Alapon

তারাও কিন্তু মানুষ!

হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, ‘কি রে ভাই! আপনার কি চোখ নাই? দেখে পথ চলতে পারেন না।’


ছেলেটা বলল, ‘আমার চোখ আছে সত্যি। কিন্তু আমার এই দুই চোখে আল্লাহপাক আলো দেন নি। আমি আসলেই অন্ধ। তাই দেখতে পাই নি। ক্ষমা করবেন।’


তার কথাগুলো শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। তারপর আমিই তার কাছে ক্ষমা চাইলাম। এই ক্ষমা চাওয়া-চাওয়ি পর্বের মাধ্যমে ইরাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। পরিচয়ের এক পর্যায়ে বললাম, ‘তুমি কোন কন্টিনজেন্ট এর স্কাউট?’
সে বলল, ‘রংপুর’।
এই তো ব্যাটে-বলে মিলে গেল। তার তাঁবু নাম্বার ‍টুকে নিয়ে নিজ গন্তব্যে চলে গেলাম।
জাম্বুরীতে আমরা মোট ১০ দিন ছিলাম। এই ১০ টি দিনের প্রতিটি দিন ইরাদের সঙ্গে আমার দেখা হতে থাকে। মূলত, এই ১০দিনে ইরাদ আর আমার বন্ধুত্বের ভিত্তি প্রস্তর গড়ে উঠে। জাম্বুরীর অষ্টম দিনে সম্ভবত পূর্ণিমা ছিল। ইরাদকে সঙ্গে নিয়ে আমি জ্যোৎস্না দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। ইরাদ বলল, ‘একটু দাঁড়াও আমার গ্লাস আর ষ্টিকটা নেই’।
বললাম, ‘তার কোন প্রয়োজন হবে না। চলে আসো।’


আমরা দু’জনে নীরবে পাশাপাশি অনেকক্ষণ হাটলাম। হঠাৎ ইরাদ বলল, ‘আমি আন্ধা মানুষ। জ্যোৎস্নার কি বুঝি! আমাকে নিয়ে বের হয়েছো কেন?’


তাকে বললাম, ‘জ্যোৎস্না শুধু দেখার জিনিস না, গায়েও মাখার জিনিস। আমি জ্যোৎস্না দেখতে বের হয়েছি আর তোমার শরীরে জ্যোৎস্না মাখানোর জন্য তোমাকে নিয়ে এসেছি।’


আমার কথাগুলো শুনে ইরাদ হা..হা..হা করে হেসে উঠল! তার হাসি দেখে আমার চোখ দু’টো ভিজে গেল। ইশ! কি সুন্দর হাসি। অথচ তার চোখ দু’টি অন্ধ।


এরপর আমাদের বন্ধুত্বের কেটে যায় ৫ টি বছর। এর মাঝে ওর পরিবারের সাথেও আমার পরিচয় হয়ে যায়। একদিন রাত ১০টার দিকে ইরাদের বাসায় হাজির হলাম। রংপুর শহরে রাত ১০টাও বেশ রাত। আমাকে ড্রয়িং রুমে বসতে দিয়ে, ইরাদের বাসার কাজের ছেলেটা ওর রুমের দরজার মুখে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভাইয়া, আপনার পাগলা বন্ধু আসছে। আপনেক ডাকে!’
সেইরাতে ইরাদকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসলাম। ইরাদ বলল, ‘দাঁড়াও গাড়িটা নেই।’
বললাম, ‘উহু তার দরকার নেই। আজ রাতের জন্য ‘পা গাড়িই যথেষ্ঠ।’


তারপর আমরা হাটতে হাটতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মোড়ে চলে আসি। ইরাদ কে বললাম, ‘ছেলেটা কি আমাকে পাগল বলল?’
ইরাদ মুচকি হেসে বলল, ‘বাসায় এখন তোমার সাথে আমাকেও পাগল বলে। কারণ, তোমার কথা শুনে আমি প্রায় জ্যোৎস্না রাতে ছাদে গিয়ে বসে থাকি। শরীরে জ্যোৎস্নার আলো লাগাই। আম্মু বলল, এই বুদ্ধি কে দিছে? তোমার নাম বললাম। তারপর মন খারাপ থাকলে মাঝে মাঝে দেয়ালে ঠেস দিয়ে আকাশের পানে পা দুটি তুলে রাখি। আম্মু এসে বলল, ‘এই বুদ্ধি কোথায় পেলি? যথারীতি তোমার নাম বলে দিলাম। তারপর আম্মু বলল, তোমার বন্ধু পাগল, তুমিও পাগল। তারপর থেকেই তুমি পাগল আর আমি পাগলের বন্ধু, পাগল।’


তারপর অবশ্য আম্মু একটা সিরিয়াস কথা বলছে। তোমার জন্য অশনি সংকেত হতে পারে। আম্মু বলছে, ‘তোমার মত ছেলেদের সাথে প্রেম করে বিরাট মজা আছে কিন্তু সংসার করে মজা নেই। তোমার সাথে সংসার মানেই দুঃখ, বিরাট দুঃখ।’
এই কথা বলেই ইরাদ হা..হা..হা.. করে হেসে উঠল। কিছুক্ষণ একা একা হেসে বলল, ‘আমি যদি মেয়ে হতাম, তোমার সঙ্গে অবশ্যই প্রেম করতাম।’


ইরাদ বলল, ‘আম্মু ওকথা বলেছে কেন, জানো? যাতে করে আমি একটু ভয় পাই। বিবাহ না হওয়ার ভয় পাই। কিন্তু ভয় পেয়েই লাভ কি আর ভয় না পেয়ে বা কি লাভ! দিনশেষে আমি অন্ধ। অন্ধের জীবনে কোন ভালোবাসা নাই। প্রেম নাই। কোন বিবাহ নাই।


আমরা ফিরে আসার জন্য আবারো হাটতে শুরু করলাম। অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর ইরাদ বলল, ‘জানো, আমারও না খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। ভালোবাসা পেতেও ইচ্ছে করে। দিনশেষে আমার পরিচয়, আমি অন্ধ। ‍শুধুই অন্ধ। একজন মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু একজন অন্ধের ভালোবাসা পাওয়ার কি অধিকার আছে?


আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি। আমি নীরব হয়ে থাকি। কিন্তু খুব বলতে চেয়েছিলাম, ‘আছে! তোমারও ভালোবাসার এবং ভালোবাসা পাবার অধিকার আছে। তোমার পরিচয় অন্ধত্ব নয়। তুমিও মানুষ। আমার এবং আমাদের মত স্বাভাবিক মানুষ। কিন্তু এই সমাজ এবং আমার মত মানুষদ্বারা পরিবেষ্ঠিত মানুষগুলোকে দেখে সেই কথা বলার হিম্মত আমার হয় নি। কারণ, আমরা এই মানুষগুলোকে কখনো শুধুই মানুষ ভাবতে পারি না। আমরা তাদেরকে কখনো শুধু মানুষ বলি না। আমরা তাদেরকে অন্ধ মানুষ বলি।


ঠিক একারণেই ইরাদেরা অন্ধত্বকে তাদের জীবনের জন্য অভিশাপ হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু ইরাদেরা তো আর ইচ্ছে করে অন্ধ হয় নি। তাই এতোটুকু দাবি করি,ইরাদদের পরিচয় অন্ধ মানুষ নয়। তাদের পরিচয় হোক, মানুষ। শুধুই মানুষ।

পঠিত : ৫১৮ বার

মন্তব্য: ০