Alapon

উপমহাদেশে উপনিবেশ




উপনিবেশবাদ (colonialism) বলতে কী বোঝায়? জার্মান ইতিহাসবিদ জর্জেন ওস্টারহোম বলেন, "উপনিবেশবাদ একটি আদিবাসী (বা জোর করে নিয়ে আসা) সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং বিদেশী হানাদার সংখ্যালঘুদের মধ্যে একটি সম্পর্ক।.... উপনিবেশকারীরা উপনিবেশিত জনগোষ্ঠীর সাথে সাংস্কৃতিক সমঝোতা প্রত্যাখ্যান করে, তাদের নিজস্ব শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাদের শাসনের নির্ধারিত আদেশ জোর করে মানতে বাধ্য করে।[১]
সহজ কথায়, উপনিবেশবাদ হলো বিদেশী কোন শক্তির শাসনের নামে শোষণ!
ইউরোপের উপনিবেশের পূর্বে মুসলিম শাসনামলে উপমহাদেশ ছিল সমৃদ্ধ। তখন ছিল আমাদের মাঠভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভর্তি মাছ। সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে ভারত বর্ষ পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়। যার মূল্যমান ছিল প্রায় 90 বিলিয়ন ডলার। এর জিডিপি ছিল সেই সময়ের সমগ্র বিশ্বের চার ভাগের এক ভাগ। [২]
একই সময় ইংল্যান্ডের অবস্থা ছিল ব্যর্থ ও গৃহযুদ্ধে জর্জরিত।এতটাই ছিল যে, বাণিজ্য সুরক্ষা ও প্রসারের জন্য পুঁজিই
ছিলনা। [৩] অর্থনীতি ছিল ভঙ্গুর। এসময় ব্রিটিশ রানী এলিজাবেথ বাণিজ্যের জন্য ব্রিটিশদের পূর্বের দিকে পাঠানের সিদ্ধান্ত নেন। তারপরেই তারা পেল এক আলাদীনের চেরাগ!
ষোড়শ শতাব্দীতে সম্রাট জাহাঙ্গীরের অনুমতিক্রমে একদল ব্রিটিশ বাণিজ্যিক উপমহাদেশে আসে। তারপরে তাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একসময় তারা ক্ষমতায়ও বসে যায়। ইতিহাসবিদ এইচ. জি. ওয়েলস বলেন, ❝রানী এলিজাবেথ যখন ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে স্বীকৃতি প্রদান করেন, তখন সেটা ছোট এক সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক কোম্পানি ছিল মাত্র। তারা এসেছিল কেনাবেচা করতে। আর তখন রূপ নিল জলদস্যুতে। তাদের কাজকর্মে বাধা দেওয়ার আর কেউ রইল না। এতে কি আর সন্দেহ থাকতে পারে যে, এর ক্যাপ্টেন, কমান্ডার, কর্মচারী এমনকি সাধারণ সৈনিক দেশে ফিরল সম্পদের পাহাড় মাথায় করে?❞[৪] তিনি আরও বলেন, "কর আদায়ে, যুদ্ধ পরিচালনা, অন্যান্য এশীয়দের কাছে দূত প্রেরণ, যেন এক স্বাধীন রাষ্ট্র তবে এই রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল পশ্চিমের সম্পদ পাচার।" [৫]
এই পাচারের পরিমাণ কেমন ছিল? উইলিয়াম ডিগবাই লিখেছেন, ❝পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার সম্পদ স্রোতের মতো এসে জমা হতে থাকে লন্ডনে। যেখানে ১৭৬০ এর আগে শিল্পকারখানার নামগন্ধও ছিলনা, সেখানে হাজার হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে।❞[৬] তিনি আরও বলেন, "১৯০০ সাল পর্যন্ত ভারত থেকে আইনগত ভাবে (আইন বানিয়ে) আমরা নিয়েছি ৬০৮০ মিলিয়ন পাউন্ড।"[৬] তাহলে বেআইনি ভাবে তার পরিমাণ কতটুকু হতে পারে?! এ. জে. উইলসন লিখেছেন, "ভারতীয়দের মাথাপিছু আয় সর্বোচ্চ 5 পাউন্ড সেখানে আমরা প্রতি বছর কোনো-না-কোনোভাবে তিন কোটি পাউন্ড নিয়ে যাচ্ছি। যা মোটের উপর ইন্ডিয়ার টোটাল সম্পদের ১০ ভাগের ১ ভাগ করে প্রতিবছর নিচ্ছি।" [৭] লর্ড মেকেল লিখেন, ❝ইংল্যান্ডের পুঁজি বহুগুণে বাড়িয়েছে ভারতীয় সম্পদের প্রবেশ। শিল্পবিপ্লব, যার উপর ভিত্তি করে ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। সম্ভব হয়েছিল কেবলমাত্র ইন্ডিয়ার সম্পদের কারণে। যা ছিলনা লোন, এমনিতেই নেয়া হয়েছিল। ইংল্যান্ডের উন্নতি মানে ভারতের লোকসান, এমনই লোকসান যা ভারতের শিল্পকে ফাঁকা করে দিয়েছিল কৃষিকে করে দিয়েছিল স্থবির। যে কোন দেশ যদি এইভাবে পাচার করা হয় সে ধনী সম্পদশালী হলেও নিঃস্ব হয়ে যাবে।❞[৮] তাছাড়া ১৭৯২ থেকে ১৯১৩ পর্যন্ত ব্রিটিশদের যুদ্ধের খরচও মিটিয়েছে ভারতবর্ষ। যা প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার।[৯]
যার ফলস্বরূপ, ১৮০১ থেকে ১৯০০ পর্যন্ত ১০০ বছরে মন্বন্তর হয়েছে ৩১ টা। না খেতে পেয়ে মারা গেছে ৪ কোটি ১০ লাখ মানুষ। [১০] আর আধমরা-অসুস্থ মানুষের তো হিসেবই নেই। যদি, উপমহাদেশের ইতিহাসে এই কালো অধ্যায়টা না আসত, যদি মুসলিম শাসনের ছায়ায়ই থাকত ভারতবর্ষ। তাহলে হয়তো বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত ভূখণ্ড হতো এটা।
-----------------------------------
তথ্যসূত্রঃ-
[১] Osterhammel, Jürgen(2005), Colonialism: A Theoretical Overview, trns. Shelley Frisch, pg. 16
[২] The World Economy, Angus Maddison, pg. 261. ডা. শামসুল আরেফিন, ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ২.০ পৃ. ২৪৮
[৩] Unhappy India, Lala Lajpat Rai, pg. 322
[৪] A short history of the world, H. G. Wells বঙ্গানুবাদ - সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ.১৭৯
[৫] প্রাগুক্ত, ১৮০
[৬] ও [১০] prosperous' British India, Sir William Digby, 1901
[৭] Fortnightly Review, March 1884
[৮] Unhappy India, Lala Lajpat Rai, 1929
[৯] India in the Victorian Age, Mr. R.C. Dutta
~ ৩০ রবিউল আওয়াল, ১৪৪৩

// উপমহাদেশে উপনিবেশ//
-siyam islam

পঠিত : ৪৩০ বার

মন্তব্য: ০