Alapon

মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা কোথায় যাচ্ছে...?




বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের প্রথম হওয়া: মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা কোথায় যাচ্ছে?


ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মাদ্রাসা ছাত্র প্রথম হওয়ার খবরটি বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। অনেক ধার্মিক ব্যক্তি এগুলো ফলাও করে প্রচার করছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এটা এমন মহাসাফল্য যা আগে কখনো ঘটেনি অথচ খুব জরুরি ছিল। এতে দেশ এবং জাতির প্রভূত কল্যাণ লুকিয়ে রয়েছে যার সন্ধান হয়তো তারা এতদিন করছিলেন।


কিন্তু একটি বৃহৎ গ্যাপ তারা সম্ভবত একদমই বুঝতে পারছেন না। সেটি দেখিয়ে দেয়ার জন্যই এই ক্ষুদ্র লেখার অবতারণা ঘটাচ্ছি।


আমি হয়তো তাদের মত জান পরনায় খুশি হতে পারছি না, কিন্তু মাদ্রাসা বিরোধীদের মত নিশ্চয়ই বিদ্বেষপরায়ণও হচ্ছি না। কারণ সেটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি নিজে একজন মাদ্রাসার ছাত্র ছিলাম। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমার আলাদা দুর্বলতা আছে। তাহলে বলতে পারেন আমি কেন হঠাৎ করে মাদ্রাসাছাত্রদের অভূতপূর্ব সাফল্যের গল্প সমালোচনার বিষবাষ্পে মিশাচ্ছি?


জ্বি, এই প্রশ্নের উত্তর আমি আজকে দিব। চলুন আলোচনা শুরু করি।


যেসব মাদ্রাসা ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ইউনিটে প্রথম হয়েছেন অথবা প্রথমদিকে আছেন, কিছু নগণ্য ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের কেউই ইসলাম বিষয়ে লেখাপড়া অব্যাহত রাখবেন না। মানে তাদের প্রায় সবাই পরবর্তীতে জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত হবেন। একারণে 'মাদ্রাসার সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররা আর আলেম হচ্ছেন না'- এমন রূঢ় সত্যের কাছে আমাদেরকে বন্দী হতে হচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ইতোমধ্যে মেরুকরণের প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে। আর এই ক্রান্তিকালে প্রখর মেধাবীদের ভিন্নমুখী শিক্ষাগ্রহণ মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে ক্রমশ পঙ্গু করে দেওয়ার পথকে উন্মুক্ত করবে এবং করছে।


বলুন তো এমন সংবাদ কোন ইসলামী শিক্ষা প্রেমিক ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিকে খুশি করতে পারে? অনেকে এখানে একটি জটিল প্রশ্ন করতে চান‌। 'ক্রমশ সামাজিক অধঃপতন আমাদের সমাজকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এহেন পরিস্থিতিতে মাদ্রাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত নৈতিকতাসম্পন্ন মেধাবীরা বিভিন্ন সেক্টরে গেলে দেশের দুর্নীতি ও অধঃপতনের মাত্রা কিছুটা হলেও কমতে পারে। তাহলে এর বিরোধিতা কেন?'


প্রশ্নটি খুবই অর্থবহ। চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ বুঝতেই পারছেন প্রশ্ন দু'টি দুই মেরুতে অবস্থান করছে।


মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত হবে - এটার প্রয়োজনীতা কিছু ক্ষেত্রে হলেও আছে। এটা অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু প্রবল আপত্তি কোথায় জানেন?


আজকাল সাধারণত মাদ্রাসায় মেধাবী ছাত্র- ছাত্রীদেরকে ভর্তি করানো হয় না। দৈবক্রমে যে কয়জন মেধাবী শিক্ষার্থী থাকে, তার বড় একটি অংশ দাখিল পরীক্ষার পর কলেজে ভর্তি হয়ে যায়। তার জ্যান্ত উদাহরণ হচ্ছি আমি ও আমার বন্ধু আসাদ। আমরা দুইজনই মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে দাখিলের পর পরই বিচ্যুত হয়ে যাই। এটাতো একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ মাত্র। সারাদেশে এটা নিয়ে জরিপ করলে বিষয়টি প্রবলভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।


দাখিলের পরেও কিছু মেধাবী মাদ্রাসায় থেকে যায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সুযোগ পাওয়ার সাথে সাথে বাকি মেধাবীরা জোট বেঁধে জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হচ্ছেন। অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পেয়ে, বাবা-মায়ের প্রবল চাপের কারণে, মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ে হয়নি তাই, একেবারে বসে থাকার থেকে মাদ্রাসায় পড়লে কিছুটা হলেও তো দ্বীনের জ্ঞান হবে- এমন ধারণা ও কারণেই বেশিরভাগ শিক্ষার্থী ফাযিল ও কামিলে ভর্তি হয়। এ পর্যায়ে হাতেগোনা কয়েকজন মেধাবী শিক্ষার্থী পাওয়া যায়। সেটা হয়তো হাজরে দুই একজন হতে পারে। ফলে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ফাজিল ও কামিল পাশ করা স্টুডেন্ট অর্থ হচ্ছে ক্লাসের সবচেয়ে কম মেধাবী অথবা বাধ্য হয়ে পাস করা শিক্ষার্থী , যে পরীক্ষার আগের ২-১ দিন ছাড়া সারা বছরে বইয়ের কাছেও যায় না।


তার পরিপ্রেক্ষিতে আলেম তৈরীর কারখানা মাদ্রাসা আজ প্রায় বিকাল হয়ে গেছে। এ প্রতিষ্ঠানের প্রাণ থাকলে হয়তো আমরা কান্নার বিকট আওয়াজ শুনতে পেতাম! শুনতে পেতাম তার তীব্র হাহাকার আর যন্ত্রণার কথা!


এমন অনেক এলাকা আছে যেখানে খুব কষ্ট করে খুঁজে খুঁজে দু একজন মাদ্রাসা শিক্ষিত পাওয়া যাচ্ছে‌। তাদের কেরাত, খুতবা দেওয়ার পদ্ধতি, জ্ঞান সম্পর্কে জানলে যে কেউ বিরক্ত হবেন। তাদের পেছনে নামাজ আদায় করা জায়েজ হবে কিনা তখন এই ফতোয়া খুঁজতে হবে। এটাই নির্ঘাত সত্য। এটাই বাস্তবতা। আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতা। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার এই বিকলাঙ্গতা, পঙ্গুত্ব, মেরুকরণের প্রধান শিকার হওয়া থেকে বাঁচার একটি চমৎকার পথ হচ্ছে মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে মাদ্রাসাতেই উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা করা। জেনারেল শিক্ষার অভিলাষ থাকলে তা মাদ্রাসা শিক্ষায় থেকে অর্জনের চেষ্টা করবেন। এটা বর্তমান যুগে খুবই সম্ভব।


তাহলে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা আবারো প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। আমরা পাব জাতির ক্রান্তিকালে দ্বীনের জ্ঞান ও দাওয়াত মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার যোগ্য আলিম শ্রেণী। কারণ একদল যোগ্য আলেম ছাড়া কোন জাতি কখনোই সঠিক পথের উপরে স্থায়িত্ব অর্জন করতে পারে না, টালমাটাল অবস্থা হয়ে যায়। আজকের সমাজের দিকে তাকালে তা নিশ্চয়ই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যদিও আমরা অধঃপতনের প্রান্তসীমায় এখনো হয়তো পৌঁছাইনি, তবে যে পথে আমরা হাঁটছি তার শেষ সীমা অধঃপতনের অতল গহবর। এজন্যই মাদ্রাসার মেধাবী শিক্ষার্থীদের বড় বংশ অবশ্যই আলেম হবেন এটাই কাম্য।


তবে মেধাবীদের একটি অংশ যদি জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চায় তাহলে সেটা হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে তেমনটা হচ্ছে না। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জেনারেল শিক্ষায় আসার ধরন থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, তারা এতদিন ভুলপথে ছিল এখন তারা নিজেদেরকে শুধরে নিতে চায়! অবশ্যই এটা সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে।


পরিশেষে এটা বলা বাঞ্ছনীয় হবে যে, মাদ্রাসার মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে। কিন্তু তা যেন অতিমাত্রিক না হয় সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। আচ্ছা কোন পোশাক কারখানা যদি হঠাৎ করে এমন পরিমাণ বার্গার বানানো শুরু করে যা মোট পোষাক তৈরীর সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি তাহলে সেই কারখানাকে কী পোশাক তৈরির কারখানা বলা হবে নাকি বার্গার তৈরির ফ্যাক্টরি বলা হবে?


মাদ্রাসা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যোগ্য আলেম শ্রেণী তৈরি করা। সেই চাহিদা যদি এ শিক্ষা ব্যবস্থা পূরণ করতে না পারে তাহলে এটার ব্যর্থতা নিয়ে নিঃসন্দেহে কোন বিতর্ক থাকা উচিত নয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই ব্যর্থতা অস্বীকার করার অথবা ঢেকে রাখার কোন সুযোগ নেই। তবে ব্যর্থতা দূর করার সুযোগ এখনও শেষ হয়ে যায়নি। আর তা হলো গণহারে সকল মেধাবীদেরকে জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পথ একেবারে বন্ধ করে দেওয়া। অল্প কিছু মাদ্রাসার মেধাবী শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট সৎ উদ্দেশ্যে জেনারেল শিক্ষায় যাচ্ছে এমন একটি পরিবেশ যখন তৈরি হবে তখন আমরা উল্লসিত হতে পারব।

পঠিত : ১০১২ বার

মন্তব্য: ০