Alapon

নামাযে মনোযোগ স্থাপনের উপায়

প্রায়ই অনেকেই বলে থাকে, - 'ভাইয়া, নামাজে মন বসে না। কী করবো বলুন তো?'


সাধারণত এটাকে একটা সিম্পল প্রশ্ন বলে মনে হলেও, আদতে এটা একটা সমস্যা। সহজ সরল কিংবা জলবৎ তরলং টাইপের কোন সমস্যা নয়। খুব জটিল সমস্যা। সমস্যাটা আমাদের নিত্যদিনের।


নামাজ হচ্ছে ইসলামের পাঁচটা রুকনের মধ্যে একটা। একজন ব্যক্তি ঈমান আনার সাথে সাথে তার উপর প্রথম যে জিনিসটা ফরজ হয়ে যায় সেটা হচ্ছে সালাত তথা নামাজ। কিন্তু, দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এটাই যে, আমরা অধিকাংশই আমাদের নামাজে মনোযোগ দিতে পারি না। নামাজ পড়ি ঠিকই, কিন্তু নামাজে যেভাবে মন দেওয়া উচিত, যেভাবে যত্নবান হওয়া উচিত, যেভাবে খুশুখুযূর সাথে নামাজ পড়া দরকার, সেটা ঠিক হয়ে উঠে না।
নামাজে দাঁড়ালেই যেন আমাদের মন নাটাইবিহীন ঘুঁড়ি হয়ে উঠে। পৃথিবীর এ'প্রান্ত থেকে ও'প্রান্ত পরিভ্রমণ করতে থাকে।
খেলা পাগল ছেলেটা যখন নামাজে দাঁড়ায়, তার মন তখন উশখুশ করতে থাকে তার প্রিয় দলের পারফরম্যান্স নিয়ে। লা-লীগা টেবিলে বার্সা তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে। লীগে সর্বোচ্চ গোল নিয়ে মেসি এবারও এগিয়ে আছে পিচিচি এওয়ার্ডে।
ফর্মবিহীন রোনালদোকে নিয়ে কী হতে পারে জিদানের স্ট্রাট্যাজী?
কেউ ভাবে, ম্যানসিটি তো পয়েন্টই হারাচ্ছেনা ইপিএলে। ওইদিকে ইউসিএলে দূর্দান্ত ফর্মে থাকা পিএসজিও হয়ে উঠছে অন্য ডাকাবুকো দলের ফ্যানদের মাথাব্যথার কারণ। নেইমার-এম্বাপে-কাভানিকে থামাতে হলে কী হতে পারে তুরুসের তাস?


যারা মুভি ফ্যান, মুভি ছাড়া যাদের চলেই না, তারা তাদের দেহ নিয়ে নামাজে দাঁড়ালেও, তাদের মন মুভির জগতেই পড়ে থাকে। হলিউড-বলিউডের বক্স অফিস হিট করা মুভিগুলোকে রিভিউতে এরা কাঁটাছেঁড়া করে। খুঁত বের করে। বের করে আনে সেরা পয়েন্টগুলো।


যারা নিজেদের চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, তারা নামাজে দাঁড়ালেও তাদের মাথা থেকে প্রমোশন, অফিসে বসের নজরে আসা ইত্যাদি ব্যাপার স্যাপার মাথায় ঘুরপাক খায়।


যারা শিক্ষার্থী, তারা নামাজে দাঁড়ালে তাদের মাথায় ভালো প্রতিষ্ঠানে চান্স, জিপিএ-৫, সিজিপিএ, বিসিএস ইত্যাদি জিনিস ভর করে বসে। সকল চিন্তা কেন্দ্রীভূত হয় এসবে।
তখন মুখস্ত কিছু সূরা বুলেটের গতিতে গড়গড় করে তিলাওয়াত করে, ধপাধপ রূকু-সিজদাহ করে নামাজটা শেষ করতে পারলেই যেন বাঁচি।


যারা ব্যবসায়ী, তারা নামাজে দাঁড়ালেই যেন হয়ে উঠি আরো ব্যবসায়ী। যারা রাজনীতিবিদ, তারা নামাজে দাঁড়ালেই হয়ে উঠি যেন আরো রাজনীতিবিদ।
অথচ, কথা ছিলো নামাজে আমাদের সকল চিন্তা কেন্দ্রীভূত হবে কেবল মহান র'বের প্রতি। কথা ছিলো, নামাজে দাঁড়ালেই আমরা কেবল একমন একধ্যানে নিমগ্ন হবো বিশ্ব জাহানের প্রতিপালকের ইবাদাতে। কিন্তু হয়েছে তার উল্টোটি। নামাজটা যেন হয়ে উঠে আমাদের দুনিয়াবি চিন্তাভাবনার মোক্ষম সময়। এত্তো এত্তো চিন্তা ভর করে নামাজে, উফফফ!


আমরা নামাজে মনোযোগী নই। আমাদের মতো নামাজীদের জন্যই তো দূর্ভোগের ঘোষণা এসেছে আল কোরআনে-


'অতএব, দূর্ভোগ ঐ সমস্ত নামাজীদের জন্য, যারা নিজেদের নামাজের ব্যাপারে উদাসীন।'
সুরা আল-মাউন, আয়াত ৪-৫।


চিন্তা করুন, এখানে একটি দূর্ভোগের কথা বলা হচ্ছে। একটি বিপর্যয়ের ঘোষণা। এই দূর্ভোগ কোন মুশরিকের জন্য নয়। এই দূর্ভোগের ঘোষণা কোন মুনাফিক্ব, কাফেরের জন্য নয়। এই দূর্ভোগের ঘোষণা সেই সমস্ত নামাজীদের জন্য, যারা তাদের নামাজের ব্যাপারে উদাসীন, গাফেল।


প্রশ্ন থেকে যায়, তাহলে নামাজে মনোযোগ আনার জন্য কী করা যায়?
সমাধানের রাস্তা খোঁজার আগে চলুন কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি।


আমি কী মুভি দেখি বা দেখা বাদ দিয়েছি?
আমি কী গান শুনি বা শোনা বাদ দিয়েছি?
আমি কী ফ্রি মিক্সিং তথা ছেলে-মেয়ের অবাধ মেলামেশায় লিপ্ত?
আমি কী বিবাহ বহিঃভূত অবৈধ সম্পর্ক থেকে মুক্ত?
আমি কী ইসলামের সকল বিধানকে সজ্ঞানে মেনে চলি?
ইসলাম নিষেধ করেছে এমন কিছু আমার কাছে স্পষ্ট হবার পরেও আমি কী তা করে থাকি?
আমি কী অশ্লীলতা পরিহার করতে পেরেছি?


প্রশ্নগুলো নিজেকে করি। উত্তর হিসেবে 'হ্যাঁ '/ 'না' যা-ই আসুক, তা যদি একজন মুসলিম এর জন্য 'উচিত' হয়, তাহলে নামাজে আপনার মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হবার কোন চান্স নেই। যদি তা একজন মুসলিমের জন্য 'অনুচিত' হয়, তাহলে আপনি নামাজের মতো করে নিছক শারীরিক ব্যায়াম ছাড়া আর কিছুই করছেন না।


জাহিলিয়াতের বর্বর সময়। তখন চারিদিকে ভর করে আছে শিরক, কুফর সহ যাবতীয় বিধর্মীয় রীতি-নীতি।
এমতাবস্থায়, রাসূল (সাঃ) যখন তাওহীদের বাণী নিয়ে আসলেন, তাঁর সেই বাণীতে যারা সাড়া দিয়েছিলো, তারা তখন নিজেদের আমূল বদলে নিয়েছিলো।


হজ্বের সময়ে সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার করে দৌঁড়ানোর যে রীতি, সেটা হজরত ইব্রাহীম (আঃ) এর সময় থেকেই প্রচলিত। কিন্তু, কালক্রমে ইব্রাহীম (আঃ) এর প্রচারকৃত একত্ববাদ ভুলে মানুষ শিরকে লিপ্ত হয়। প্রকৃতি পূজা, মূর্তি পূজায় ছেঁয়ে যায় তৎকালীন সমাজ।
শিরকে লিপ্ত হলেও, ইব্রাহীম (আঃ) হতে প্রচলিত কিছু রীতি তখনও মক্কার মুশরিকরা পালন করতো। সেরকম ধর্মীয় আচারের একটি ছিলো সাফা মারওয়াতে দৌঁড়াদৌঁড়ি। এটাকে বলা হয় 'আস-সাঈ'।
এখন, রাসূল (সাঃ) এর ডাকে যারা মূর্তিপূজা ছেড়ে ইসলামে এসেছিলেন, সেরকম একজন হলেন হজরত আনাস বিন মালিক।
একবার, আনাস বিন মালিক (রাঃ) জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, - 'আপনি কী আস-সাঈ (সাফা মারওয়ায় দৌঁড়াদৌঁড়ি) করতে ঘৃণা করতেন?'
তিনি জবাবে বলেছিলেন,- 'হ্যাঁ, আমি এটা ঘৃণা করতাম। কারণ, এটা ছিলো জাহিলিয়াতের সময়কার রীতি (অর্থাৎ, মুশরিক থাকাবস্থাতেও তারা এটা করতেন)। কিন্তু, আমি এটাকে ততক্ষণ ঘৃণা করেছি, যতক্ষণ না কোরআনের এই আয়াত নাযিল হয়। সেটি হলো- 'অবশ্যই সাফা এবং মারওয়া পাহাড় দুটো আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্যতম। অতএব, তোমাদের কেউ যদি হজ্বের ইরাদা করো, তাহলে তার জন্য এ দুটোতে (সাফা-মারওয়া) তাওয়াফ করাতে দোষের কিছু নেই'- আল বাক্বারা ১৫৮


খেয়াল করুন, আনাস বিন মালিক (রাঃ) সাফা-মারওয়ায় আস-সাঈ করাতে কেনো ঘৃণা করতেন? কেবলমাত্র এটা জাহিলিয়্যাতের রীতিতেও ছিলো, এজন্যে...
অথচ, এই জাহিলিয়্যাতেই তিনি বড় হয়েছেন। এই রীতি তাঁর বাপ-দাদার রীতি। পূর্ব পুরুষের রীতি। কিন্তু, হঠাৎ করে শাহাদাহ পাঠ করেই কীভাবে তিনি এতোটাই পাল্টে গেলেন যে নিজের কিছু সময় আগেকার রীতিকেই ঘৃণা করা শুরু করে দিলেন? আশ্চর্য না? এটাই হচ্ছে ঈমান।
আবার, কোরআন যখন এই রীতিকে সত্যায়ন করলো, যখন বললো এটাতে দোষের কিছু নেই, তখন আবার সেই একই রীতিকেই মেনে নিলেন। আঁকড়ে ধরলেন। কীভাবে সম্ভব? জ্বী, এটার নাম দ্বীন ইসলাম। এটা এভাবেই রাতারাতি একটা মানুষের জীবনকে আমূল বদলে দেয়।


আপনি একজন মুসলিম, পাশাপাশি যদি একজন মুভিখোর হোন, যদি 'ডুব' আর 'ঢাকা এ্যাটাক' মুভির রিভিউ লেখাকে আপনি অবশ্য কর্তব্য করে নেন, তাহলে আপনার মতো নামাজীর জন্য দূর্ভোগ।
আপনি একজন মুসলিম, যদি পাশাপাশি ছেলে-মেয়ের অবাধ মেলামেশা, ফ্রি মিক্সিং, অবৈধ সম্পর্ক, অনৈতিক সম্পর্ক, অশ্লীলতা সহ ইত্যাদি অনৈসলামিক ব্যাপারগুলো ছাড়তে না পারেন, তাহলে আপনার মতো নামাজীদের জন্যই দূর্ভোগ....


দ্বীনের ব্যাপারে কম্প্রোমাইজ, 'হাফ-হাফ' কিংবা 'চুস এন্ড পিক' এর কোন সুযোগ নেই যে মন চাইলো মানলেন আর মন চাইলোনা বাদ দিলেন।
দ্বীন যেটা অনুমোদন করে, সেটা আপনার অপছন্দ হলেও মানতে হবে। দ্বীন যেটা অনুমোদন করেনা, সেটা আপনার পছন্দের হলেও ত্যাগ করতে হবে। তবেই আপনি মুসলিম।
কাজে মুসলিম হতে হবে, নামে নয়। যেদিন আমরা কাজে মুসলিম হতে পারবো, সেদিনই আমাদের নামাজগুলো প্রাণ ফিরে পাবে।

পঠিত : ৭৩০ বার

মন্তব্য: ০