Alapon

~বিজয়ীর ভূমিকা~



আজকের বিজয়ী বীর মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ﷺ। সেই বিজয়ী বীর মুহাম্মাদ- ﷺ বিজয়ের পরে অতি উল্লাসে লম্পঝম্প শুরু করে দেন নি। পরাজিতদের প্রতি ঘৃণার চাষাবাদ করেন নি। অহংবোধে জড়িয়ে গিয়ে কলিজাটাকে কালো করে ফেলেন নি। আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া স্বরূপ দু’রাকাআত সালাত আদায় করেন। তিনি তাঁর চরম শত্রু পরাজিতদেরকে ক্ষমা করে দেন। বিজেতার হাতে শত্রুদেরকে ক্ষমা করার মতো এক অনন্য নজির স্থাপন করেছিলেন সেদিন মুহাম্মদ- ﷺ। বলছিলাম মুহাম্মাদ ﷺ-এর মক্কা বিজয়ের কথা।
সে ঘটনাটা ৮ম হিজরীর ১০-ই রমাদানের। আল্লাহর রাসুল ﷺ মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ছেন তাঁর সাহাবিদেরকে নিয়ে। কিন্তু সে সংবাদটা সম্পূর্ণ গোপন রেখে, মদিনার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবু রূহম গিফারি রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে নিয়োগ দিয়ে মহানবী মুহাম্মাদ ﷺদশ হাজার সাহাবি নিয়ে মক্কার কুরাইশদের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য মদিনা ত্যাগ করেন। অনেকটা পথ তিনি পাড়ি দিলেন। পথিমধ্যে শিবির স্থাপন করলেন তিনি। বিশাল এই বাহিনী দেখে মুশরিক কুরাইশরা বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে পড়ে।
তখন ছিলো রাত। মুহাম্মাদ- ﷺ প্রত্যেক তাঁবুতে আগুন জ্বালানোর জন্য নির্দেশ প্রদান করলেন। মুশরিকরা তা দেখে মুসলিম বাহিনীর প্রকৃত শক্তি যা, তা থেকে অনেকগুণ বেশি বলে ধারণা করলো। তাদের অন্তর ভয়ে জড়োসড়ো ও প্রকম্পিত হয়ে উঠলো। সে সময় রাসুল্লাহ ﷺ-এর চাচাতো ভাই, তৎকালীন মুশরিক নেতা আবু সুফিয়ান ছদ্মবেশে মুসলিম শিবিরের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য আসে। আর তখনই ইসলামের তৎকালীন চরম এই দুশমন—ওহুদের দিনে রাসুল্লাহ ﷺ-এর প্রাণপ্রিয় চাচা সাঈয়িদুস শুহাদা হামজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হন্তারকের স্বামী, তাঁর দন্ত মুবারাক শহিদ করার যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানদানকারী— আবু সুফিয়ান মুসলমানদের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে যায়। সাথে সাথে আবু সুফিয়ানকে নিয়ে আসা হলো মানবিক মহাপুরুষ মুহাম্মদ ﷺ-এর কাছে। দয়ার আধার, করুণার মূর্ত প্রতীক মহানবী মুহাম্মদ ﷺ তাকে ক্ষমা করে দেন এবং সাথে এ-ও ঘোষণা করেন, যে বা যারা আবু সুফিয়ানের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করবে তারাই নিরাপত্তা লাভ করবে।
আবু সুফিয়ান রাসুল্লাহ ﷺ-এর এমন মহানুভবতা ও উদার নীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পরবর্তীতে ইসলামে দীক্ষিত হন। এবং মক্কায় পৌঁছে মুসলমানদের আগমনের খবর ও তাদের বিরুদ্ধাচরণ করা যে বুদ্ধিমানসূলভ কাজ হবে না, তা প্রচার করলেন। পরদিন মহানবী মুহাম্মদ-ﷺ শান্তিপূর্ণভাবে মক্কায় প্রবেশ করলেন এবং কোনোরূপ রক্তপাত থেকে বিরত থাকতে সকলকে নির্দেশ দিলেন। উসমান বিন ত্বলহা থেকে কা’বা ঘরের চাবি নিয়ে সেখানে প্রবেশ করে আল্লাহর দরবারে অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ-প্রদর্শন করলেন। এরপর নিজের ধনুক দিয়ে একে একে সমস্ত প্রতিমাগুলোকে চূর্ণবিচূর্ণ করে শিরকিয়্যাতের সামান্যতম গন্ধ থেকেও কাবাঘরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং পবিত্র করলেন।
অতঃপর তিনি সমস্ত মক্কাবাসীর উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ প্রদান করার উদ্দেশ্যে দণ্ডায়মান হলেন। আল্লাহর রাসুলের সামনে তখন ভীতচকিত হয়ে অসহায়-অনাথ মিসকিনের মতো বিবর্ণ মুখ নিয়ে মাথা নীচু করে দণ্ডায়মান হয়ে আছে সেসমস্ত নিষ্ঠুরতম আচরণকারী মানুষগুলো—যারা তাঁর সাথিদেরকে অন্যায়ভাবে খুন করেছে, তাঁর আন্দোলনের অনেক সঙ্গীর মায়ের বুক খালি করেছে, স্ত্রীদেরকে করেছে বিধবা এবং অনেক সন্তানকে করেছে এতিম। তাদের আহার-বিহার ও সহায়সম্পত্তি কেঁড়ে নিয়েছে, ফল-ফলাদি এবং ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করেছে। প্রিয় নবির প্রাণপ্রিয় চাচা সাঈয়িদুস শুহাদা হামজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কলিজা চিবিয়ে খাওয়া যুদ্ধাপরাধী পিশাচিনী হিন্দাও ভয়াতুর চাহনিসমেত সেখানে উপস্থিত। রাসুল ﷺ-কে তাঁর গৃহের অভ্যন্তরে গভীর রাত্রিতে হত্যার পরিকল্পনাকারী, মাতৃভূমি থেকে বিতাড়নকারী পাষাণ্ড সব জালিমেরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। যাদের প্রত্যেককে ধরে ধরে মস্তিস্ক দ্বিখণ্ডিত করে দেওয়ার মতো ক্ষমতা তখন মহানবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর হাতে আছে পরিপূর্ণভাবেই। তাবৎ পৃথিবীর যেকোনো বিজয়ী বীর তার শত্রুদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহনের এই মহা মওকাকে কোনোক্রমেই হাতছাড়া করবে না। করে না। এরকম জালিমদের নিকট থেকে এভাবে প্রতিশোধ গ্রহন করাটা কোনোভাবেই আদল-ইনসাফের বিরুদ্ধে যায় না। কিন্তু মানবিক মহাপুরুষ মহানবী মুহাম্মাদ ﷺ তাঁর সকল ক্লেদ-ক্ষোভ আর আফসোসকে ভুলে গিয়ে তাদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বলতে লাগলেন— আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তিনি তাঁর ওয়াদা পূরণ করেছেন।তাঁর দাসকে সাহায্য করেছেন। তিনি তাঁর শক্তিবলেই ঐক্যবদ্ধ জাহেলিয়াতের শক্তিকে পরাজিত-পরাভূত করেছেন। কা’বার যত্ন নেয়া ও হাজিদের পানি পান করানো ছাড়া কোনো সম্পত্তির ওপর কোনো বিশেষ অধিকার দাবি করা যাবে না। একইভাবে গর্ব-অহংকার, প্রতিশোধ ও জুলুমের সব ধরনের অপচর্চা মক্কার জমিন থেকে বিলুপ্ত করা হলো। হে কুরাইশরা! জাহিলিয়াতে আচ্ছন্ন তোমাদের বংশের অহমিকা আল্লাহ রব্বুল আলামিন ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। সব মানুষ সমান। সবাই আদমের সন্তান। আর আদম মাটি থেকে তৈরি। এরপর তিনি পবিত্র কুরআন মাজিদের নিম্নের আয়াতটি তিলাওয়াত করেন—
‘হে মানুষ! তোমাদেরকে আমি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং বিভিন্ন সমাজ ও জাতিতে ভাগ করেছি, যেন তোমরা পরস্পরের পরিচয় জানতে পারো। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন, যে বেশি আল্লাহ-সচেতন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব জানেন, সব বিষয়ে সচেতন।’(আল- কুরআন ৪৯ / ১৩)
এরপর রাসুলে কারিম ﷺ আরো বলেন; হে কুরাইশ জনগণ, তোমাদের কী ধারণা, আমি তোমাদের সঙে কেমন ব্যবহার করবো? আমার কাছে আজ তোমরা কীরূপ আচরণ প্রত্যাশা করছো? তাদের মধ্যে চলছিলো তখন পিনপতন নীরবতা। অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে কুরাইশদের মাঝখান থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এলো—‘আপনি আমাদের মহানুভব ভাই এবং সম্মানিত ভ্রাতুষ্পুত্র! আপনার কাছ থেকে আমরা শুধু ভালো আচরণই প্রত্যাশা করি!’
নিস্তব্ধতা ভেঙে যে আওয়াজ ভেসে আসলো সবার কানে কানে, সবাই তাদের দৃষ্টিকে যেই কণ্ঠস্বরের দিকে নিক্ষেপ করলো, সেই কণ্ঠস্বর আর কারো নয়। আজ ভোরেও যেই ব্যক্তি অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো জেনারেল খালিদ বিন ওয়ালিদের বাহিনীর ওপর—যদিও সে পরবর্তীতে বীর কেশরী খালিদ বিন ওয়ালিদের আক্রমণে নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে পালিয়ে গিয়েছিলো—ইসলাম ও প্রিয় নবির সেই চিরশত্রু সোয়াহিল ইবনে আমরের। তার কণ্ঠ থেকেই ভেসে এসেছে প্রাণ বাঁচানো এই নিবেদন। বিশ্বনবি মুহাম্মাদ- ﷺ তখন দৃপ্ত ও দীপ্ত কণ্ঠে বললেন—
“আজ এই সময়ে আমি আমার ভাই ইউসুফ যে কথাটি তাঁর ভাইদের প্রতি বললো, আমিও তোমাদেরকে তা-ই বলছি; তোমাদের কারো প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। তোমাদের সবাইকে ক্ষমা করা হলো। ওঠো! যাও। তোমরা সবাই মুক্ত।” [ আর-রাহিকুল মাখতুম : ৪৬২-৪৬৪]
মানবিক মহাপুরুষ মহানবী মুহাম্মাদ- ﷺ এর মহানুভবতায় কুরাইশদের ক্বলব থেকে সেদিন সে ক্ষণে বংশ পরম্পরায় লালিত ঘৃণা ও বিদ্বেষের বরফ মুহূর্তেই গলে গলে বাষ্প হতে শুরু করলো। তারা এতোটা মহানুভবতা আর আনুকূল্য পাবে বিজয়ী বীর বিশ্বনবি থেকে, তা ছিলো তাদের ভাবনা-কল্পনারও ঊর্ধ্বে। এভাবে, আর এরকম ভূমিকা-ই রেখেছেন বীজয়ের পরক্ষণে বীজয়ী বীর মুহাম্মাদ- ﷺ। তিনি ক্ষমা আর মানবিক আচরণ দিয়েই জয় করলেন মানুষের হৃদয়কে। আর চিরতরে মক্কাতুল মুকাররামাহকে মুক্ত করলেন জাহিলিয়াতের শৃঙ্খল থেকে। চিন্তা করা যায় কী এক অপূর্ব দৃষ্টান্তমূলক ক্ষমা প্রদর্শনের সাক্ষর রাখলেন তিনি! সুদীর্ঘ তেরো বছর ধরে তিনি ও তাঁর সাহাবিগণ মক্কায় এই মুশরিক কুরাইশদের হাতে-ই তো কী ভয়াবহ আর অবর্ণনীয় নির্যাতন ভোগ করেছেন। তাদের নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে মুসলমানরা বাধ্য হয়ে নিজ জন্মভূমি, মাতৃভূমি ছেড়ে মদিনায় হিজরত করতে হয়েছে, স্বজন হারানোর বেদনায় কাতরাতে হয়েছে দিনের পর দিন। ইতিহাসে এমন নজির খুঁজে পাওয়া যায় না যে, কোনো বিজয়ী বীর পরাজিত শত্রুদেরকে এভাবে এমন ক্ষমা ও ভালোবাসা প্রদর্শন করতে পারে।

এভাবে আল্লাহর নবি দয়া-মায়া ও ভালোবাসা দিয়ে মক্কা বিজয় করার পর সারা বিশ্বের মাঝে মক্কার একটি নতুন পরিচয় ফুটে ওঠে। আরবের গোত্রগুলোও দলে দলে ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হতে শুরু করে। এই বিষয়টি আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাঁর কালামেপাকে বলেন—“যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে, এবং আপনি তখন মানুষকে দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করতে দেখবেন।”[আল-কুরআন : ১১০/ ০১-০২]
আর সত্যিই প্রতিদিন কোনো না কোনো গোত্র আল্লাহর রাসুলের কাছে আসতো, মক্কায় আসতো, এসে ইসলাম গ্রহণ করতো। ইতিহাসে মক্কা বিজয়ের পরের বছরকে প্রতিনিধি দলসমূহের আগমনের বছর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সে বছর অর্থৎ ৯ম/১০ম হিজরী সনে প্রায় ৭০-এর মতো প্রতিনিধি দল এসে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে।

এই যে একটা বিরাট বিস্ময়কর বিজয় আর সাফল্য, সে বিজয়ে আর সাফল্যে বিজয়ীর ভূমিকা কী হবে আল্লাহ রব্বুল আলামিন তা বাতলে দিয়েছেন উক্ত সুরাটিতেই। আল্লাহ বলেন— “তখন তুমি তোমার রবের হামদ সহকারে তাঁর তাসবীহ পড়ো এবং তাঁর কাছে মাগফিরাত চাও৷ অবশ্যই তিনি বড়োই তাওবা কবুলকারী।” [আল-কুরআন : ১১০/০৩]

এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বিজয়ের পরে বীজয়ীর কাজ কী এবং কেমন হবে, সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় হাবিব, বীজয়ী বীর মুহাম্মাদ ﷺ-কে বলেছেন বিজয়ের পরে উচ্ছৃঙ্ক্ষলা নয়, গর্ব-অহংকার কিংবা বিরোধী পক্ষের প্রতি বাড়াবাড়ি নয়, বরং বিজয়ের মুকুট পরিধান করার জন্য মহান আল্লাহর প্রশংসা ও গুণাবলি প্রকাশ করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হতে।
আল্লাহ কেনো এমন নির্দেশনা প্রদান করলেন? এসম্পর্কে সাঈয়িদ মওদূদী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আল্লাহ এমন নির্দেশনা প্রদান করেছেন এই জন্য যে, এ মহান ও বিরাট সাফল্য সম্পর্কে মুসলিমদের মনে যেনো কখনো এবং কোনো সময়-ই যেনো বিন্দুমাত্রও এই ধারণা না জন্মায় যে, এসব নিজেদের কৃতিত্বের ফল। বরং এই মহাবিজয় আর সাফল্যকে পূর্ণরূপে মহান আল্লাহর অসীম অনুগ্রহ ও মেহেরবানী মনে করা হয়। আর এজন্য-ই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। মনে ও মুখে একথা স্বীকার করবে যে, এ সাফল্যের জন্য সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর প্রাপ্য।

আর তাসবীহ পাঠ করার মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার বিষয়টি আমাদের প্রচেষ্টা ও সাধনার ওপর নির্ভরশীল ছিলো—এ ধরনের কাঁচা ধারণা থেকে যেনো মনকে পবিত্র ও মুক্ত রাখতে পারা যায়। এর বিপরীতে আমাদের অন্তর এই দৃঢ় বিশ্বাসে পরিপূর্ণ থাকবে যে, আমাদের প্রচেষ্টা ও সাধনার সাফল্য আল্লাহর সাহায্য ও সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল ছিলো। তিনি তাঁর যে বান্দা থেকে চান কাজ আদায় করে নিতে পারেন। তবে তিনি আমার খিদমাত নিয়েছেন এবং আমার কাজের মাধ্যমে তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করেছেন, এর মানে হলো এটা আমার প্রতি তাঁর এক অনুপম অনুগ্রহ।

এরপর আল্লাহ বলেছেন, তোমার রবের কাছে মাগফিরাত প্রার্থনা করো। তিনি তোমাকে যে কাজ করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তা করতে গিয়ে মানুষ হিসেবে হয়তো তোমার কিছু ভুল-বিচ্যুতি হয়ে গিয়েছে, তা যেনো তিনি তাঁর অপরিসীম উদারতায় ক্ষমা করে দেন।

আল্লাহ রব্বুল আলামিন এই সুরার আয়াতটি দ্বারা মক্কার বিজয়ী বীর রাসুলে কারিম ﷺ-এর মাধ্যম তাঁর সকল বান্দাকে এই ভদ্রতা ও শিষ্টাচার শিখিয়েছেন যে, কোনো মানুষের নেতৃত্বে কিংবা মানুষের মাধ্যমে আল্লাহর দ্বীন আল-ইসলামের যতো বিশাল কাজই আঞ্জাম হোক না কেনো, তাঁর পথে সে যতো বড়ো কুরবানির নজরানা-ই পেশ করুক কেনো, কিংবা তাঁর দাসত্ব ও আনুগত্য করার ব্যাপারে যতো প্রকারেরই প্রচেষ্টা চালাক না কেনো, সে ব্যক্তির অন্তরে যেনো কোনো সময়-ই এমন চিন্তার উদ্ভব না হয় যে, তার ওপর আল্লাহর যে হক ছিলো তা সে পরিপূর্ণভাবে আদায় করে ফেলেছে। বরঞ্চ সর্বদা বান্দা হিসেবে মানুষের অন্তরে এই ধারণা বদ্ধমূল রাখা উচিত যে— আল্লাহ সুবহানাহু ও’তাআলার আদেশ-আনুগত্য আদায়ে যেসকল অপরগতা কিংবা ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে গিয়েছে কিংবা করে ফেলেছে সে, তা যেনো ক্ষমার আধার আল্লাহ রব্বুল আলামিন ক্ষমা করে দিয়ে তার কৃত নগণ্য কাজগুলো যেনো কবুল করে নিয়ে তাকে যেনো ধন্য করেন। [ তাফহীমুল কুরআন : সুরা নাসর, টিকা: ০৩-০৪]


এই যে বিজয়ীর ভূমিকা নির্ধারণকারী সুরাটি, এটি বিদায় হজ্জের সময় আইয়ামে তাশরীকের মাঝামাঝি সময় মিনায় ওবতীর্ণ হয়। এটি অবতীর্ণ হবার পর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর উটের পিঠে সওয়ার হয়ে বিদায় হজ্জের বিখ্যাত ভাষণটি প্রদান করেন।
উক্ত আলোচনা থেকে আমাদের কাছে যে বিষয়টি শিখতে পারি, তা হলো বীজয়ীর ভূমিকা কেমন এবং কীরূপ হবে? আসলে দুনিয়ায় চলতে গেলে আমরা কখনো হারি কখনো জিতি। কখনো বিজয়ী হই কখনো হই পরাজিত। তবে মুমিনদের হারের মাঝেও কখনো কখনো লুকিয়ে থাকে এক মহা বিস্ময়কর বিজয়। এক কথায় মুমিনগণ জিতলেও জিত। হারলেও জিত। কিন্তু অবিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে না। দুনিয়াটাই তাদের সব। পরকালে তাদের জন্য কিচ্ছু নেই। এজন্য তাদের বিজয়ের উদযাপন তারা কানায় উপভোগ করে। বিজয়ের পরে তারা অহংকারী হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে মুসলিমদের বিজয় উদযাপন হচ্ছে একেবারেই ভিন্ন রকমের। তাঁরা বিজয়ের পরে অহংকারী হয়ে পড়ে না। অতি উল্লাসে ফেটে পড়ে না। তাঁরা বিনম্র চিত্তে মস্তক লুটিয়ে দেয় অসীম আল্লাহর কাছে। তাঁর-ই চরণে। আমরা যেহেতু মুসলিম। মুহাম্মাদুরর রাসুলুল্লাহ স্বল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের অনুসারী। ইসলামের প্রতি আত্মসমর্পনকারী। সেহেতু আমরা দেখা উচিত আমাদের রাসুল জয়-পরাজয়ের সময় কী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। বিজয়ী বীরদের প্রতিও বা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশনা কী এবং কেমন। বিজয়ী বীর হিসেবে আল্লাহর রাসুলের ভূমিকা কী এবং কেমন ছিলো সে বিষয়ে তো আমরা ওপরে আলোচনা করে এসেছি।


আসলে যখনই আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের অনুসারীগণ দুনিয়ার বুকে কোনো বিজয় লাভে সমর্থ হবে তখন তারা উক্ত বিজয়কে নিজেদের কোনো কৃতিত্ব নয় বরং মহান রব্বের রহমের মুর্ছনা এবং একান্ত অনুগ্রহের ফলাফল মনে করবে। তারা অন্যদের মতো গর্ব-অহংকার, বাড়াবাড়ি, জুলুম কিংবা প্রতিশোধের দিকে না ঝুঁকে নিজেদের প্রতিপালক মহান আল্লাহর সামনে বিনয়ের সঙে মস্তিস্ক অবনত করে হামদ, সানা, তাসবীহ পড়বে এবং তাওবা-ইসতিগফার করতে থাকবে। পূর্বে যারা তাদের প্রতি জুলুমের জোয়াল চাপিয়েছে, তাদের প্রতি যথাসাধ্য ক্ষমা ও দয়ার ডানা প্রসারিত করবে। যেভাবে মক্কার মুশরিকদের প্রতি আল্লাহর রাসুল মুহাম্মাদ ﷺ করেছেন। তিনি মক্কা বিজয়ের পর দশজনকে ক্ষমা করেননি। এই যে যাদের ক্ষমা করেননি, যাদের প্রতি নির্দেশ ছিলো তারা যদি কা’বার গিলাফের অভ্যন্তরেও লুকিয়ে থাকে তবুও যেনো তাদের হত্যা করা হয়। এবং তাদের রক্ত মূল্যহীন ঘোষণা করা হয়েছে। [আবু দাঊদ – ৪৩৬১, সুনানে নাসাঈ -৪০৮১] কিন্তু এদের মধ্যেও শাস্তি প্রদান করা হয়েচ্ছিলো মাত্র তিনজনকে। বাকিদেরকে কোনো না কোনোভাবে আল্লাহর রাসুল ক্ষমা করে দিয়েছেন। আজকে আমরা কী দেখি? পরাজিত বাহিনীর ওপর, তাদের আত্মীয়-স্বজন, সাধারণ শিশু-বৃদ্ধ-নারীদের ওপর এবং তাদের জনপদের ওপর-ও কী বীভৎস নীপিড়ন চালানো হয়। আজকে যারা নিজেদের সভ্য দাবি করে, ইসলাম এবং এর বিধানকে সেকেলে দাবি করে, তারা দুনিয়ার বুকে কী ভয়ানক তাণ্ডব-ই না চালাচ্ছে। কিন্তু আল্লাহর রাসুল ﷺ কী দুধর্ষ জালিমদেরকেও এবং তাদের জনপদের অধিবাসীদেরকেও ক্ষমা ও মহানুভবতার অনুপম নিদর্শন রেখেছেন!
শুধু যে আল্লাহর রাসুল-ই যে ক্ষমার অনুপম নজরানা প্রদর্শন করেছেন তা নয়, আল্লাহ নিজেও তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করেন। ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। অথচ আজকে আমাদের কিছু মোটিভেশানাল স্পীকার মোটিভেশানের নামে মানুষকে প্রতিশোধ পরায়ণ করে তুলতেছে। আল্লাহ আমাদের সকল ভ্রান্তি আর অপতৎপরতাগুলো থেকে হেফাজত করুন। আমরা দুনিয়ায় বীজয়ী হই কিংবা পরাজিত হই; আমরা যেনো একজন মুসলিম হিসেবে সঠিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফিক দান করুন । আ-মী-ন!

~বিজয়ীর ভূমিকা~
রেদওয়ান রাওয়াহা
১২.০৯.২১

[ কপি করার অনুমতি নেই। নিষিদ্ধ]

পঠিত : ২৯৫ বার

মন্তব্য: ০