Alapon

চরমােনাইর পীর সাহেব আমার বাড়িতে এলেন

চরমােনাইর পীর সাহেব আমার বাড়িতে এলেন
অধ্যাপক গোলাম আযম রাহিঃ


১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক শুক্রবার সকালে পীর সাহেব ও ব্যারিস্টার মাওলানা কুরবান আলী আমার বাড়িতে তাশরীফ আনলেন। হঠাৎ করেই হাজির হওয়ায় তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, বিনা খবরেই কী মনে করে এলেন?'
এর জবাবে দুজনের মধ্যে কে কথা বলবেন তা নিয়ে কিছুক্ষণ ঠেলাঠেলি হলাে। পীর সাহেব বলতে থাকলেন, ব্যারিস্টার সাহেব বলেন। আর ব্যারিস্টার সাহেব বারবার বললেন, 'হুজুর বলেন'। শেষ পর্যন্ত ব্যারিস্টার সাহেব বলা শুরু করলেন বুঝতে পারলাম, কোন্ বিষয়ে আমার সাথে আলাপ করা হবে তা দুজনেই পরামর্শ করে
ঠিক করে এসেছেন। এখন কে কথা বলবেন তা নিয়ে সামান্য একটু ঠেলাঠেলি হলাে।
ব্যারিস্টার সাহেব বললেন, “প্রফেসর সাহেব! আপনি তাে বিদেশ থেকে আসার পর থেকেই ইসলামী ঐক্যের জন্য বই লিখলেন এবং অনেক চেষ্টা করলেন; কিন্তু এখনও কাঙ্ক্ষিত ঐক্য গড়ে উঠল না। আপনি কোনাে এক ব্যক্তির একক নেতৃত্বের বদলে সামষ্টিক নেতৃত্ব বা সম্মিলিত নেতৃত্বের ভিত্তিতে ঐক্যের চেষ্টা করেছেন; কিন্তু এক ব্যক্তিকে নেতা না মানলে প্রকৃত ঐক্য হতে পারে না।

নেতৃত্বের দায়িত্ব এমন একজনের হাতে তুলে দিতে হবে, যিনি একই সাথে আলেম
ও পীর। আমি আলেম হলেও পীর নই। আর আপনি তাে আলেমও নন, আমাদের দেশে যে ক'জন ব্যক্তিত্ব আলেম ও পীর হিসেবে গণ্য তাঁদের মধ্যে নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে এ হুযুরের (পীর সাহেবের দিকে ইঙ্গিত করে) চেয়ে যােগ্য অন্য কেউ নেই।”
পীর সাহেবের উপস্থিতিতে এ কথাগুলাে শুনে আমি হতভম্ব অবস্থায় পীর সাহেবের দিকে তাকালাম এবং নির্বাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম যে, ব্যারিস্টার সাহেবের বক্তব্যে তিনি অত্যন্ত সন্তুষ্ট। তাঁর উৎফুল্ল চেহারা এখনও আমার চোখে ভাসছে।

আমি বিব্রত অবস্থায় ব্যারিস্টার সাহেবকে বললাম, “আপনার প্রস্তাব শুনলাম। আমার সহকর্মীদের নিকট বিষয়টা পেশ করব।” তাঁরা বিদায় নিয়ে গেলে আমি ভাবতে থাকলাম, ব্যারিস্টার সাহেব একা এসেই তাে এ কথাগুলাে আমাকে বলতে পারতেন। তিনি পীর সাহেবের সামনেই এভাবে তার নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার আহ্বান জানালেন বলে আমি চরমভাবে বিস্মিত হলাম । আর পীর সাহেবই বা কেমন করে তার সামনেই এসব কথা ব্যারিস্টার সাহেবকে বলতে
পীরও নন।

দিলেন সেটা আরও বেশি বিস্ময়ের ব্যাপার। আর তার পক্ষে এমন ওকালতিতে পীর সাহেবকে খুশি হতে দেখে তাে আমি অত্যন্ত ব্রিতবােধ করলাম।
তাঁরা দুজন বিদায় নেওয়ার পরপরই আমি জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে ফোনে ঘটনাটা জানালাম । কুরবান সাহেবকে নিজামী সাহেব বড় ভাইয়ের মতােই শ্রদ্ধা করেন। তিনি তাঁকে ফোনে জিজ্ঞেস করলেন, “কুরবান ভাই! আপনি আমীরে জামায়াতের নিকট যে কথা বলে এলেন সে কথাটি আগে আমাকে বললেই ভালাে হতাে।” কুরবান সাহেব নাকি জবাব দিলেন, “এটাকে আপনি এত সিরিয়াসলি নেবেন না, পীর সাহেবকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে আমি এ কথা বলেছি।” এ কথা জেনে আমি আরও বিস্মিত হলাম ।

ব্যারিস্টার কুরবান সাহেবের সাথে আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বহু বছর থেকে পঞ্চাশের দশকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে যখন পূর্ব-পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘ গঠিত হয়, তখন তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। তিনি পীর সাহেবকে যখন নিয়ে আসেন তখন তিনি ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের দ্বিতীয় প্রধান নেতা।
কয়েক বছর পর তিনি আবার এসে প্রস্তাব দিলেন যে, একটা সর্বদলীয় ঐক্যজোট করা হােক এবং প্রত্যেক দলের প্রধানকে নির্দিষ্ট একটি মেয়াদের জন্য জোটপ্রধান করা হােক। তবে প্রথম জোটপ্রধান করা হােক চরমােনাইর পীর সাহেবকে।

আমি বললাম, আপনি আলেম মানুষ আপনি কি জানেন না যে, ইসলামে নেতৃত্বের খাহেশ রাখা জায়েয নয়? জওয়াবে তিনি বললেন, অবশ্যই আমি এ কথা জানি।
আবার জিজ্ঞেস করলাম, চরমােনাইর পীর সাহেব নেতৃত্বের আকাঙ্ক্ষী কি না?
বললেন, তিনি চরম নেতৃত্বলােভী । বললাম, তাহলে আপনি এমন প্রস্তাব নিয়ে এলেন
কেমন করে? বললেন, আমি চাই, তবুও ঐক্যজোট হােক।

ব্যারিস্টার মাওলানা কুরবান আলী সাহেব জীবিত থাকলে (মৃত্যু ২০০৫) আমার উপরিউক্ত বিবরণ সত্যায়িত করতে পারতেন। আমি আল্লাহকে সাক্ষী রেখে এসব সত্য প্রকাশ করছি।
কারাগারে বন্দী থেকেও ইসলামী ঐক্যের জন্য প্রচেষ্টা

১৯৯০ সালের শেষার্ধে কেয়ারটেকার সরকার কায়েমের দাবিতে দুবার আন্দোলনের ফলে স্বৈরশাসক এরশাদ ৬ ডিসেম্বর পদত্যাগ করলেন, কেয়ারটেকার সরকারের পরিচালনায় ১৯৯১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করতে সম্মত হয়। এ সময় ইসলামী ঐক্যপ্রচেষ্টা মুলতবিই রইল ।

১৯৯২ সালের ২৪ মার্চ বিদেশী নাগরিক হিসেবে আমাকে গ্রেফতার করা হলাে।
আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৯৩ সালের জুলাই পর্যন্ত রাজবন্দী হিসেবে ছিলাম ।
১৬ মাস বন্দী থাকাকালে ১৬টি বই লিখি । আর ইসলামী শক্তির ঐক্যমঞ্চ চাই' বলে
একটি প্রবন্ধ রচনা করি। কারামুক্ত হওয়ার পর ইসলামী ঐক্যপ্রচেষ্টা' নামে একটি পুস্তিকা রচনা করি এবং সংশ্লিষ্ট মহলে তা বিলি করা হয়, যাতে এ বিষয়ে কেউ উদ্যোগ নিতে চাইলে এটাকে একটা ফর্মুলা হিসেবে বিবেচনা করতে পারেন। আমার প্রণীত পূর্ববর্তী ফর্মুলা অনুযায়ী আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে ওলামা ও মাশায়েখের সাথে যােগাযােগ করার জন্য একজন আলিয়া মাদরাসা-পাস আলেমকে নিয়ােজিত করি এবং এর জন্য প্রয়ােজনীয় অর্থ যােগান দেওয়ারও ব্যবস্থা করি। কিন্তু জেলে লেখা ফর্মুলাটির ভিত্তিতে আমি কোনাে উদ্যোগ নিতে হিম্মত করিনি।

ইত্তেহাদুল উম্মাহ ভেঙ্গে যাওয়ার পর ১৯৮৯ সালে যে সর্বদলীয় শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তার উদ্যোগ আমিই নিয়েছিলাম। সম্মেলনের সাফল্য থেকে ধারণা করা হয়েছিল ছিল যে, ১০ জনের রাবেতা কমিটি এবং পরবর্তীতে ৫ জনের রাবেতা কমিটি সক্রিয় হবে এবং তাদের প্রচেষ্টায় আবার একটা ঐক্যমঞ্চ গড়ে উঠবে। কিন্তু সে ধরনের কোনাে প্রচেষ্টাই আর চালু হয়নি বলে আমি হিম্মত হারিয়ে ফেলি। জেলে প্রণীত ফর্মুলাটি এখানে পেশ করছি।

বাংলাদেশে ইসলামী ঐক্যপ্রচেষ্টার ইতিহাস ৪৭-৪৮ পৃষ্ঠা

পঠিত : ৩২৬ বার

মন্তব্য: ০