Alapon

❝সাদাক্বায়ে জারিয়াহ❞



মিছে এই জীবনের রঙধনু টা
মুছে যাবে একদিন জেনে নাও
থাকতে সময় খোদার রাহে
নিজের জীবনটা সঁপে দাও।


গানের এ লাইনগুলো নিঃসন্দেহে নশ্বর দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ীত্ব এবং একমাত্র কর্মপন্থাকে নির্দেশ করছে। অনিবার্য এক সত্যের নাম মৃত্যু। মানব জীবনের এমন এক পর্যায়, যা এক লহমায় দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তি টেনে পৌঁছে দেয় এক অনন্তকাল দীর্ঘ জীবনের দ্বারপ্রান্তে। এ চরম সত্য সম্বন্ধে আমরা সকলেই জানি। পবিত্র কোরআনের সূরা আল-আম্বিয়ার ৩৫নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা মানবজাতিকে সতর্ক করেছেন এই বলে যে,

كُلُّ نَفْسٍ ذَآئِقَةُ الْمَوْتِؕ وَ نَبْلُوْكُمْ بِالشَّرِّ وَ الْخَیْرِ فِتْنَةًؕ وَ اِلَیْنَا تُرْجَعُوْنَ

“প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আর আমি ভালো ও মন্দ অবস্থার মধ্যে ফেলে তোমাদের সবাইকে পরীক্ষা করছি, শেষ পর্যন্ত তোমাদের আমার দিকে ফিরে আসতে হবে।”

তবু ইহকালের এ স্বল্প সফরে আমরা বেমালুম ভুলে যাই আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য, ভুলে যাই এ পথের শেষ গন্তব্য কোথায়। ব্যস্ত হয়ে পড়ি দুনিয়াবী নানা কাজে। কেনো আল্লাহ তা'আলা আমাদের পাঠিয়েছেন এ পৃথিবীতে, কি আমাদের কাজ- তার উত্তর আল্লাহ তা'আলা স্বয়ং দিয়ে দিয়েছেন,

“জিন ও মানুষকে আমি শুধু এজন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত বা দাসত্ব করবে।”
( সূরা আয যারিয়াত, আয়াতঃ৫৬)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা ক্ষণস্থায়ী এ জীবন আমাদের জন্য এক পরীক্ষাস্বরূপ সৃষ্টি করেছেন। ভেবে দেখুন, একজন সিরিয়াস স্টুডেন্ট পরীক্ষার হলে বসে এমন কোন কাজ কখনোই করবে না, যা তার পরীক্ষার ভালো রেজাল্টে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। সে নিবিষ্ট মনে কিন্তু প্রশ্নের উত্তর খাতায় লিখে যাবে। যেনো সময় শেষ হবার পূর্বেই সে তার অভীষ্ট ফলাফল প্রাপ্তিতে সফল হতে পারে। ঠিক একইভাবে, সৃষ্টির সেরা জীব মানবসত্তার নিজের অতি-স্বল্প সময়কে ঠিক এভাবেই আখিরাতের প্রস্তুতি স্বরূপ কাজে লাগানো উচিত। তার ধ্যান জ্ঞান জুড়ে থাকা উচিত পরকালীন জীবনের রসদ আহরণের চিন্তা। কিন্তু আমরা অবিরাম ছুটে চলেছি এক মরীচিকার পিছে, যা মৃত্যুর নিদারুণ বাস্তবতা থেকে গাফেল করে রাখছে; আর এভাবেই হুট করে মালাকুল মওত আদমসন্তানের সম্মুখে হাজির হচ্ছে এমন সময়, যে সে এখনো নিজের আমলনামায় এমন কিছুই জমা করতে পারে নি যা দিয়ে যে জান্নাতের মনোহর বাগিচায় চিরস্থায়ী আবাস সুনিশ্চিত করে নিতে পারবে।

“এমন একটা দিন আসবে যেদিন আপনার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অনবরত কারো ফোন বাজতে থাকবে, ক্ষুদেবার্তা গুলো গন্তব্যের উদ্দেশ্যে হাওয়ায় ভাসবে, মানুষজন টুইট করবে, স্ট্যাটাস দিবে, পোস্টার টাঙানো হবে। শুধু আপনি ই থাকবেন না।”

একটি লেকচারে উপরোক্ত কথাগুলো শুনেছিলাম। সত্যিই তো। সেদিন আপনাকে কেন্দ্র করে অনেক কাজই সংঘটিত হবে, বিপুলা এ ধরণীর বুকে আপনার স্মৃতি হয়তো কারো জীবনের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত করবে, প্রিয়জনেরা চোখের জল আড়াল করতে মুখ লুকোবে। কিন্তু তাতে লাভ কি? এ হাহাকার, বিলাপ আপনার সেদিন কোন কাজে আসবে না। সেদিনের পর এ বিচিত্র কর্মযজ্ঞে আপনার কোনোভাবেই আর অংশ নেয়া সম্ভবপর হবে না। নেক আমলের পাল্লা ভারি করার মতো কোন পুণ্য করার জন্য আপনাকে আর কখনোই এ দুনিয়াতে ফিরিয়ে দেয়া হবে না। তাহলে উপায় কি? হ্যা। একটি উপায় আছে। এমন কিছু কাজ, যার মাধ্যমে আপনি মারা যাবার পরেও নেক আমলের খাতায় আগের মতোই নেকী জমা হতে থাকবে।

যখন কেউ মারা যায় তার ধনসম্পদ, আত্মীয় স্বজন, পরিবার, ক্যারিয়ার, খ্যাতি সবকিছু পেছনে ফেলে যায়। সে এখন এমন এক জীবনের দিকে যাত্রা করেছে, যেখানে এসব তার কোনো কাজেই আসবে না।

এ প্রসঙ্গে একটি হাদীস সুপ্রসিদ্ধ রয়েছে। তা হলো-
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, মানবী (সা.) বর্ণনা করেছেন, ‘মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার সব আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমলের দরজা বন্ধ হয় না। ক.) সদকায়ে জারিয়া খ.) যদি কেউ এমন সন্তান রেখে যায়, যে সন্তান বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করবে গ.) এমন দ্বীনি শিক্ষা রেখে যায়, যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হতে থাকে।’ (মুসলিম)

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত,
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

মানুষ মৃত্যুবরণ করার পর কবরে ৭টি আমলের সওয়াব অব্যাহত থাকে- ১. যে ইলম শিক্ষা দিল, ২. যে পানি প্রবাহিত করল, ৩. কূপ খনন করল, ৪. খেজুর বা যেকোন গাছ লাগালো, যা থেকে মানুষ উপকৃত হতে থাকবে (গাছ রোপন), ৫. মসজিদ তৈরি করল, ৬. কোরআনুল কারিম বিতরণ করল ও ৭. এমন নেক সন্তান রেখে গেল- যে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে।
( আল হাদীস )

আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত,
হাদিসে হযরত মুহাম্মদ(সা.) বলেছেন, মানুষ মৃত্যুবরণ করার পর ৪টি আমলের সওয়াব অব্যাহত থাকে- ১. যে ইসলামি রাষ্ট্রের সীমান্ত পাহারা দিল তার সওয়াব, ২. ভালো কাজ চালু করার ফলে তাকে যারা অনুসরণ করল তার সওয়াব, ৩. যে ব্যক্তি এমন সদকা করলো, যা প্রবাহমান থাকে তার সওয়াব, ও ৪. এমন নেক সন্তান রেখে যাওয়া- যে তার জন্য দোয়া করে। -মুসনাদ আহমাদ : ২২২৪৭

এরকম বিভিন্ন সূত্রে হাদীস বর্ণিত রয়েছে, যা আমাদের সেসকল সদক্বায়ে জারিয়াহ সম্বন্ধে অবগত করে, যেগুলো জীবিত থাকাকালীন করবার মাধ্যমে হয়তো কিয়ামত পর্যন্ত এ সওয়াব আমার আমলনামায় লিপিবদ্ধ হতে থাকবে। সুবহানাল্লাহ।

অন্যত্র বর্ণিত রয়েছে যে,
আবু মাসউদ আনসারি (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি অপর ব্যক্তিকে কোনো সৎকাজ শেখায়, দ্বিতীয় ব্যক্তি ওই কাজ করলে প্রথম ব্যক্তি তার সওয়াব পেতে থাকে।’ (মুসলিম)

ইলম আহরণ করে তা দাওয়াতের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া সাদাক্বায়ে জারিয়া'র একটি অন্যতম কার্যকর পন্থা।

প্রস্তুতি নিতে যেনো দেরি না হয়ে যায়। সেই চিরবিদায়ের মুহূর্ত চলে আসার পূর্বেই আখিরাতের উত্তম পাথেয় সংগ্রহে যেন ব্যয় করতে পারি আমাদের দুনিয়াবী জীবন, পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে যেনো মহান আল্লাহর কাছে হাজির হতে পারি, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা সে তাওফিক দান করুন। আমীন।

। সাদাক্বায়ে জারিয়াহ।
~ সাবিহা সাবা

পঠিত : ৪৯৯ বার

মন্তব্য: ০