতের হাতে তুলে দিয়ে চট্টগ্রামকে 'সিঙ্গাপুর' বানানোর অলীক স্বপ্ন দেখেন, সেই স্বপ্ন আজ থেকে অন্তত: সত্তর বছর আগেই বাস্তবে পূরণ হতো।

৪. পূর্ববাঙলা-আসাম প্রদেশ বৃটিশ শাসনকালের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৪৭ সালের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গকে ছাড়িয়ে কৃষি, শিল্প, অর্থনীতিতে এবং ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে ভারতবর্ষের সবচেয়ে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী প্রদেশে রূপান্তরিত হতো।

৫. এর ফলে ১৯৪৭ সালে ভারত-বিভাগ ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদ্ভবই হতো না, কারণ পাকিস্তান আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল তৎকালীন কলকাতার 'উপনিবেশ' পূর্ববাঙলার জনগণ। ১৯০৫ সালের পূর্ববাঙলা-আসাম প্রদেশ স্থায়ী হলে ১৯৪৭-এর মধ্যেই এ অঞ্চলের জনগণের মধ্যে ভারত-ভাগ ও পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণের শর্তই তৈরী হতো না। বরং সমগ্র ভারতবর্ষে নিজের পণ্যের বাজার সম্প্রসারনের স্বার্থেই তারা ভারত-ভাগের বিরোধিতা করতো। আর, কোন কারণে সাতচল্লিশ বা তার আগে-পরে ভারত যদি বিভক্তও হতো এবং পাকিস্তানও যদি প্রতিষ্ঠিত হতো, তাহলে সে ক্ষেত্রে পূর্ববাঙলা-আসাম প্রদেশের পাকিস্তানে যোগ দেওয়ার কোনই প্রয়োজন হতো না, বরং পূর্ববাঙলা-আসাম প্রদেশ নিজেই একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হতো। সেটি হ'লে স্বাধীন পূর্ববাঙলা-আসাম রাষ্ট্র পঞ্চাশ-ষাট বছরের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বেশী উন্নত ও সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত হতো। আজ যারা দক্ষিন এশিয়ায় বাংলাদেশ, সেভেন সিস্টার্স ও দার্জিলিং নিয়ে 'কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টেটস (সি.আই.এস)' প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন, সেই স্বপ্ন ষাট-সত্তর বছর আগেই পূরণ হতো।

দু:খজনক ব্যাপার হ'ল - তৎকালীন পূর্ববাঙলা ও বৃহত্তর আসামের যে-সব রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবীরা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের লেজুড়বৃত্তি করেছিলেন এবং ১৯০৫-এ এই সম্ভাবনাময় প্রদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে তার বিরুদ্ধে 'বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ' বলে চিৎকার করে পূর্ববাঙলা-আসাম প্রদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন এবং আজও তাদের উত্তরসূরী বাংলাদেশের একশ্রেণীর 'মুছলমান ব্রাহ্মণরাও' যে কথিত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে করে মুখের ফ্যানা তোলেন - তারা কি বুঝেন, এ অঞ্চলের জনগণের কত বড় ক্ষতি তারা করেছিলেন? তারা কি কখনও এ-ও ভেবে দেখার অবকাশ পান যে, তাদের চিৎকার পরবর্তীতে ৪৭-এর বঙ্গভঙ্গ ঠেকাতে পারেনি, ভারত ভাগও ঠেকাতে পারেনি?

১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন যে ঘোরতর মুছলিম-বিদ্বেষী উগ্র হিন্দু-জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিল সে বিষয়ে ভারতীয় লেখক বিমলানন্দ শাসমল তার 'ভারত কী করে ভাগ হ'ল' গ্রন্থে লিখেছেন -

এই বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন ছিল সন্দেহাতীতভাবে মুছলমানবিরোধী এবং গভীরভাবে মুছলিম স্বার্থের পরিপন্থী। এই আন্দোলনের তাগিদে যে-সকল সন্ত্রাসী বা বিপ্লববাদী নেতা কর্মক্ষেত্রে আবির্ভুত হলেন তারা সকলেই ছিলেন গভীরভাবে মুছলমান বিরোধী॥”

— রইসউদ্দিন আরিফ (সাবেক সম্পাদক, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি) / অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ : বাঙালী ও বাংলাদেশ ॥ [ পাঠক সমাবেশ - ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ । পৃ: ৮০-৮২ ]

০৩.
“... ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর আগা খানের নেতৃত্বে ভারতের ৩৫ জন মুসলিম নেতা সিমলায় ভাইসরয় মিন্টোর সাথে দেখা করে মুসলমানদের পক্ষ থেকে কতিপয় সুনির্দিষ্ট দাবী পেশ করেন। অন্যতম দাবীটি ছিল ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। হিন্দুদের চক্রান্তে বঙ্গভঙ্গ রদের পর ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারী ভারতের বড়লাট নবাবকে সান্তনা দেয়ার জন্য ঢাকায় আসেন এবং বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দেন। কিন্তু অন্যান্য উগ্রবাদী হিন্দু নেতাদের সাথে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ আশ্বাসেরও চরম বিরোধিতা করেন।

১৯১২ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার গড়ের মাঠে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে হিন্দুরা প্রতিবাদ সভা ডাকে। প্রতিবাদ সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কারণ তিনি ছিলেন জমিদার। তিনি মুসলমান প্রজাদের মনে করতেন লাইভ স্টক বা গৃহপালিত পশু। [ নীরদচন্দ্র চৌধুরী, দি অটোবায়োগ্রাফি অব এন আননোন ইন্ডিয়ান দ্রষ্টব্য ]
কাজেই বাংলার মাটি, বাংলার জলের জন্য একবছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেমে গদ গদ হয়ে গান লিখলেও এক বছর পর বাংলার কৃষকদের ছেলে শিক্ষিত হবে তা তিনি সহ্য করেননি। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে নবশিক্ষিত মুসলমান সমাজকে আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের সন্তানদের শিক্ষিত হয়ে বুদ্ধিজীবী হলে চিরকাল সেবাদাস করে রাখা যাবে না। একথা চিন্তা করেই বোধ হয় হিন্দু বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরা সেদিন আতঙ্কিত ও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে উগ্রবাদী হিন্দুরা কতটা ক্ষিপ্ত হয়েছিল এর প্রমাণ পাওয়া যাবে সেকালের নেতৃবৃন্দের বক্তব্য, বিবৃতি ও পত্রিকার ভাষ্য থেকে।

১৯১২ সালে ১৬ই ফেব্রুয়ারী বড় লাটের সাথে বর্ধমানের স্যার রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধিমন্ডলী সাক্ষাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা না করার পক্ষে নিম্নোক্ত যুক্তির জাল বিস্তার করেন।

'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে আভ্যন্তরীণ বঙ্গ বিভাগ-এর সমার্থক, তাছাড়া পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা প্রধানত কৃষক; তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তারা কোন মতেই উপকৃত হবে না।' [ Report of the Calcutta University Commission Vol. IV, Prt. II, P. 133 ]

'সিলেটের বিপিনচন্দ্র পাল বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অশিক্ষিত ও কৃষক বহুল পূর্ববঙ্গের শিক্ষাদান কার্যে ব্যাপৃত থাকতে হবে; পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণের শিক্ষানীতি ও মেধার মধ্যে সামঞ্জস্য থাকবে না।' [ ঢাকা প্রকাশ, ১১ ও ১৮ই ফেব্রুয়ারী - ১৯১২ ]

এছাড়া হিন্দু সংবাদপত্র, বুদ্ধিজীবী ও নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে অসংখ্য প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন এবং সভার সিদ্ধান্তগুলো বৃটিশ সরকারের কাছে প্রেরণ করতে থাকেন। বাবু গিরিশ চন্দ্র ব্যানার্জী, ড: স্যার রাসবিহারী ঘোষ এবং কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখার্জীর নেতৃত্বে হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা বড় লাট হার্ডিঞ্জের কাছে ১৮ বার স্মারকলিপি পেশ করেন [ Report of the Calcutta University Commission ]

আশ্চর্যের বিষয়, এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতার মিছিলে শরীক হয়েছিলেন মানবতার কবি দাবীদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও।

... ১৯১৫ সালের ১৬ই জানুয়ারী নবাব সলিমুল্লাহর মৃত্যুর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। নবাব সলিমুল্লাহর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে শক্ত হাতে হাল ধরেন সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। সেই ১৯১১ সালের ৩১ জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণার দিন থেকে ১৯২০ সালের ২৩শে মার্চ-এ বড় লাটের আইন সভায় 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট' পাস হওয়ার দিনটি পর্যন্ত তিনি বিরামহীন প্রচেষ্টা চালান। কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহও বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাসের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। অবশেষে কট্টর হিন্দু নেতাদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯২১ সালের জুলাই মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু কাঙ্খিত বিশ্ববিদ্যালয়টি নবাব দেখে যেতে পারেননি। এছাড়া জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নীও (চাঁদ মিয়া) পূর্ব বাংলার মুসলমানদের শিক্ষার জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। অথচ আজ নবাব সলিমুল্লাহর নামে একটি হল আছে বটে; কিন্তু কায়েদ আযম জিন্নাহ, নওয়াব আলী চৌধুরী ও জমিদার চাঁদ মিয়ার কোন স্মৃতি চিহ্ন ক্যাম্পাসে নেই।

... আর যাদের আন্দোলনের ফসল এই এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অনেকে তাদের নামই জানে না। তাদেরকে নিয়ে কোন আলোচনা বা স্মৃতি সভা হয় না। আলোচনা বা স্মৃতি সভা হয় বঙ্কিম, সূর্যসেন ও রবীন্দ্রনাথদের নিয়ে। যাদের কল্যাণে চাষার ছেলে থেকে আজকে যারা ভাইস-চান্সেলর, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, আমলা, রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ, বিচারপতি, শিল্পপতি, শিল্পী, অভিনেতা-অভিনেত্রী, প্রযোজক-পরিচালক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, সে-সব কৃতি সন্তানেরা আজ উপেক্ষিত, নিন্দিত। হায়রে দূর্ভাগা দেশ। হায়রে দূর্ভাগা জাতি।

বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার লগ্ন থেকেই এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। বর্তমানেও তা অব্যাহত রয়েছে। পূর্বে এই এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছে রবীন্দ্র বাবুরা। বর্তমানে করছে মুসলমান নামধারী রবীন্দ্র ভক্তরা।
বাংলাদেশের এক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রবন্ধে নিম্নোক্ত মন্তব্য করেছিলেন :

'রবীন্দ্রনাথের মাটিতে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করার সাধনা, রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে বেঁচে থাকার, বিকশিত হওয়ার কিংবা রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করার বর্বর অহংকার হচ্ছে পায়ের তলায় জমি শুন্য, শেকড় শুন্য, নির্বোধের অহংকার।' [ সরদার ফজলুল করিম : রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্বে আমাদের অস্তিত্ব /দৈনিক সংবাদ - ২৪ ফাল্গুন, ১৩৯৬ ]

সচেতন মহলের মতে, দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফজলুল করিমের এই মন্তব্যে নতুন প্রজন্মের মন-মানসিকতা আচ্ছন্ন করারই কথা। তারা স্বভাবতই বিশ্বাস করবে 'রবীন্দ্রনাথের অস্তিত্ব আমাদের অস্তিত্ব'। এই বিশ্বাসের পরিণাম কি হবে তাও ভেবে দেখা সময়ের দাবী॥”

— সরকার শাহাবুদ্দীন আহমেদ / ইতিহাসের নিরিখে নজরুল-রবীন্দ্র চরিত ॥ [ বাংলাদেশ কো অপারেটিভ বুক সোসাইটি - জুলাই, ১৯৯৮ । পৃ: ২৩০-২৩৩ ]

-কায় কাউস

পঠিত : ৩৪০ বার

মন্তব্য: ০