Alapon

তাহাদের নাস্তিকানুভূতি

ঘটনা-০১


ভদ্রলোকের নাম রিচার্ড মিল্টন। পড়েছেন ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে, পেশায় সাংবাদিক। বিজ্ঞান সাময়িকী, বিজ্ঞান পত্রিকা সহ বিজ্ঞান রিলেটেড নানান কিছুতে রয়েছে তাঁর বিচরন।
আমাদের দেশের প্রফেসররা যেমন আমাদের তরুণদের সবসময় 'বিজ্ঞানমুখী', 'বিজ্ঞানমনস্ক' হবার জন্য বলে থাকেন, রিচার্ড মিল্টনও সেরকম একজন বিজ্ঞানমুখী, বিজ্ঞান বান্ধব এবং বিজ্ঞানমনস্ক লোক। বিজ্ঞান নিয়ে লেখা উনার বেশকিছু বইপত্রও আছে।


রিচার্ড মিল্টন নামের এই লোক একজন বিশুদ্ধ নাস্তিক। ধর্মকর্ম, স্রষ্টা কোনকিছুতেই উনি বিশ্বাস করেন না। কিন্তু, বিপত্তি এক জায়গায়।
বিপত্তির জায়গাটা খোলাসা করি।
উনি একজন স্রষ্টা অবিশ্বাসী বিজ্ঞানমনস্ক সাদা চামড়ার ইংরেজ হলেও, ডারউইনের বিবর্তনবাদে উনি মোটেও বিশ্বাস করেন না। বিজ্ঞান জগতে 'পিওর সাইন্স' এর কথা বলে বিবর্তনবাদের নামে যে রূপকথা আমজনতাকে গেলানো হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে রিচার্ড মিল্টন আওয়াজ তুলেন। বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিভিন্ন আর্টিকেল লিখতে থাকেন।


কিন্তু, সমস্যা হয়েছে আরেক জায়গায়। রিচার্ড মিল্টনের এই কাজে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন তারই আরেক স্বগোত্রীয় রিচার্ড ডকিন্স। রিচার্ড ডকিন্সকে সবাই চিনে। বর্তমান নাস্তিকদের কাছে এককথায় 'দেবতাতুল্য' অক্সফোর্ডের জিওলোজির এই প্রফেসর।


রিচার্ড মিল্টন উনার বই 'The Facts of Life: Shattering the myths of Darwinism' এ নাস্তিকদের সবচেয়ে বড় ধর্মগুরু, রিচার্ড ডকিন্স সম্পর্কে কিছু কথা লিখেছেন।
উনি বইটির ২৬৮ পৃষ্টায় লিখেন- “I experienced this kind of witch-hunting activity by the Darwinist police when I first published Shattering the Myths of Darwinism and found myself subjected to a campaign of vilification…it was disappointing to find myself being described by a prominent academic, Oxford zoologist Richard Dawkins, as ‘loony,’ ‘stupid,’ and ‘in need of psychiatric help,’ in response to purely scientific reporting.”


মিল্টন বলেছেন- 'আমার সাইন্টিফিক লেখার বিপরীতে রিচার্ড ডকিন্সের মতো অক্সফোর্ডের প্রফেসর যখন আমাকে 'মূর্খ' 'উন্মাদ' আর 'মানসিক চিকিৎসা দরকার' বলে ভৎসর্না করে, তখন ব্যাপারটা খুবই হতাশাজনক।'


হতাশাজনক হবারই কথা। 'বিবর্তনবাদ' নামের বিলিয়ন বিলিয়ন বছরের সেই রূপকথার গল্পে যারা চোখমুখ বন্ধ করে ঈমান এনে ফেলেছে, তাদের কাছে এর বিপরীত সবকিছুকেই মূর্খামি বলে মনে হবে।


মিল্টন আরো লিখেছেন- “(B)ehind my back, Dawkins was writing letters to newspaper editors alleging that I am a secret creationist and hence not to be believed…Dawkins contacted the editor [of Times Higher Educational Supplement], Auriol Stevens , falsely alleged that I am a secret creationist, and covertly lobbied against publication of my article, although he had not seen it… the editor of the paper gave in to this bullying and suppressed my article .”


মিল্টন লিখেন, 'আমার অজান্তে, রিচার্ড ডকিন্স পত্রিকার এডিটরদের কাছে চিঠি লিখে বলেছিলো, আমি নাকি একজন সিক্রেট ক্রিয়েশনিষ্ট (যারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করে) এবং আমাকে যেন বিশ্বাস না করা হয়। ডকিন্স 'Times Higher Educational Supplement' এর এডিটর Auriol Stevens এর সাথে যোগাযোগ করে এবং আমার পেপারটি যেন প্রকাশ না করে তার জন্য তাকে বাধ্য করে, যদিও আমার পেপারটি ডকিন্স তখনও দেখেওনি (অর্থাৎ, মিল্টন কি লিখেছেন, তা বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে কতোটুকু গ্রহণযোগ্য, তা যাচাই না করেই ডকিন্স উনার বিরুদ্ধ্যে অপপ্রচারে নামেন।)'


একই বইতে তিনি আরো লিখেছেন- “I found this kind of bullying, bad faith, and intellectual dishonesty in prominent academics both depressing and a little disturbing. It is like lifting a corner of the veil of civilized behavior and finding something like intellectual fascism hiding underneath…(T)here is little sign of it on the surface unless, like me, you begin to ask controversial questions…”
“For anyone, anywhere, to say that I am a creationist, a secret creationist, a ‘creationist ally,’ or any other such weasel-word formulation, is an act of intellectual dishonesty by those who have no other answer to the scientific objections I have raised publicly ”


মিল্টন বলেছেন, 'আমাকে (খুব কাছ থেকে দেখা আর জানার পরেও, আমার কাজ, বিশ্বাস সম্পর্কে জেনেও) একজন 'সিক্রেট ক্রিয়েশনিষ্ট' বলাটা চরম বুদ্ধিবৃত্তিক অসততার পরিচয়। আমাকে এসব তারাই বলছে যাদের কাছে আমার উত্থাপিত অভিযোগের (বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে) বিরুদ্ধে কোন জবাব নেই।'


ঘটনা-০২


Günter Bechly একজন জার্মান Paleontologist. প্রাণীদের ফসিল নিয়ে কাজ করেন এমন বিজ্ঞানীদের অন্যতম এই ভদ্রলোক। কাজ করতেন জার্মানীর স্টুটগার্টের State Museum of Natural History তে। উনার বিভিন্ন গবেষণাপত্র ছাপা হয়েছে বিভিন্ন নামকরা পিয়ার রিভিউ জার্নালে। সম্প্রতি উনি যখন বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে উনার অবস্থান পরিষ্কার করেন, ঠিক তখনি উনাকে State Museum of Natural History থেকে বরখাস্ত করা হয়।
শুধু কী তাই? মুছে দেওয়া হয়েছে নামকরা এই বিজ্ঞানীর ইংরেজি উইকিপিডিয়া পেইজও।


ঘটনা-০৩


Antony Flew । উনাকে বলা হতো নাস্তিকদের 'Spiritual Leader' । জীবনের তিনভাগের আড়াই ভাগ সময় উনি ব্যয় করেছেন নাস্তিকতার প্রচার-প্রসারে। খ্রিষ্ঠান পন্ডিতদের সাথে করেছেন প্রচুর বিতর্ক। নাস্তিকতার পক্ষে লিখেছেন ডজন খানেক বই। নাস্তিকতার পক্ষে যেসব দার্শনিক যুক্তি এখন অবধি টানা হয়, তার অধিকাংশই Antony Flew এর বই থেকেই। কিন্তু, ২০০৪ সালে এই বিখ্যাত নাস্তিক একেবারে ঘোষণা দিয়ে আস্তিক (Believer in a super intelligence) হয়ে যান। ২০০৭ সালে উনি স্রষ্টার অস্তিত্বের উপর একটি বই লিখেন। বইটির নাম- 'There is a God: How the world's most notorious atheists changed his mind'।
২০০৭ সালে উনার বয়স হয় ৮৪ বছর। শারীরিক অক্ষমতার জন্য তিনি লিখতে পারছিলেন না। তাই, Roy Abraham Vargese নামের উনার এক সহযোগী উনাকে বইটি লিখতে সাহায্য করেন।
কিন্তু, রাতারাতি এতোবড় একজন নাস্তিক আস্তিক হয়ে যাওয়াটা নাস্তিকতা ধর্মের জন্য রীতিমতো লজ্জা এবং অপমানজনক। কিন্তু, পাবলিককে কিছু একটা বলে বোঝাতে হবে, তাই না?
তাই, রিচার্ড ডকিন্স এবং উনার গ্যাং বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লেন Antony Flew এর বিরুদ্ধে। ডকিন্স উনার 'The God Delusion' বইতে Flew কে খোঁচা মেরে বলেন,- “We might be seeing something similar today in the over-publicized tergiversations of the philosopher Antony Flew, who announced in his old age that he had been converted to belief in some sort of deity, triggering a frenzy of eager repetition around the Internet.”


বৃদ্ধ বয়সে ভীমরতি ধরেছে উল্লেখ করে উনাকে নিউ ইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনও এ্যাটাক করে। বলেছিলো বইয়ের কথাগুলো Flew'র নয়, Roy Abraham Vergese এর।
এরকম মিথ্যাচারের জবাবে এক ইন্টার্ভিউতে Antony Flew বলেন,- “My name is on the book and it represents exactly my opinions. I would not have a book issued in my name that I do not 100 per cent agree with. I needed someone to do the actual writing because I’m 84 and that was Roy Varghese’s role. The idea that someone manipulated me because I’m old is exactly wrong. I may be old but it is hard to manipulate me. That is my book and it represents my thinking.”


ঘটনা-০৪


Elsevier নামক একটি প্রতিষ্ঠান থেকে 'The International Journal Of Cardiology' নামে বিশ্ববিখ্যাত একটি মেডিকেল জার্নাল বের হয়।
২০০৯ সালে সেই জার্নালে একটি পেপার একসেপ্টেড হয়। পেপারটির নাম - “The heart and cardiovascular system in the Qur'an and Hadeeth”।
অর্থাৎ, কোরআন এবং হাদীসে মানুষের হার্ট এবং কাডিওভার্স্কুলার সিস্টেম নিয়ে যা বলা আছে, তা যে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেটা নিয়েই এই আর্টিকেল।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এরকম একটি আর্টিকেল এতো বিখ্যাত জায়গায় পাবলিশ হবে, এটা যেন কোনমতেই মেনে নিতে পারছিলো না বাঙলার মুক্তমনা সম্প্রদায়। সে সময় মুক্তমনা ব্লগের ফাউন্ডার অভিজিৎ রায় রাতারাতি আরো কিছু ইসলাম বিদ্বেষীদের একত্র করে এই পেপার পাবলিশ না করার জন্য ক্যাম্পেইন শুরু করে।
এই জার্নালের এডিটর বরাবর অভিজিৎ রায় একটি এপ্লিকেশনও পাঠিয়েছিলে।
কিন্তু, বাঙলার তাবৎ মুক্তমনাদের চোখের জল আর নাকের জলে ভাসিয়ে “The heart and cardiovascular system in the Qur'an and Hadeeth” নামের সেই আর্টিকেলটি ২০১০ সালে পাবলিশ হয়।


ঘটনা-০৫


সাইফুর রহমান। আমার বন্ধুমানুষ। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে মলিকিউলার বায়োলজি বিষয়ে পিএইচডি করছেন। কিন্তু উনি ডারউইনবাদে বিশ্বাসী না। মাঝে মধ্যে ডারউইনিজমের রূপকথা তত্ত্ব নিয়ে দু-চার কথা বলে থাকেন।
কিন্তু হয়েছে কি, কিছুদিন আগে বাংলাদেশের একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মুক্তমনা প্রফেসর সাইফুর ভাইয়ের ডিপার্টমেন্ট বরাবর মেইল পাঠিয়েছে। মেইলে লিখেছে- 'বিবর্তনবাদে বিশ্বাস না করেও এই লোক ক্যামব্রিজে কীভাবে বায়োলজিতে পড়ে?'
দেখুন, এসব মুক্তমনারা নিজেদের 'বিবর্তনবাদ' ধর্ম নিয়ে কতোটা কনসার্ন।


কনক্লুশানঃ


অন্যান্য ধর্মের মতোই 'নাস্তিকতা'ও একটি ধর্ম। অন্যান্য ধর্মের ধর্মানুভূতির মতো এদেরও রয়েছে নাস্তিকানুভূতি। এই নাস্তিকানুভূতিতে আঘাত আসলে কখনো এরা পত্রিকার এডিটরের বরাবর জোর খাটিয়ে অন্যের পেপার আটকিয়ে দেয়, কখনো কাউকে চাকরিচ্যুত করে, কাউকে 'বয়সের ভারে ভীমরতি' বলে কটাক্ষ করে, জার্নালের এডিটর বরাবর আবেদন করে কারো পেপার আটকিয়ে দিতে চায়, কারো বা প্রতিষ্ঠান বরাবর নালিশ করে। এই 'নাস্তিকতা' ধর্মেরও প্রচারক রয়েছে।এসব প্রচারকদের এরা চোখমুখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে। দিনশেষে এরাও প্রতিক্রিয়াশীল।

পঠিত : ৫২১ বার

মন্তব্য: ০