Alapon

আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব ও রাষ্ট্রের গোপন তথ্য



অষ্টম হিজরিতে মুতার যুদ্ধের পর মুসলিমদের বীরত্বের কথা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়লো। মুহাম্মদ সা.-সহ মুসলিমরা তাবলিগ ও তারবিয়াতে সময় ব্যয় করতে থাকলো। এসময় মক্কায় একটি ঘটনা ঘটে। যার ফলে কুরাইশরা হুদায়বিয়ার সন্ধি লঙ্ঘন করে। হুদায়বিয়ার সন্ধি অনুসারে আরবের যে কোনো গোত্র মুসলিম অথবা মুশরিকদের সাথে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হতে পারবে। যারা মুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তাদের ওপর কুরাইশরা আক্রমন করতে পারবে না। আবার যারা কুরাইশদের সাথে বন্ধুত্ব করবে মুসলিমরা তাদের ওপর আক্রমণ করতে পারবে না।

হুদায়বিয়ার সন্ধি অনুসারে মক্কার বনু খুজায়া গোত্র মুসলিমদের সাথে বন্ধুত্ব করে আর বনু বকর গোত্র কুরাইশদের সাথে বন্ধুত্ব করে। বনু বকর ও বনু খুজায়ার মধ্যে বহু আগ থেকেই ঝামেলা চলে আসছিল। সন্ধির পর তারা উভয়েই যুদ্ধাবস্থা থেকে মুক্ত ছিল। তাই তারা মুক্তভাবে বিনা প্রস্তুতিতে চলাফেরা করতে থাকলো।

এমন সময়ে এক রাতে বনু বকরের একজন নওফেল ইবনে মুয়াবিয়া বনু খুজায়া গোত্রের একজনকে হাতের কাছে পেয়ে হত্যা করে। যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলো। উভয় গোত্র অন্যান্য গোত্রের সাথে দল পাকিয়ে তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হলো। কুরাইশরা এই সময় বনু বকরকে অস্ত্র দিল এবং তাদের সহযোগিতায় কুরাইশদের অনেকেই রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে বনু খুজায়ার সাথে যুদ্ধ করলো। দিশেহারা হয়ে খুজায়া গোত্র মসজিদুল হারামের নিষিদ্ধ এলাকার মধ্যে আশ্রয় নিল। সেখানেও তারা বনু বকরের আক্রমণের শিকার হলো।

বনু খুজায়ার লোকেরা মক্কায় তাদের এক মিত্র বুদাইল ইবনে ওয়ারাকার কাছে আশ্রয় নেয়। তারপরও বনু খুজায়ার ওপর আক্রমণ বন্ধ হয়নি। অবশেষে কুরাইশদের সহায়তায় বনু খুজায়ার কয়েকজনকে হত্যা করে বনু বকর। এই খবর রাসূল সা.-এর কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে বনু খুজায়া। রাসূল সা. তাদের সাহায্য করার আশ্বাস দেন।

এরপর বুদাইল বিন ওয়ারাকা (যিনি খুজায়াদের আশ্রয় দিয়েছেন) বনু খুজায়ার কতিপয় লোককে সঙ্গে নিয়ে মদীনায় গিয়ে মুহাম্মদ সা.-এর সাথে সাক্ষাত করলো। তাঁকে তাদের বিপদ মুসিবতের কথা এবং কুরাইশরা বনু বকরকে তাদের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নির্যাতন চালাচ্ছে তার কথা অবহিত করলো। অতঃপর মক্কায় ফিরে গেল। মুহাম্মদ সা. মুসলমানদেরকে জানালেন, “তোমরা ধরে নিতে পার যে, আবু সুফিয়ান তোমাদের কাছে এসেছে এবং সন্ধি চুক্তি অলংঘনীয় করা ও তার মেয়াদ বৃদ্ধি করার প্রস্তাব দিয়েছে।” নবীজি এই আগাম কথা বললেন এই কারণে যে, তিনি ৭ম হিজরিতে কাজা উমরাহ করার সময় কুরাইশদের নেতৃত্বহীন অবস্থায় দেখেছেন। তাদের পক্ষে এসময় মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করার মনোবল নেই।

এদিকে মক্কার মুশরিকরা এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে মিটিং করে। তখন সবাই আবু সুফিয়ানকে মুহাম্মদ সা.-এর সাথে দেখা করে সন্ধি বহাল রাখা ও এর সময়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিল। কারণ তারা মুসলিমদের ভয় পেয়েছে। মুতার যুদ্ধের যারা হেরাক্লিয়াসের সাথে যুদ্ধ করে তারা মক্কার কুরাইশদের উড়িয়ে দেবে এই ভয়ে তারা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করতে চায়নি।

তারপর আবু সুফিয়ান রওনা হয়ে মদিনায় মুহাম্মদ সা.-এর নিকট দেখা করতে আসলো। এসে নিজের কন্যা ও মুহাম্মদ সা.-এর স্ত্রী উম্মে হাবিবার কাছে গেল। আবু সুফিয়ান মুহাম্মদ সা.-এর বিছানায় বসার উপক্রম হতেই উম্মে হাবিবা বিছানা গুটিয়ে ফেললেন। তা দেখে আবু সুফিয়ান বললো, “হে আমার কন্যা! তুমি কি আমাকে ঐ বিছানায় বসার যোগ্য মনে করোনি?” উম্মে হাবীবা বললেন, “ওটা মুহাম্মদ সা.-এর বিছানা। আর আপনি একজন মুশরিক, অপবিত্র। আমি চাই না যে, আপনি মুহাম্মদ সা.-এর বিছানায় বসেন।” আবু সুফিয়ান বললো, “হে আমার কন্যা! আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার পর তুমি খারাপ হয়ে গিয়েছো।”

আবু সুফিয়ান এরপর মুহাম্মদ সা.-এর নিকট হাজির হলো এবং কথা বললো। কিন্তু নবীজি শুধু শুনলেন। তার কোনো কথার জবাব দিলেন না। অতঃপর সে আবু বকর রা.-এর নিকট গিয়ে এ মর্মে অনুরোধ করলো যাতে তিনি নবীজির কাছে তার সম্পর্কে সুপারিশ করেন। আবু বকর রা. এ অনুরোধ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন।

অতঃপর সে উমার ইবনুল খাত্তাব রা.-এর নিকট গিয়ে অনুরূপ অনুরোধ করলো। উমার বললেন “কি বলছো? আমি তোমার সম্পর্কে মুহাম্মদ সা.-এর নিকট সুপারিশ করবো? আমি যদি ছোট কাঠ ছাড়া আর কিছু না পাই তবে তা দিয়েই তোমার সাথে লড়াই করবো।”

এরপর সে আলী ইবনে আবু তালিব রা. নিকট গেল। সে বললো, “হে আলী! তুমি আমার প্রতি সর্বাধিক দয়ালু। আমি তোমার কাছে এসেছি একটা বিশেষ প্রয়োজনে। ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে চাই না। কাজেই তুমি আমার জন্য মুহাম্মদ সা.-এর নিকট সুপারিশ করো।” তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ সা. একটা ব্যাপারে সংকল্প গ্রহণ করেছেন, আমরা সে সম্পর্কে তাঁর সাথে কথা বলতে পারি না।”

আবু সুফিয়ান বললো, “হে আলী! আমি দেখছি পরিস্থিতি আমার প্রতিকূল। এখন আমাকে একটা সদুপদেশ দাও।” আলী রা. বললেন, “তোমার উপকারে আসবে এমন কোনো উপদেশ আমার জানা নেই। তবে তুমি তো বনু কিনানা গোত্রের নেতা। তুমি যাও, লোকজনকে রক্ষা কর। অতঃপর তোমার জন্মস্থানে অবস্থান করতে থাকো।” সে বললো, “এতে আমার শেষ রক্ষা হবে তো?” আলী রা. বললেন, “তা আমার মনে হয় না। তবে এ ছাড়া তোমার জন্য আর কোন উপায়ও দেখছি না।”

অতঃপর আবু সুফিয়ান মসজিদে নববীর সামনে গিয়ে ঘোষণা করলো “হে জনতা! আমি সকল মক্কাবাসীর রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছি।” এই বলেই সে উটে চড়ে প্রস্থান করলো। কুরাইশদের কাছে গেলে তারা জিজ্ঞোস করলো, “কি করে এসেছো?” সে মক্কাবাসীদের সব কথা জানালো।

মুহাম্মদ সা. মদিনায় সকল মুসলমান এবং নিজের পরিবার-পরিজনকে সফরের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন কিন্তু কোথায় যাবেন তা বলেন নি। এর কিছুদিন পর রাসূলুল্লাহ সা. মুসলমানদেরকে সুষ্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি মক্কা অভিমুখে যাত্রা করতে যাচ্ছেন। তিনি সবাইকে সফরের জন্য তৈরি হতে বললেন। এই সফরের খবর যাতে গোপন থাকে বিশেষত মক্কার লোকেরা যাতে না জানে এই ব্যাপারেও সাহাবাদের নির্দেশ দিলেন। তিনি মহান মালিকের কাছে দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ! কুরাইশদের থেকে আমাদের প্রস্তুতির যাবতীয় খবর গোপন রাখুন যাতে আমরা তাদের ওপর আকস্মিকভাবে গিয়ে চড়াও হতে পারি।” মুসলমানগণ অল্পক্ষনের মাধ্যেই তৈরি হলেন অভিযানের জন্য।

একজন মুহাজির সাহাবী নাম হাতিব ইবনে আবি বালতায়া রা.। তিনি রাসূল সা.-এর মক্কা আক্রমণের বিষয়টি আঁচ করতে পারেন। এরপর থেকেই তার মনে অস্থিরতা শুরু হয়। কারণ মক্কায় তার পরিবার পরিজন রয়েছে।তাঁর সন্তান-সন্ততি, ধন-সম্পদ মক্কাতেই ছিল। তবে তিনি নিজে কুরাইশদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না। শুধু তিনি হযরত উসমান রা.-এর মিত্র ছিলেন, এ জন্যেই মক্কায় তিনি নিরাপত্তা লাভ করেছিলেন। অতঃপর তিনি হিজরত করে রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে মদিনায় অবস্থান করছিলেন।

এই যখন পরিস্থিতি তখন মক্কা থেকে একজন মহিলা আসলো। সে আগে মহানবী সা.-এর দাদা আবদুল মুত্তালিবের দাসী ছিল। কিন্তু পরে দাসত্ব শৃঙ্খল মুক্ত হয়ে গানবাদ্য করে বেড়াত। নবীর সা. কাছে এসে সে তার দারিদ্রের কথা বলল এবং কিছু অর্থ সাহায্য চাইলো। নবী সা. বনী মুত্তালিবের লোকদের কাছে থেকে কিছু অর্থ চেয়ে দিয়ে তার অভাব পূরণ করলেন। সে মক্কায় ফিরে যাচ্ছিলো। এ ব্যাপারটির সুযোগ নিয়েছিলেন হাতিব ইবনে আবি বালতায়া রা.। তিনি ঐ মহিলার সাথে দেখা করলেন এবং কুরাইশ নেতাদের নামে লেখা একটি চিঠি তাকে দিলেন। আর সে যাতে এই গোপনীয় বিষয়টি প্রকাশ না করে এবং গোপনে তাদের কাছে পৌঁছে দেয় সে জন্য তিনি তাকে দশটি দিনারও দিলেন। মহিলাটি সবেমাত্র মদিনা থেকে রওনা হয়েছিল। ইতোমধ্যে আল্লাহ তা'আলা এই বিষয়টি নবী সা.-কে অবহিত করলেন।

রাসূল সা. তৎক্ষণাৎ হযরত আলী, হযরত যুবায়ের এবং হযরত মিকদাদ ইবনে আসওয়াদকে তার সন্ধানে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি নির্দেশ দিলেন, তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও। মহিলাটিকে ধরো। তার কাছে মুশরিকদের নামে হাতেবের একটি চিঠি আছে। যেভাবেই হোক তার নিকট থেকে সেই চিঠিটি নিয়ে এসো। সে যদি পত্রখানা দিয়ে দেয় তাহলে তাকে ছেড়ে দেবে। আর যদি না দেয় তাহলে তাকে হত্যা করবে।

আলী রা.-এর দল মদীনা থেকে ১২ মাইল দূরে মহিলাটির দেখা পেলেন। তাঁরা তার কাছে পত্রখানা চাইলেন। কিন্তু সে অস্বীকার করে বললো, আমার কাছে কোনো পত্র নেই। তাঁরা তার থলে তাল্লাশী করলেন। কিন্তু কোন পত্র পাওয়া গেল না। অবশেষে তারা বললেন, পত্রখানা আমাদের দিয়ে দাও তা না হলে আমরা তোমাকে বিবস্ত্র করে তল্লাশী নেব। সে যখন বুঝতে পরলো রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই তখন সে তার চুলের খোঁপার ভেতর থেকে চিঠি বের করে দিলো। আর আলী রা.-এর দল তা নিয়ে নবী সা.-এর দরবারে উপস্থিত হলেন। চিঠিটি খুলে পড়া হলো। দেখা গেলো তাতে কুরাইশদের জানানো হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সা. তোমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

মহানবী সা. হযরত হাতেবকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি একি করেছো? তিনি বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ আপনি আমার ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি যা করেছি তা এ জন্য করি নাই যে, আমি কাফের বা মুরতাদ হয়ে গিয়েছি এবং ইসলামকে পরিত্যাগ করে এখন কুফরকে ভালবাসতে শুরু করেছি। প্রকৃত ব্যাপার হলো, আমার আপনজনেরা সব মক্কায় অবস্থান করছে। আমি কুরাইশ গোত্রের লোক নই। বরং কুরাইশদের কারো কারো পৃষ্ঠপোষকতা ও ছত্রছায়ায় আমি সেখানে বসতি স্থাপন করেছিলাম। অন্য যেসব মুহাজিরের পরিবার-পরিজন মক্কায় অবস্থান করছে তাদের গোত্র তাদের রক্ষা করবে। কিন্তু আমার পরিবার -পরিজনকে রক্ষা করার মত কেউই সেখানে নেই। তাই আমি এই পত্র লিখেছিলাম। আমি মনে করেছিলাম, এটা হবে কুরাইশদের প্রতি আমার একটা অনুগ্রহ। এই অনুগ্রহের কথা মনে করে তারা আমার সন্তানদের ওপর নির্যাতন চালাবে না।

হাতেবের এই বক্তব্যে শুনে রসূলুল্লাহ সা. উপস্থিত সবাইকে বললেন, হাতেব তোমাদের কাছে সত্য কথাই বলেছে। অর্থাৎ এটিই তার এই কাজের মূল কারণ। ইসলামকে পরিত্যাগ বা কুফরকে সহযোগিতা করার মানসিকতা থেকে কাজটি হয়নি।

হযরত উমর উঠে বললেন, হে আল্লাহর রসূল সা.! আমাকে অনুমতি দিন। আমি এই মুনাফিকের শিরচ্ছেদ করি। সে আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
নবী করিম সা. বললেন, এ ব্যক্তি তো বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তোমরা তো জানো না, হয়তো আল্লাহ তা'আলা বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারীদের বিষয় বিবেচনা করে বলে দিয়েছেন, তোমরা যাই করো না কেন আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দিয়েছেন। একথা শুনে হযরত উমর রা. বললেন, আল্লাহ এবং তাঁর রসূলই সর্বাধিক জানেন। তাদের কথাই চূড়ান্ত।

যতদূর জানা যায় হযরত হাতেব রা.-এর এই ওজর শোনার পর তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছিল। তবে মহান রাব্বুল আলামীন এই বিষয়টিকে আমাদের জন্য শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে রেখে দিয়েছেন। তিনি এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সূরা মুমতাহিনা নাজিল করেছেন। সেখানে আল্লাহ আমাদের এইসব অপরাধ করা থেকে সতর্ক করে দিয়েছে। হযরত হাতেব রা. শুধু তার পরিবার পরিজনকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে রসূলুল্লাহ সা. এর অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি গোপন সামরিক তথ্য শত্রুদের জানিয়ে দেয়ার চেষ্ট করেছিলেন। এটি যথাসময়ের ব্যর্থ করে দেওয়া না গেলে মক্কা বিজয়ের সময় ব্যাপক রক্তপাত হতো। মুসলমানদেরও বহু মূল্যবান প্রাণ নষ্ট হতে পারতো এবং কুরাইশদেরও এমন বহু লোক মারা যেতো, যাদের দ্বারা পরবর্তী সময়ে ইসলামের ব্যাপক খেদমত পাওয়া গিয়েছিল।

শান্তিপূর্ণ উপায়ে মক্কা বিজিত হওয়ায় যেসব সুফল অর্জিত হয়েছে তা সবই পণ্ড হয়ে যেতে পারতো। এসব বিরাট ও ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হতো শুধু এ কারণে যে, মুসলমানদেরই এক ব্যক্তি যুদ্ধের বিপদ থেকে নিজের পরিবারকে নিরাপদ রাখতে চেয়েছিল। সূরা মুমতাহিনাতে হাতেব রা.-এর এ কাজের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। মারাত্মক এই ভুল সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে আল্লাহ তা’আলা সমস্ত ঈমানদারদের এ শিক্ষা দিয়েছেন যে, কোনো ঈমানদারের কোন অবস্থায় কোন উদ্দেশ্যেই ইসলামের শত্রু কাফেরদের সাথে ভালবাসা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক না রাখা উচিত। এবং এমন কোন কাজও না করা উচিত যা কুফর ও ইসলামের সংঘাতে কাফেরদের জন্য সুফল বয়ে আনে।

মহান রাব্বুল আলামীন বলেন সূরা মুমতাহিনার ১ ও ২ নং আয়াতে বলেন,
// হে ঈমানদারগণ, তোমরা আমার ও তোমাদের শত্রুদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তাদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করো না, অথচ তোমাদের কাছে যে সত্য এসেছে তা তারা অস্বীকার করেছে এবং রাসূলকে ও তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে এজন্য যে, তোমরা তোমাদের রব আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছ। তোমরা যদি আমার পথে সংগ্রামে ও আমার সন্তুষ্টির সন্ধানে বের হও (তবে কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না)। তোমরা গোপনে তাদের সাথে বন্ধুত্ব প্রকাশ করো, অথচ তোমরা যা গোপন করো এবং যা প্রকাশ করো তা আমি জানি। তোমাদের মধ্যে যে এমন করবে সে সরল পথ হতে বিচ্যুত হবে। তাদের আচরণ হলো, তারা যদি তোমাদের কাবু করতে পারে তাহলে তোমাদের সাথে শত্রুতা করবে। হাত ও জিহবা দ্বারা তোমাদের কষ্ট দেবে। তারা চায় যে, কোনক্রমে তোমরা কাফের হয়ে যাও।//

যাদের জন্য এই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তারা কিয়ামতের দিন কোনো কাজে আসবে না এই মর্মে আল্লাহ ৩ নং আয়াতে বলেন,
//কিয়ামতের দিন তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন কোনো কাজে আসবে না, সন্তান-সন্তুতি কোনো কাজে আসবে না। সেদিন আল্লাহ তোমাদের পরস্পর বিচ্ছিন্ন করে দেবেন। আর তিনিই তোমাদের আমল বা কর্মফল দেখবেন।//

নিশ্চয়ই আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা সহজ নয়। এটা খুবই কঠিন। মহান রাব্বুল আলামীন মুমিনদের তাই সান্তনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ৭ ও ৮ নং আয়াতে বলেন,
//অসম্ভব নয় যে, আজ তোমরা যাদের শত্রু বানিয়ে নিয়েছো আল্লাহ তা’আলা তাদের ও তোমাদের মধ্যে কোন এক সময় বন্ধুত্ব সৃষ্টি করে দেবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমতাবান। আর তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াময়। যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে লড়াই করেনি এবং বাড়ীঘর থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দেয়নি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার ও ন্যায় বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ ন্যায় বিচারকারীদের পছন্দ করেন।//

সবশেষে কোনো অবস্থায়ই জালিমদের বন্ধু বানানো যাবে না এই মর্মে মহান আল্লাহ তায়ালা আবারো ৯ নং আয়াতে সতর্ক করে দিয়েছেন শুধু তাই নয় তিনি বলেছেন যারা জালিমদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তারাও জালিম। তিনি বলেন,
//আল্লাহ তোমাদেরকে শুধু তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করছেন যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে লড়াই করেছে, বাড়ীঘর থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দিয়েছে এবং তোমাদেরকে তাড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে পরস্পরকে সাহায্য করেছে। যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে তারাই জালিম।//

মহান রাব্বুল আলামীন আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আত্মীয়দের দ্বীনের ওপরে স্থান দেওয়া থেকে রক্ষা করুন। জালিমদের বন্ধু বানানো থেকে রক্ষা করুন। আরো বেশি আমানতদার হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমাদের খিয়ানত থেকে দ্বীন ইসলামকে রক্ষা করুন। আমিন।

পঠিত : ৩৩৬ বার

মন্তব্য: ০