Alapon

কিসে তোমাকে বিভ্রান্ত করলো?



কিসে তোমাকে বিভ্রান্ত করলো?

یٰۤاَیُّهَا الۡاِنۡسَانُ مَا غَرَّکَ بِرَبِّکَ الۡکَرِیۡمِ - "হে মানুষ!! কিসে তোমাকে তোমার মহামহিম পালনকর্তা সম্পর্কে বিভ্রান্ত করলো?" (সূরা ইনফিতার, সূরা নং ৮২, আয়াত নং ০৬ )

প্রসঙ্গতঃ 'ইনসান' দুটি জিনিসের সমন্বয়ে গঠিত। আল্লাহ্‌ যখন আমাদের মানুষ বলে সম্বোধন করেন। "হে মানুষ!!" এর দ্বারা বুঝায়— যে প্রচুর পরিমাণে ভুলে যায়। 'নিসইয়ান' থেকে আগত। "ওই ভুলো-মনা সৃষ্টি!!" "ওই ভুলো-মনা সৃষ্টি!!" এভাবেই আল্লাহ্‌ আমাদের সম্বোধন করছেন।

শব্দটি নিয়ে অন্যভাবেও চিন্তা করা যায়। "উন্স" থেকে এটি আগত। যার মানে ভালোবাসা এবং দরদ। তোমরা ভালোবাসায় পূর্ণ এক সৃষ্টি। তোমরা ভালোবাসা পেতে চাও। বিড়াল আলিঙ্গনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। কিন্তু, শিশুরা চায় তাদেরকে কেউ ভালোবাসায় জড়িয়ে ধরুক। এমনকি বড়রাও চায়। তারা চায় সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হতে, তারা চায় মানুষ তাদের ভালবাসুক, গ্রহণ করে নিক। আবার তারা ভালোবাসা দিতেও চায়। মানুষের মাঝে এই ব্যাপারগুলো লক্ষ্য করা যায়। অন্য সৃষ্টির মাঝে সাধারণত এগুলো দেখা যায় না। ঠিক এই কারণেও আমরা ইনসান।

আল্লাহ এই উভয় বৈশিষ্ট্যসহ আমাদেরকে ডাক দিচ্ছেন, যখন তিনি আমাদের প্রতিটি মানুষকে লক্ষ্য করে কথা বলছেন। প্রসঙ্গত, এই আয়াতের আহবান "ইয়া আইয়ুহাল ইনসান- মানুষ!!" যখন আমরা এই আহবান শুনি, আমি তখন অন্য কারো কথা ভাবি না। আমি আগের দিনের কোনো জাতি নিয়ে ভাবছি না বা অবিশ্বাসীদের নিয়েও ভাবছি না। আল্লাহ বলেননি, ইয়া আইয়ুহাল কাফের। তিনি বলেছেন, ইয়া আইয়ুহাল ইনসান। তিনি আপনাকে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন।

তিনি এমনকি বলেননি সেইদিন আল্লাহ বলবেন। শুধু এই শব্দগুলো সেদিন বলা হবে। তাই, আমরা জানি না কে এখানে কথা বলছে। এখানে 'কায়েল' কে? এ সম্পর্কে একভাবে চিন্তা করা যায়- এখানে আল্লাহ নিজেই বক্তা। আল্লাহ নিজে এই কথাগুলো আমাদের বলছেন। এ নিয়ে অন্যভাবেও চিন্তা করা যায়। ব্যাপারটা এরকম- যখন বিচার দিবস আসবে তখন উপলব্ধি করবেন কোন কোন ব্যাপারগুলোকে আপনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন অথচ কোন কোন ব্যাপারগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। কোনটা আপনার সামনে ছিল আর কোনটাকে পেছনে ফেলে রেখেছিলেন।

কেমন করে যেন খুব সহজেই আপনার রবের কথা ভুলে যেতেন। খুব সহজেই আপনার প্রভুকে পরিত্যাগ করতেন। তখন নিজেই নিজেকে দোষ দিয়ে বলবেন- কেমন ভুলোমনা সৃষ্টি তুমি!! মা- গাররাকা বিরাব্বিকাল কারিম। 'মা' এখানে প্রশ্নবোধক শব্দ। কোন জিনিসটা তোমাকে প্রতারিত করল!! কোন ব্যাপারটা তোমাকে মিথ্যা আশা দিয়েছিল, যখন তোমার সুমহান দাতা রবের কথা আসতো। বি রাব্বিকাল কারিম।

এই প্রশ্নটি কুরআনের অন্যতম অন্তরবিদ্ধকারী প্রশ্ন, হৃদয় ছিদ্র করা প্রশ্ন। "ইয়া আইয়ুহাল ইনসান মা গাররাকা বি রাব্বিকাল কারিম??" যদি কুরআনের বেশি কিছু আপনার মুখস্ত না থাকে বা না জেনে থাকেন, কিন্তু বাসায় ফ্রিজের গায়ে কুরআন থেকে কিছু একটা লিখে রাখতে চান এবং প্রতিদিন নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিতে চান- তবে, এই আয়াতটি লিখে রাখুন। "ইয়া আইয়ুহাল ইনসান মা গাররাকা বি রাব্বিকাল কারিম??"

চলুন, এই শব্দগুলো দ্বারা কী বোঝানো হচ্ছে তা আরও ভালভাবে জানার চেষ্টা করি। আরবি 'গাররা' শব্দের আমি অনুবাদ করেছি প্রতারিত। ইবনে আসুর (র) তাঁর তাফসীরে উল্লেখ করেছেন, (আরবি) তিনি বলেন, কোনো ব্যক্তি যখন তার চিন্তা এবং আশা এমন কিছুর উপর অর্পণ করে যার দ্বারা সে প্রতারিত হয়। সে মনে করেছিল এটা তার উপকারে আসবে। এর কারণে তার ভাল লাগবে, এর কারণে ভবিষ্যতে সে ভাল থাকবে, এর কারণে সে আরও বেশি নিরাপত্তা লাভ করবে, এর কারণে সে আরও সুখী হবে, এর কারণে সে শান্তি পাবে— বস্তুত এগুলো সবই ছিল ভুল ধারণা। এটা মূলত তার ক্ষতি করবে। সে মনে মনে একেবারে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, এটা সবধরনের উপকার নিয়ে আসবে। কিন্তু আসলে এটা ক্ষতিকর। এর নাম হলো 'গুরুর'।
এই শব্দ আমাদের কী শেখাচ্ছে? জীবনে এমন অনেক কিছু সামনে এসে পড়বে যা খুবই আকর্ষণীয় মনে হবে। যা আমরা চাই। আমাদের অন্তর যার দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু, আমাদের অন্তর আমাদেরকে মিথ্যা বলছে।
অন্তরে তথ্য থাকে না, অন্তরে থাকে অনুভূতি। এর কাছে বাস্তবতার কোনো ধারণা নেই। এটা শুধুই 'ওহাম' বা বিভ্রম। তাই আমাদের অন্তরকে পথ দেখানোর দরকার হয়। কারণ, আমাদের অন্তর অন্ধ। এটা কিছু দেখলেই তার দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। অন্য আরও কিছু দেখলে তার দিকেও আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। এর মাঝে চাহিদা আছে আর সে তা পূরণ করতে চায়।

কিন্তু, আল্লাহ তাঁর বাণীর মাধ্যমে অন্তরকে পথ দেখানোর উপায় বলে দিয়েছেন। এটা অন্তরকে ভাল-মন্দ দেখিয়ে দেয়। এটা অন্তরকে চিন্তা করতে শেখায়। আপনার অনুভূতিগুলোর কোনো দোষ নেই, কিন্তু যে দিকে এদের চালাচ্ছেন তা হয়ত ঠিক নেই। আমাদের অনুভূতিগুলো আল্লাহ প্রদত্ত। আপনি যা যা কামনা করেন আপনার তা কামনা করার কথা। কিন্তু, যে পথে এই কামনাগুলো পূরণ করতে চাচ্ছেন আপনি নিজেকে প্রতারিত করছেন। মনে করছেন এতে শান্তি পাবেন।

আর আল্লাহ যেভাবে আপনাকে পথ দেখান- তিনি পরিষ্কারভাবে আপনাকে হালাল পথের কথা জানিয়ে দেন। এটা হালাল পথ। এটাই হারাম এড়িয়ে চলার পথ। আর তিনি যখন চান আমরা যেন হারাম এড়িয়ে চলি তা শুধু এই কারণে যে, আমরা নিজেদেরকেই কষ্ট দিবো যদি আমরা হারাম পথ অনুসরণ করি। অন্য কাউকে নয়। প্রথম শিকার আমি নিজেই হবো। অন্য কেউ নয়, আমি নিজে। পাপ করার কারণে সবার আগে আমিই ক্ষতির সম্মুখীন হবো।
আর শয়তান এসে কী বলে? সে বলে- তুমি নিজের প্রতি এত কঠোর কেন? এত হুজুর কেন তুমি? এত ইসলামিক কেন তুমি? তোমাকে এমন হতে হবে কেন? আর আমি নিজেই নিজেকে বলবো কিয়ামতের দিন, ইয়া আল্লাহ! আপনি আমাকে শিখিয়েছিলেন কোনটাকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। আপনি জানিয়েছিলেন কোনটাকে পরেও করা যাবে। কিন্তু আমি আপনার কথা শুনিনি। কারণ, আমি বার বার আপনার কথা ভুলে যেতাম।
প্রথমত, আমি ভুল জিনিস দ্বারা প্রতারিত হয়েছি। দ্বিতীয়ত, আমি ভুলে গিয়েছিলাম আপনি আমার কে? 'বি রাব্বিকাল কারিম'। কোন জিনিসটা তোমাকে তোমার সুহমহান দাতা রব সম্পর্কে প্রতারিত করল? তোমার 'কারিম' রব। আরবি 'কারিম' শব্দটি খুবই সুন্দর আকর্ষণীয় এক শব্দ।

এর দ্বারা এমন সব জিনিসের বর্ণনা দেওয়া হয় যা অতীব চমৎকার, অভিজাত এবং মনোহর। তাই, যে ঘোড়ার সবচেয়ে বেশি রেশমী চুল আছে, যার গায়ের রংও সবচেয়ে সুন্দর এবং স্বাস্থ্যকর শরীর আছে, আরবীয় ঘোড়া, সত্যিকারের আরবীয় ঘোড়াকে তারা 'কারাম' বলে অভিহিত করতো। এই শব্দকে সম্বন্ধযুক্ত করা হয় গুপ্ত সম্পদের সাথে। এই শব্দকে আরো সম্বন্ধযুক্ত করা হয় স্বর্ণের নেকলেসের সাথে। যে নেকলেস খুব দামী স্বর্ণ দিয়ে তৈরি করা হয়। এটাকেও 'কারম এবং কিরম' বলা হয়। সকল সুন্দর জিনিসের সাথে এই শব্দকে সম্পর্কযুক্ত করা হয়। সকল অভিজাত জিনিসের সাথে। সকল হাই ক্লাসের জিনিসের সাথে। সকল কোয়ালিটি সম্পন্ন জিনিসের সাথে। এরপর অর্থটি আরও সম্প্রসারিত হয়ে দানশীলতার সাথে যুক্ত হতে শুরু করলো। তাই, তারা রাসূল (স) কে বর্ণনা করতো 'কারিমুন ইবনু কারিম' হিসেবে। অভিজাত বাবার অভিজাত সন্তান। অভিজাত মানে তিনি আমাদের প্রতি দানশীল হবেন। তিনি আমাদের প্রতি উদার হবেন।

আল্লাহ স্বয়ং এতোই মহান, উদার এবং দানশীল যে, আমরা তাঁকে ভুলে গেলেও তিনি আমাদের সাথে দয়ালু আচরণ করেন। আমরা অন্য কিছুকে প্রায়োরিটি বানালেও তিনি আমাদের সাথে দয়ালু আচরণ করেন। আমরা নিজেদের জীবনে তাঁর বিধি-বিধানকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলেও... আমরা এমনভাবে আচরণ করি যেন এগুলোর অস্তিত্ব নেই, আমরা এমনভাবে আচরণ করি যেন এগুলো মান্য বা অমান্য করাতে কিছু যায় আসে না, তবু এর বিনিময়ে তিনি আমাদের সাথে সাথেই অপমানিত করেন না। তবু তিনি আমাদের সাথে সম্মানজনক আচরণ করেন। তবু তিনি আমাদের মান মর্যাদা রক্ষা করেন। তবু তিনি আমাদেরকে মানবতার সামনে অপমানিত করেন না। তিনি এমনটা করেন না। তিনি মর্যাদাপূর্ণ উপায়ে আমাদের সাথে আচরণ করে যান। তিনি আমার প্রতি কারিম। তিনি সবসময় এমন ছিলেন।

আমি মোটেই তাঁর অনুগ্রহের কোনো বিনিময় প্রদান করি না। আমি এমনকি শুরুও করি না। শুধু ভুলে যাই। বার বার তাঁকে অগ্রাহ্য করি। এবং তিনি যা করতে বলেছেন সেটা অগ্রাহ্য করি। আমি দ্বিতীয়বার এটা নিয়ে আর চিন্তা করি না। আমি ধরে নিয়েছি আল্লাহ শুধু দিয়েই যাবেন। তিনি সবসময় আমার যত্ন নিয়ে আসছেন। তিনি বুঝেন। এটা কোনো ব্যাপার না।
কিন্তু শেষ বিচারের দিন আমি বলবো না, আল্লাহ বুঝেন। সেই দিন আমি কপাল চাপড়িয়ে বলতে থাকবো- কি করলাম আমি!! সব ভুল জিনিসকে প্রায়োরিটি দিয়েছি আমি। "আলিমাত নাফসুম মা কাদ্দামাত ওয়া আখখারাত।"

- নোমান আলী খান

পঠিত : ১০৬৬ বার

মন্তব্য: ০