Alapon

বদর যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে অনেক মুশরিকরা বন্দী হয়



বদর যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে অনেক মুশরিকরা বন্দী হয় সেই বন্দী মুশরিকদের মুসলমানরা অতি সামান্য মুক্তিপণের বিনিময়ে মুক্ত করে দিতে চাইলে মুশরিকদের কাছে সেই সামান্য মুক্তিপণটাও 'বি-শা-ল' হয়ে দাঁড়ালো! সেটা দিতে তাদের যেন রাজ্যের অনীহা।

তাদের সেই অনীহাকে ভৎসর্নার বদলে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা মূল্যায়ন করলেন। যেহেতু ইতোপূর্বে মুসলমানদের তারা নিদারুন কষ্ট দিয়েছে, তাদের জান-মালের ক্ষতি সাধন করেছে এবং সর্বোপরি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও নিপতিত হয়েছে, সুতরাং ধরাশায়ী হওয়ার পর মুসলমানদের পূর্ণ স্বাধীণতা আছে তাদেরকে যা ইচ্ছে করবার। মুসলমানরা চাইলে তাদের প্রত্যেককে হত্যা করতে পারে নতুবা বন্দী করে রাখতে পারে আজীবনের জন্যে। মুশরিকদের কোন সুযোগ নেই এতে আপত্তি জানায়।

কিন্তু, 'বসতে দিলে শু'তে চাওয়া' বলে যে প্রবাদ প্রচলিত আছে, তা বোধকরি মক্কার মুশরিকদের মজ্জাগত ছিলো। মুক্তিপণের বিনিময়ে তারা মুক্তি পাবে সেটা তাদের কাছে বড় নয়, তাদের কাছে বড় হয়ে ধরা দিলো মুক্তিপণের সামান্য টাকাটাই। তারা মোচড়ামুচড়ি শুরু করলো ব্যাপারটা নিয়ে।

এই জায়গায় একজন ক্ষমতাবান রাজাকে কল্পনা করা যাক। ধরা যাক যে— অন্য এক রাজ্যের সাথে লড়াই করে তিনি বিজয়ী হলেন এবং তার হাতে জমা হলো অসংখ্য যুদ্ধবন্দী। সেই যুদ্ধবন্দীদের প্রাণে না মেরে তিনি মুক্ত করে দিতে চান তবে তা একেবারে বিনামূল্যে নয়। সামান্য মুক্তিপণের বিনিময়ে।

তাদের ভাগ্যে হয়তো 'মৃত্যু' লেখা থাকতে পারতো, কিন্তু রাজার মহিমায় তারা জানে বেঁচে গেলো এ-যাত্রায়। এমন মহান এক রাজার মহানুভবতার সামনে তাদের তো নত-মস্তকে কুর্নিশ করার কথা, তাই না? ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও শত্রুর গলায় তিনি তলোয়ার না উঠিয়ে খুলে দিতে যাচ্ছেন তাদের দেহের বাঁধন। এমন উপকারের কথা এক-জনমে ভুলা যায়?

কিন্তু, এই দয়া আর মহানুভবতার কথা বিস্মৃত হয়ে, তারা যদি সেই রাজাকে উল্টো প্রশ্ন করে বসে কেনো তাদের মুক্তিপণ দিতে হবে, কিংবা রাজার আদেশ পালনে তারা যদি গড়িমসি করে, তখন কেমন হবে সেই রাজার মেজাজ-মর্জি?

স্বভাবতই— রাজা অসম্ভব রেগে যাবেন৷ রাগে গজগজ করতে করতে তিনি সেনাপতিকে নির্দেশ দিবেন সব ক'টাকে হয় হত্যা করতে, নতুবা কারাগারের অন্ধকার কুঠুরিতে পুরে তিলে তিলে মেরে ফেলতে। রাজা হুংকার ছেঁড়ে বলতে পারেন— 'আমার দয়াকে যখন তোমরা অধিকার মনে করেছো, তখন আমাকে দয়ার বদলে দায়িত্ব সারতে হয়। যাও, এবার কঠিন ভাগ্যকে বরণ করো'।

দুনিয়ার রাজাদের ব্যাপারে আমরা এরচেয়ে বেশিদূর আর ভাবতে পারি না।

কিন্তু, বদরের যুদ্ধের যুদ্ধবন্দীরা, যারা মুক্তিপণ দিতে কার্পণ্য করছিলো, যাদের মধ্যে মুক্তিপণ প্রদানে দেখা গিয়েছিলো রাজ্যের অনীহা, তাদের উদ্দেশ্য করে আসমান আর যমিনের বাদশাহ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা কী বলেছেন জানেন? সুরা আল-আনফালের ৭০ নম্বর আয়াতে তিনি বলেছেন,

'তোমাদের অন্তরে যদি আল্লাহ ভালো কিছু দেখতে পান, তাহলে (মুক্তিপণ হিশেবে) তোমাদের কাছ থেকে যা নেওয়া হয়েছে তার চাইতে উত্তম কিছু তিনি তোমাদের প্রদান করবেন'।

প্রথমত তারা ছিলো মুসলমানদের জন্য ভয়ঙ্কর শত্রু। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো মুসলমানদের জন-জীবন! দ্বিতীয়ত তারা সকলে যুদ্ধবন্দী। যুদ্ধবন্দী হিশেবে তাদের সাথে যেকোন ব্যবহার করার অধিকার মুসলমানদের আছে। তৃতীয়ত মুক্তিপণ আদায়ে কার্পণ্য করে তারা বস্তুত আল্লাহর সিদ্ধান্তকেই অসম্মান করছিলো।

এসবকিছু সত্ত্বেও আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা দুনিয়ার কোন রাজার মতো করে গর্জে উঠেননি। রাগে তিনি সকলকে হত্যা করার কিংবা জীবনের তরে কারাগারে পুরে রাখার নির্দেশ দেননি। বরং যা বললেন তা হলো এই— 'এইটুকু মুক্তিপণ তোমরা দাও। দিয়ে তোমাদের মুক্ত করো। এরপর আল্লাহ যদি তোমাদের অন্তরগুলোতে কোন ভালোর সন্ধান পান, যদি তোমরা সত্য আর মিথ্যের প্রভেদ বুঝতে পারো, যদি তোমরা আল্লাহর রাসুল যে সত্য নিয়ে এসেছেন তা অনুধাবনে সক্ষম হও, সত্যিকার আলোর দিকে যদি তোমাদের অন্তরগুলো ঝুঁকে, তাহলে আল্লাহ তোমাদের সাথে ওয়াদা করছেন— তোমাদের কাছ থেকে আজ যা আদায় করা হচ্ছে, তারচেয়ে অনেকগুণ উত্তম কিছু তিনি তোমাদের প্রদান করবেন'।

আচ্ছা, এমন দয়া, এমন মহানুভবতার দৃষ্টান্ত ইসলাম ছাড়া মানুষ আর কোথায় পাবে বলুন তো?

তবে, ব্যক্তিগতভাবে এই আয়াত আমাকে একটু অন্যভাবে ভাবালো। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা মুশরিকদের সাথে ওয়াদা করছেন যে— যদি তাদের অন্তরে ভালো কিছু তিনি খুঁজে পান, তিনি তাদের এমন বিনিময় প্রদান করবেন যা তাদের কাছ থেকে আদায় করা বস্তুর চাইতে উত্তম।

আচ্ছা, এই আয়াতটা কি আমাদের বেলাতেও খাটে না? আমাদের অন্তরেও যদি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা ভালো কিছু দেখতে পান, তবে কি তিনি আমাদের এমন উত্তম বস্তু দিবেন না যা আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া বস্তু থেকে উত্তম?

যাদের জীবন থেকে কোন বন্ধু হারিয়ে গেছে, যাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে কোন জীবনসঙ্গী বা পরম আত্মীয়, যারা হারিয়ে ফেলেছে তাদের বাবা-মা'কে, কোলের মানিক সন্তানকে। কিন্তু তারা ধৈর্য হারায়নি, বিচলিত হয়নি...

অথবা, রিযিক তালাশে যারা পার করছে কঠিন সময়, যাদের ব্যবসাতে মন্দা, সংসারে অস্বছলতা, যাদের সামনে চাকরির দুষ্প্রাপ্যতা। কিন্তু তবুও তাদের হৃদয় ভর্তি তাওয়াক্কুল...

কিংবা,

যৌবনের উন্মত্ততা সত্ত্বেও যারা বেপরোয়া নয়, যারা ফিতনার কঠিন সময়েও নিজের চরিত্রকে হেফাযতের জন্য নিরন্তর লড়াই করে যাচ্ছে, সমাজের, পাড়া-প্রতিবেশীর, পরিবারের হাজারো কটুকথা, নিন্দাকে গায়ে না মেখে যারা যারা নিজেদের আবৃত করে রাখছে পর্দায়, সকলের তিরস্কার উপেক্ষা করে যারা মুখে রেখে দিচ্ছে দাঁড়ি...

এই যে অন্তরের এই সমস্ত 'ভালো'-কে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা কি মূল্যায়ন করবেন না? অবশ্যই করবেন৷ এসবের পেছনে আমাদের যে ত্যাগ আর সংগ্রাম, একদিন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া'তায়ালা এসবের বিনিময়ে আমাদের অতি-অবশ্যই উত্তম প্রতিদান প্রদান করবেন।

বিনিময় প্রদানের বেলায় আল্লাহর চাইতে উদার আর কে আছে জগতে? কেবল, অন্তরের আলোটাকে জ্বালিয়ে রাখতে হবে। শত ঝড়-ঝঞ্চাট, বাঁধা-বিপত্তিতে কোনোভাবেই সে আলোটাকে নিভতে দেওয়া যাবে না।

~Arif Azad

পঠিত : ২৭০ বার

মন্তব্য: ০