Alapon

তাকওয়া কী? রোজা কীভাবে তাকওয়া অর্জনে সহায়তা করে?



তাকওয়া কী? রোজা কীভাবে তাকওয়া অর্জনে সহায়তা করে?
—নোমান আলী খান

এরপর আল্লাহ্‌ রোজার উদ্দেশ্যের কথা বলেন, উদ্দেশ্য হল, লাআল্লাকুম তাত্তাকুন। যেন তোমরা সবাই নিজেদেরকে রক্ষা করার চেতনা গড়ে তুলতে পারো। সাবধানতা, যত্ন, ভয়ও বলতে পারেন। কিন্তু, ভয় অর্থটা তাকওয়া শব্দের ভালো অনুবাদ নয়। তাই, আমি তাকওয়ার ধারণা ব্যাখ্যা করতে কিছু সময় ব্যয় করবো।

তাকওয়া এসেছে আরবি শব্দ 'বেকায়া وقاية' থেকে। মূল শব্দ হলো, وقى يقي وقاية আর আরবিতে وقاية অর্থ রক্ষা করা। যেমন, আমরা দুআ করি, ওয়া কিনা আজাবান নার - আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। যখন নিজেকে রক্ষা করার কথা আসে তখন বলেন, ইত্তাকা, ইয়াত্তাকি। কুরআনে এসেছে - فَكَيْفَ تَتَّقُونَ إِن كَفَرْتُمْ يَوْمًا يَجْعَلُ الْوِلْدَانَ شِيبًا - “অতএব, তোমরা কিরূপে আত্মরক্ষা করবে যদি তোমরা সেদিনকে অস্বীকার কর, যেদিন বালককে করে দিব বৃদ্ধ?” (73:17) এখানে 'তাত্তাকুন' দ্বারা আত্মরক্ষার ধারণা প্রকাশ পাচ্ছে।

যখন কেউ আত্মরক্ষা করে... যেমন, দরজা বন্ধ করে, জানালা বন্ধ করে, সিকিউরিটি এলার্ম সেট করে— যেটাই করুক, তারা এসব করে কারণ এখানে সত্যিকারের বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিরক্ষার সাথে বিপদের এই সম্পর্ক থাকার কারণেই মানুষ তাকওয়ার জন্য 'ভয়' অর্থ ব্যবহার করে। মূলত এর অর্থ হলো, ভয়ের কারণে তুমি যে পদক্ষেপ গ্রহণ করো সেটাই তাকওয়া। ভয় নিজে নয়।

এমনও হতে পারে, কেউ একজন ভয় পেলো কিন্তু বাঁচার জন্য কোনো পদক্ষেপ নিলো না। তার তাকওয়া নেই। অন্যদিকে, যে ব্যক্তি ভয়ের কারণে দরজা বন্ধ করে, খারাপ এলাকা থেকে বের হয়ে যায়, জোরে গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে যায়, যেটাই করুক না কেন— এর নাম হলো তাকওয়া। বুঝতে পারছেন? তাহলে, নিজের প্রতিরক্ষার জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া হয় তার নামই তাকওয়া। যে কোনো ধরণের সমস্যা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করার নামই হলো তাকওয়া।

তাক্বওয়া ইতিবাচক অর্থও প্রকাশ করতে পারে। শুধু বিপদ থেকে প্রতিরক্ষা নয়, যখন তুমি তোমার পিতার রাগ থেকে বাঁচতে পদক্ষেপ গ্রহন করো, মায়ের রাগ থেকে, স্বামী/স্ত্রীর রাগ থেকে। অথবা আজকের আলোচনার ক্ষেত্রে, আল্লাহ যেন অসন্তুষ্ট না হোন সেজন্য পদক্ষেপ নেওয়া। যখন আপনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন যেমন, আমি জানি আমি ঘুমিয়ে পড়তে পারি। তাই, ঘুমানোর আগেই আমি আমার বাড়ির কাজ শেষ করবো। আমি আগেভাগে করে ফেলবো। আমার এখন সময় আছে, কিন্তু কেমন যেন অলসতা ফিল করছি। আমি জানি, যদি দেরি করি শেষে আর করা হবে না। এটা আসলে তাক্বওয়া মূলক কাজ। আপনি নিজেকে নিজের দুর্বলতা থেকে রক্ষা করলেন। উপযুক্ত সাবধানতা অবলম্বন করলেন।

এজন্য কুরআনের এক জায়গায় পাবেন, সূরা বাকারায় হজ্বের প্রস্তুতি নেওয়ার কালে ... হজ্বের প্রস্তুতি নেয়ার কালে আপনার হাতে যথেষ্ট টাকা থাকতে হবে, লাগেজ ব্যাগ ইত্যাদি গোছাতে হবে। আর আগের দিনে তো অনেক লম্বা ভ্রমণ করতে হতো। তাই, আপনাকে ব্যাগ গোছানোটা ভালোভাবে নিশ্চিত করতে হবে। মরুভূমির ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করতে হত। তাই, সাপ্লাই না থাকলে তো মারা যেতে হবে। সেজন্য, আল্লাহ্‌ বলেন, وَتَزَوَّدُوا - এবং পাথেয় গ্রহণ কর। فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَىٰ - আর তাক্বওয়াই শ্রেষ্ঠ পাথেয়। (2:197) মানে, যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করো। শুধু আল্লাহর ব্যাপারে সাবধানতা নয়, এই বিস্তৃত অর্থবোধক বাক্যাংশে বলা হচ্ছে, দেখো, সবাধান থাকো। অনিরাপদ পথ দিয়ে বা ভয়ংকর এলাকা দিয়ে ভ্রমণ করো না। আগন্তুকদের সাথে কথা বলো না। নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করো। এগুলোও আসলে তাকওয়ার অর্থের মাঝে অন্তর্ভুক্ত।

এখন, কেন আমি আপনাদের এসব বলছি? আল্লাহ্‌ অসাধারণ একটি কাজ করেছেন। সমগ্র কুরআনে তাকওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রায় ২০০ বারের বেশি। এটি কুরআনের বহুল উল্লেখিত বিষয়বস্তুর একটি, যদি সর্বাধিকবার উল্লেখিত বিষয়বস্তু না হয়ে থাকে।

আর আপনারা ঘুমিয়ে পড়ার আগে অগণিত খুৎবা শুনে থাকবেন তাকওয়া নিয়ে। "প্রিয় ভাই এবং বোনেরা, আজ আমি তাকওয়া নিয়ে কথা বলবো।" আপনি আস্তে করে ঘুমিয়ে পড়েন। এই রকম অভিজ্ঞতা আপনার বহুবার হয়েছে।

সবাই বলে আপনার তাকওয়া থাকতে হবে, আপনার তাকওয়া থাকতে হবে, আপনার তাকওয়া থাকতে হবে। কিন্তু, নামাজের পরে তো আর এটা বিক্রি হচ্ছে না, মসজিদের বাহিরে। আমি জানি না কোথা থেকে এটা অর্জন করবো। এটা একটা ধারণা, আমি কীভাবে এই ধারণা নিজের মাঝে বাস্তবায়ন করবো। আমি শুনেছি এটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আমার এটা থাকতে হবে। এটা একটা বিমূর্ত বিষয়।

আমাদের ধর্মের সুন্দরতম একটি দিক হলো, এমন বিমূর্ত ধারণাগুলোকে নিয়ে আল্লাহ্‌ তাঁর নিজের বইতে প্র্যাকটিক্যাল কিছু উপায় বলে দিবেন যে, কীভাবে আমরা নিজেদের মাঝে এগুলোর বাস্তব প্রয়োগ ঘটাবো। তাই, এটা শুধু একটা দার্শনিক ধারণা হিসেবে আপনার মাথায় ঘুরতে থাকে না। 'কিছু একটার নাম তাকওয়া। আমার মনে হয় অনেক মানুষের এটা আছে, কিন্তু আমার নেই।' না। আল্লাহ্‌ আসলে আপনাকে ট্রেইনিং অনুশীলন দিবেন। যার বাস্তবায়ন করে আপনি নিজেও তাকওয়া অর্জন করতে পারেন। এইরকম উপায়গুলোর

অন্যতম শক্তিশালী একটি হলো, সিয়াম সাধনা। আশা করা যায়, রোজা আপনাকে তাকওয়া দিবে। যদি রোজা রাখলেই তাকওয়ার গ্যারান্টি পাওয়া যেতো তাহলে আয়াতটি এভাবে আসতো, কুতিবা আলাইকুমুস সিয়াম, কামা কুতিবা আলাল লাজিনা মিন কাব্লিকুম লি তাত্তাকু। লামটি হতো লামে তা'লিল। লি তাত্তাকুর অর্থ হতো, যেন তোমরা তাকওয়া পেতে পারো। আর যখন লাআল্লাকুম বলেন, তখন পাওয়ার একটি আশা আছে, কিন্তু কোনো গ্যারান্টি নেই। কোনো গ্যারান্টি নেই।

তো, আল্লাহ্‌ বলছেন তাকওয়া অর্জন করার এটা হলো উপায়, কিন্তু শুধু যদি তুমি ঠিকভাবে সম্পন্ন করো। এমন নয় যে, যেই রোজা রাখবে সেই তাকওয়া পাবে। চলুন, এই ধারণাটি একটু অনুসন্ধান করে দেখি যে, রোজা কীভাবে একজনকে তাকওয়ার দিকে পরিচালিত করে। আল্লাহ্‌ সম্পর্কে সাবধান থাকা, সংরক্ষণশীল থাকা এবং তাঁর অসন্তোষ থেকে নিরাপদ থাকা। খুব সহজে বলছি। আমি জটিল কোনো আলোচনা তুলে ধরব না। আজকে পাণ্ডিত্যপূর্ণ হওয়া আমার লক্ষ্য নয়, একজন শিক্ষক হিসেবে আমি আলোচনাটি উপস্থাপন করবো। গবেষকের মত করে নয়। তাই, বিভিন্ন উৎস থেকে বিভিন্ন গবেষকের গবেষণা আমি উপস্থাপন করতে যাবো না। সেই অধ্যয়ন ইতোমধ্যে আমি করেছি। আমার দায়িত্ব হলো সেই কথাগুলো যত সহজে সম্ভব আপনাদের সামনে তুলে ধরা। ইনশাআল্লাহ্‌। চলুন, এ সম্পর্কে কথা বলি।

যখন রোজা রাখছেন, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে গরম কোনো জায়গায় যেমন টেক্সাসে বা আরবের কোথাও, বা পাকিস্তানে, দক্ষিণ আফ্রিকায়... রোজা রাখলে পানির তৃষ্ণা লাগবেই। আপনি খুব ধার্মিক ব্যক্তি হোন বা না হোন, তরুণ হোন বা বৃদ্ধ হোন, এটা কোনো বৈষম্য তৈরি করে না। তৃষ্ণা এসবের কোনো পরোয়া করে না। ক্ষুধা কোনো পক্ষপাতমূলক আচরণ করে না। আপনি ক্ষুধা অনুভব করবেন-ই।

ভেতরের এই অনুভূতিগুলো এবং আপনার শরীর মূলত আপনাকে আল্লাহর অবাধ্য হতে বলছে। তাই নয়কি? প্রতিটি সেকেন্ডের পিপাসা যে অনুভব করছেন, আপনার শরীর মূলত চিৎকার করে বলছে, আমাকে পানি দাও। আপনার পাকস্থলী প্রায় নিজের একটি করুণ গান নিয়ে আপনার কাছে কাকুতি-মিনতি করছে। "আমাকে খাবার দাও। "আমাকে খাবার দাও।" শরীরের ভেতর একটি যুদ্ধ চলছে যেন। আপনার শরীর আপনাকে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে বলছে। তখন, অন্তরের কিছু একটা আপনার পাকস্থলীকে এবং গলাকে বলছে, "চুপ থাকো; মাগরিবের আগে নয়। মাগরিবের আগে নয়।" সারা দিন ধরে আপনি আপনার নিজের সাথে যুদ্ধ করছেন। নিজের সাথে, গোটা দিন।

নতুন বিবাহ করেছে এমন এক দম্পতি। সে নিজের স্ত্রীর জন্য পাগল। তার দিকে তাকিয়েই...কি করবো এখন। "মাগরিবের আগে নয়। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবো। কারণ, আমি রোজা রেখেছি।"

সবচেয়ে শক্তিশালী কামনা সহবাস, এবং সবচেয়ে মৌলিক প্রয়োজন ক্ষুধা ও তৃষ্ণা আল্লাহ্‌ সারা দিনের জন্য বন্ধ করে দিলেন। যদি আমি আর আপনি রোজা রেখে থাকি, তাহলে আমরা নিজেদের মৌলিক চাহিদা এবং শরীরের সবচেয়ে শক্তিশালী কামনাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিচ্ছি সারা দিন ধরে, শুধু আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য। শুধু আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য।

দশ বার বছরের কোনো বাচ্চা প্রথমবারের মত রোজা রাখছে। সে নরম নরম মজাদার কিছু চকোলেটের দিকে তাকিয়ে আছে, হাত দিয়ে একটুখানি নিলো, কিন্তু মুখে নেওয়ার আগে থেমে গেলো, আল্লাহর কথা মনে করে আবার রেখে দিল। এমনকি তারও তাকওয়া আছে।

প্রতিবার এমনটি করার মাধ্যমে আপনি আল্লাহ্‌ সম্পর্কে সতর্ক থাকার অনুভূতির বিকাশ সাধন করলেন। এই অনুশীলন কেন গুরুত্বপূর্ণ? যদি সারাদিন ধরে আপনার মৌলিক চাহিদা এবং সবচেয়ে শক্তিশালী কামনাকে আটকে দিতে পারেন, যদি এটা করতে সমর্থ হোন, তাহলে রামাদানের বাহিরে আল্লাহ্‌ আপনার কাছে এর থেকে অনেক কম আশা করেন। রামাদানের বাহিরে তিনি আসলে চান, وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْخَبَائِثَ - তিনি তাদের জন্য শুধু নোংরা জিনিসগুলো নিষিদ্ধ করেন। (৭:১৫৭)

এই ট্রেনিং ঠিকমত গ্রহণ করলে আপনি খুব সহজেই আল্লাহর অন্যান্য আদেশ-নিষেধ গুলো পালন করতে পারবেন। তিনি আপনাকে ট্রেনিং দিচ্ছেন। ব্যাপারটা দারুণ সুন্দর।

ব্যাপারটা আমি এভাবে ব্যাখ্যা করি। যে কোনো পরিশ্রমসাধ্য কাজের জন্য... মিলিটারি ট্রেনিং বা পুলিশের ট্রেনিং এ ধরণের ট্রেনিংগুলোতে একজনকে প্রচুর পরিমাণে কঠিন কঠিন অনুশীলন করতে হয়। তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রেনিং নিতে হয়। পরে একসময়, সেই একই ব্যক্তি সহজ কোনো জিমে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। তাদের দৈনিক ব্যায়ামের রুটিন আছে। সে তখন বলে, "এটা তো কোনো ব্যাপারই না। আমরা এরচেয়ে দশগুণ বেশি ব্যায়াম করতাম।" তাই, সে যখন বহুগুণে শক্তিশালী কোনো ট্রেনিং শেষ করে আসে, তখন এরচেয়ে ছোটখাটো যেকোনো কিছু তার কাছে এক পিস কেক খাওয়ার মত সহজ। তার কোনো কষ্টই হয় না। সিয়াম সাধনার ব্যাপারটাও এরকম।

ট্রেনিংটা এতোই কঠিন যে এরপর আল্লাহ্‌ আপনাকে যা করতে বলবেন তা তো এক পিস কেক খাওয়ার মতই সহজ। আপনি এরজন্য পুরোপুরি প্রস্তুত। পুরো মাস জুড়ে আপনি আল্লাহ্‌ সম্পর্কে সতর্ক থাকা শিখবেন এবং পরবর্তীতে নিজেকে ভালোভাবে রক্ষা করতে সক্ষম হবেন আল্লাহর যে কোনো ধরণের অবাধ্যতা থেকে।

পঠিত : ৪৪৮ বার

মন্তব্য: ০