Alapon

আব্বাস আলী খানের ২২ তম মৃত্যু বার্ষিকী, জন্ম, শিক্ষা, কর্ম ও রাজনীতি।


“নামাযের জন্য কারো পারমিশনের দরকার নেই মশাই। আমি রোজ ১ টার সময় নামাযের জন্য বেরিয়ে যাবোই। আপনি বরং লিখিত অর্ডার দিয়ে বন্ধ করে দিন। দেখবো আপনার মুরোদ খান।”
মনে পড়ে কথাটি কার? হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ মরহুম আব্বাস আলী খানের কথা।

•••• সময়টা হাজার 1935 সাল।দুর্লভ সরকারী চাকুরী। বড় সাবের হুকুম-অফিস থেকে নামাযের জন্য যাওয়া যাবে না। বসের রক্ত চক্ষু উপক্ষো করেও জামায়াতে নামায পড়তে গিয়েছেন। এক পর্যায়ে বসের কড়াকড়িতে চাকুরী ছেড়ে দেন। কিন্তু নামায ছাড়েননি। সেই মহান মুজাহিদের ২২ তম (০৩-১০-১৯৯৯)মৃত্যুবার্ষিকী আজ। একে একে বিশ্বের বুক ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এমন হাজারো সুখ-তারা, যারা দ্বীন কায়েমের জন্য জীবনের সবটা দিয়ে চেষ্টা করেছেন।

????এক নজরে জন্ম, শিক্ষা, কর্ম ও রাজনীতিঃ-

•••••জনাব আব্বাস আলী খান ১৩২১ সালের ফাল্গুন মাসের শেষ সপ্তাহে সোমবার বেলা ৯টায় জয়পুরহাটে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পূর্ব পুরুষগণ ছিলেন পাঠান এবং আফগানিস্তান থেকে আগত। তাঁর দাদা সুবিদ আলী খানের মধ্যে পাঠানদের বৈশিষ্ট্য ছিল।
গরু-খাসি জবাই করে তাঁর আকিকাহ করা হয় এবং নবীজির (স) চাচা হযরত আব্বাস (রা)-এর নামানুসারে নাম রাখা হয় আব্বাস।
তিনি নিজ ঘরেই মৌলভী সাহেবের কাছে কুরআন শরীফের সবক নেন এবং ১৯২১ সালে ৮ বছর বয়সে নিজ গ্রাম থেকে দেড় মাইল উত্তরে এক মাদরাসায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন।
উল্লেখ যে, কুরআন শরীফ সবক নেয়ার আগেই তিনি আযান শিখেন। তিনি বাংলা, ইংরেজি, অংক, ইতিহাস, ভূগোল এবং ফার্সী অধ্যয়ন করেন।
৪র্থ শ্রেণীতেই তিনি শেখ সা’দী (র)-এর গুলেস্তা কিতাবে রপ্ত করেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে উঠার পর তিনি বাড়ী থেকে দুইশত মাইল দূরে হুগলী মাদরাসায় পড়তে যান। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে জ্বর নিয়ে সিক বেডে পরীক্ষা দিয়েও তিনি এক বছর স্থায়ী গভর্ণমেন্ট স্কলারশীপ এবং ৪ বছর স্থায়ী মহসিন স্কলারশীপ লাব করেন।

•••••••হুগলী মাদরাসায় পড়াশুনা শেষ করে রাজশাহী সরকারী কলেজ এবং রংপুর কারমাইকেল কলেজে অধ্যয়ন করেন। ১৯৩৫ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিস্টিংশনসহ বি.এ. পাস করেন। এরপর তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য কোলকাতা যান। কিন্তু অভিভাবকদের ইচ্ছাক্রমে চাকুরী গ্রহণ করেন। অফিসের বড় বাবু জনাব খান সাহেব নামায পড়তে যাওয়ার কারণে সব সময় খিচিমিচি করতেন। তাই শেষ অব্দি তিনি চাকুরী ছেড়ে দেন। কিন্তু নামায ছাড়েননি। উল্লেখ্য যে, সে সময় কোলকাতায় জুমার নামাযে প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আবুল কালাম আযাদের খুতবাহ শুনে তার মধ্যে এক উদ্দীপনা ও ভাবধারার সৃষ্টি হয়। এ সময় তিনি মাওলানা আবুল কালাম আযাদের আল জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ও হিযবুল্লাহ বই দুটি অধ্যয়ন করেন এবং আল জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ভাব অবলম্বনে ইংরেজিতে প্রবন্ধ লিখেন যা মাসিক মোহাম্মদী ও তৎকালীন ইংরেজী সাপ্তাহিক ‘মুসলিম’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

••••জনাব খান ১৯৩৬ সালের শেষদিকে আবার চাকুরীতে ঢুকেন এবং কোলকাতা ছেড়ে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি বেঙ্গল সেক্রেটারীয়েটে যোগদান করেন। এ সুবাদে সে ও বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের সেক্রেটারী হিসাবে কয়েক বছর নিয়োজিত থাকেন।

••••দেশে বিভাগের পর তিনি পূর্ব পাকিস্তানে সার্কেল অফিসার হিসাবে নিয়োগ পান। কিন্তু তিনি সে পদে যোগদান করেননি। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে জয়পুরহাটে স্থানীয় স্কুলের হেড মাষ্টার সীমান্ত পার হয়ে চলে যাওয়ায় ম্যাজিট্রেটের অনুরোধে হেড মাষ্টারের পদ গ্রহণ করেন।

•••••১৯৫৪ সালে স্থানীয় একটি মাদরাসায় ইসলামী জলসা ছিল। তাঁরই ছাত্র উক্ত মাদরাসার সেক্রেটারীর অনুরোধে তিনি ঐ জলসায় যান। উক্ত জলসায় প্রধান অতিথি ছিলেন ডঃ শহীদুল্লাহ। বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক আমীরে জামায়াত তদানীন্তন কারমাইকেল কলেজের তরুণ অধ্যাপক গোলাম আযম। ডঃ শহীদুল্লাহ অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি। শুধু অধ্যাপক গোলাম আযম গিয়েছিলেন।

•••••মরহুম আব্বাস আলী খান সাইকেলে চড়ে সভাস্থলে পৌঁছেন। অধ্যাপক গোলাম আযমের মুখে কালেমা তাইয়্যেবার ব্যাখ্যা শুনে মুগ্ধ হয়ে যান। সভাশেষে এক সাথে খাওয়া-দাওয়া ও পরিচয় হয়। জনাব খান অধ্যাপক সাহেবের কাছ থেকে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (র)-এর লেখা কিছু বই পুস্তক কিনেন এবং তার কাছেই শুনতে পান যে বগুড়ার জামায়াতের দায়িত্বশীল হলেন শায়খ আমীন উদ্দিন।

•••••১৯৫৫ সালের জানুয়ারিতে জনাব আব্বাস আলী খান বগুড়ার দায়িত্বশীল শায়খ আমীন উদ্দিনের সাথে দেখা করে মুত্তাফিক ফরম পূরণ করেন এবং নিজ এলাকায় একটি ইউনিট কায়েম করে সেই ইউনিট চালান।
৫৬ সালের মাঝামাঝি জামায়াতের রুকন হন এবং তদানীন্তন রাজশাহী বিভাগের আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম জনাব আব্বাস আলী খান-এর রুকনিয়াতের শপথ পাঠ করান।

••••••উল্লেখ্য যে, মাওলানা মওদূদী (র) ১৯৫৬ সালে প্রথম পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন। এসময় থেকে খান সাহেব মাওলানা মওদূদীর (র) সান্নিধ্যে আসেন। মরহুম খান সাহেব খুব ভালো উর্দু জানতেন, তাই তিনি মূল উর্দু ভাষায় মাওলানার সবগুলো বই পড়ে ফেলেন এবং মাওলানার সান্নিধ্যে থেকে মাওলানার বক্তৃতা এবং আলোচনা ভালোভাবে হজম করেন। মাওলানা দ্বিতীয় বার পূর্ব পাকিস্তান সফর করেন ১৯৫৮ সালে। এ সফরে তিনি রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও রাজশাহীতে যেসব জনসভা ও সমাবেশে বক্তৃতা করেন, মরহুম খান সাহেব সেসব সভা সমাবেশে মাওলানার দোভাষীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৭ সালের প্রথম দিকে জামায়াতের নির্দেশে তিনি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের চাকুরী ত্যাগ করেন। স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি এবং ছাত্ররা তাঁকে কিছুতেই স্কুল থেকে ছাড়তে রাজি হচ্ছিল না। এমনকি স্কুলের শত শত ছাত্র এসে তাঁকে স্কুলে ফিরিয়ে নেবা জন্য তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে। তিনি তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে জামায়াতের মাছিগোট সম্মেলনে রওনা করে এ ঘেরাও থেকে রক্ষা পান।

••••••১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মাছিগোটে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর রুকন সম্মেলনে তিনি যোগদান করেন। এ বছরই তাঁর উপর রাজশাহী বিভাগীয় জামায়াতে ইসলামীর আমীরের দায়িত্ব অর্পিত হয়। পাকিস্তান আমলের শেষ পর্যন্ত তিনি বিভাগীয় আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামী পুনর্গঠিত হবার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জনাব আব্বাস আলী খান জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালের রমযান মাসে আমীরে জামায়াত অধ্যাপক গোলাম আযমকে যখন জেলে নেয়া হয় এবং ১৬ মাস বন্দী করে রাখা হয়, তখনো তিনি ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া আমীরে জামায়াত যখনই দেশের বাইরে গিয়েছেন, তখন তিনিই ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব পালন করেছেন।

•••••••জনাব আব্বাস আলী খান ১৯৬২ সালে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি জামায়াতে ইসলামীর পার্লামেন্টারি গ্রুপের নেতৃত্ব দেন এবং জাতীয় পরিষদে ইসলাম ও গণতন্ত্রের পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন।
জনাব খান জামায়াতের সংসদীয় গ্রুপের নেতা হিসেবে আইয়ুব খানের কুখ্যাত মুসলিম পারিবারিক আইন বাতিলের জন্য ১৯৬২ সালের ৪ঠা জুলাই জাতীয় পরিষদে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পেশ করেন। অধিবেশন শুরুর আগের দিন ৩রা জুলাই আইয়ুব খান জনাব আব্বাস আলী খানকে তার বাসভবনে আমন্ত্রণ জানান। জেনারেল আইয়ুব খান তাকে মেহমানদারী করার ফাঁকে প্রস্তাবিত বিলটি জাতীয় পরিষদে পেশ না করার জন্য আকারে ইংগিতে শাসিয়ে দেন। সেই সাথে এর বিরোধীতা করার জন্য মহিলাদেরকে উসকিয়ে দেন। কিন্তু তীব্র বিরোধীতার মুখেও জনাব খান বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন।

প্রচন্ড বিরোধীতার মুখে বিলটি আলোচনার জন্য গৃহীত হয়। এসময় আইয়ুব খানের লেলিয়ে দেয়া ‘আপওয়া’ বাহিনীর উগ্র আধুনিক মহিলারা পিন্ডি, লাহোর ও করাচীতে জনাব খানের কুশ পুত্তালিকা দাহ করে। অবশ্য পাশাপাশি সারা দেশ থেকে জনাব আব্বাস আলী খানের নিকট অজ¯্র অভিনন্দন বার্তাও আসতে থাকে।

স্বৈরাচারী আইয়ুব বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে বিরোধী দলগুলো ‘কপ’, ‘পিডিএম’এবং ‘ডাক’ নামে যেসব জোট গঠন করেছিল, তিনি ছিলেন এ জোটগুলোর অন্যতম নেতা। ১৯৬৯ সালের আইয়ুব বিরোধী গণঅভ্যূত্থানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

জনাব আব্বাস আলী খান ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রী সভায় শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ সরকার জনাব খানকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। এ সময়ে তিনি দু’বছর কারাভোগ করেন।

সারকথাঃ-
বাংলার ইতিহাসে এই সাহসী সৈনিকের এমন হাজারো ইতিহাস আছে যা বলে শেষ করা যাবেনা। সর্বোপরি মহান রবের নিকট দোয়া করি, করে কারিম তাদের মতো আামদেরকেও মুজাহিদের ভূমিকা পালন করার তৈফিক দান করুন এবং এমন সাহসী সৈনিক কে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।।

।।আব্বাস আলী খানের ২২ তম মৃত্যু বার্ষিকী, জন্ম, শিক্ষা, কর্ম ও রাজনীতি।।
????মুরাদ হাসান।

পঠিত : ৫৫২ বার

মন্তব্য: ০