Alapon

মৃত্যু!

তখন এই শহরে নতুন। একদিন হাটতে হাটতে মেডিকেল কলেজের দিকে চলে গেলাম। কোথায় যাচ্ছি, কোনদিকে যাচ্ছি আমি নিজেই জানি না। হাটতে হাটতে হঠাৎ একটি জায়গায় এসে থমকে গেলাম।


জায়গাটা বড্ড নীরব। একটু বেশিই শান্ত মনে হচ্ছিল। কেন জানি না, শরীরটা ছমছম করে উঠল। আরো একটু ভিতরে যাবার জন্য পা বাড়াতে গেলাম এমন সময় কেউ একজন ডেকে উঠল। পিছনে ফিরে দেখি আমার পরিচিতজন। তিনি ঐ মেডিকেলেরেই ষ্টুডেন্ট ছিলেন।
তিনি চোখগুলো বড় বড় করে প্রশ্ন করলেন, ‘ঐ দিকে কোথায় যাও? ঐ জায়গাটা কি তুমি চেন?’
জবাবে বললাম, ‘না তো।’
তিনি বললেন, ‘ওটা মর্গ। ওখানে খামোখা যাওয়ার দরকার নেই।’
তারপরও আমি নাছোড় বান্দা। তারপর তার সঙ্গেই মর্গে গেলাম।
সেখানে গিয়ে দুজন তরুণের লাশ দেখতে পেলাম। একসিডেন্টে নাকি মারা গেছে। তখন ভাবতে লাগলাম, তরুণ বয়সে এই যে ডেমকেয়ার ভাব নিয়ে ঘুরছি, যা মন চাইছে তাই করছি, কিন্তু এই তরুণ বয়সে আমার অবস্থাও যে তাদের মত করুণ হবে না, তার নিশ্চয়তা কে দিবে?


তার কিছুদিন পরের ঘটনা। ইউনিভার্সিট এলাকায় বন্ধুর সঙ্গে রিক্সায় করে যাচ্ছিলাম। কি যেন মনে খুব আমরা খুবই হাসছিলাম। ঠিক তখনই আমাদের পাশ দিয়ে, পুলিশের একটি গাড়ি যাচ্ছিল। গাড়ির পিছনে প্যাকেট করা একটা লাশ দেখলাম। সেই লাশটির একটি পা বাহিরের দিকে ঝুলে আছে। তার সেই ঝুলে থাকা পা টি মনে হল, আমার জীবনটাও এমনই ভাবে ঝুলে আছে। যেকোন সময় মালাকাল মউত চলে আসবে এবং আমার ইহ জীবন সাঙ্গ করে দিবে।
বাসায় ফেরার পথে আমি কোন কিছুর দিকে না তাকালেও, একটি দোকানের দিকে না তাকিয়ে পারি না। দোকানটির নাম ‘চিরবিদায় ষ্টোর’। প্রায়দিনই দেখি কারিগরা কফিন বানাচ্ছে। কফিনের সাথে থাকে কাফনের কাপড় এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিস। চিরবিদায় ষ্টোরে আমার কফিনটি যে তৈরী হয় নি, তার নিশ্চয়তা কে দিবে? আমার জন্য কাফনের কাপড় চলে আসেনি, তার নিশ্চয়তা কে দিবে?


বছর চারেক আগের কথা। তখন রমজান মাস ছিল। বিকাল বেলা, আমাদের এলাকার তিন বড় ভাই এক ইফতার প্রোগ্রামের জন্য বাইক নিয়ে বেরিয়ে গেল। দুপুর থেকে বেরিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত তারা তাদের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল। তাদের রওনা হবার ৫ মিনিট পরেই সংবাদ এল তারা একসিডেন্ট করেছে। ঘটনাস্থলে দিয়ে দেখা গেল, একজনের শরীর পুরোটাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বাকিদু’জনও ঘটনাস্থলেই মারা গেছে! অথচ কিছুক্ষণ আগেও তারা আড্ডা দিচ্ছিল গল্প করছিল এবং হাসতেছিল। কিন্তু তারা জানতেও পারেনি, আর কিছু সময় পরেই মালাকাল মউত তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসছে।
পৃথিবীতে প্রায় প্রতিদিনিই নতুন নতুন তত্ব আবিষ্কৃত হচ্ছে। পুরাতন বিজ্ঞানীদের অনেক তত্বকেই ভুল প্রমাণিত করছে। কিন্তু মৃত্যুকে ভুল প্রমাণিত করবার হিম্মত দুনিয়ার কোন ব্যক্তিরই নেই। দুনিয়ার সবচেয়ে ধ্রুব সত্যটির নাম ‘মৃত্য’। অথচ এই মৃত্যুর কথাটাই আমি এবং আমরা ভুলে বসে আছি।


জীবনটাকে সুন্দরভাবে সাজানোর জন্য, আমাদের কত্তো প্রচেষ্টা। কিন্তু সুন্দর একটি মৃত্যুর জন্য আমাদের প্রচেষ্টাটা যতসামান্যই মনে হয়। সুন্দর মৃত্যুর জন্য আকাঙ্খাটাকে আরো কম মনে হয়।

পঠিত : ৫৩৭ বার

মন্তব্য: ০