ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মায়িন
তারিখঃ ৫ ডিসেম্বর, ২০২১, ১৯:৫৩
রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিস সমূহের প্রতি, নববী ইলমের রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি কতোটা ডেডিকেশন থাকলে, কতো বেশি পরিশ্রমের প্র্যাক্টিস থাকলে একজন মানুষের পক্ষে দশলক্ষ হাদিস নিজ হাতেই লিপিবদ্ধ করা যায়? হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন দশলক্ষই!
রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আ'লাইহি ওয়াসাল্লামের হাদিসগুলোর শুদ্ধাশুদ্ধি নির্ণয়ের জন্য, যথাযথভাবে উম্মাহর কাছে সংরক্ষণের জন্য ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মায়িন এটাই করেছেন।
আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! যদি কোনো ফাসিক্ব ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে তবে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখো’
আর তাঁর মতো এমন বিদগ্ধ ইমাম কি আল্লাহর এই নির্দেশনা অমান্য করে এর বাহিরে চলতে পারেন? তাই তো তিনি এ হাদিসগুলো সংরক্ষণ করেই শুধু বসে থাকেননি, এগুলোর শুদ্ধতা যাচাই-বাছাই করার কাজও করেছেন। খুবই মনোযোগের সাথেই করেছেন তা। যার কারণে তাঁকে শুনতে হয়েছে অনেক অপবাদ আর গালাগালি। তিনি রিজালশাস্ত্রে (রিজালশাস্ত্র হলো হাদিসের সনদ সম্পর্কে জ্ঞান। অর্থাৎ সনদে যে সকল বর্ণনাকারী রয়েছেন, তাঁরা নির্ভরযোগ্য কি-না, সে সম্পর্কিত বিশেষায়িত জ্ঞান।)
বিশেষজ্ঞ হওয়ায় হাদিসের রাবিদের (বর্ণনাকারীদের) ব্যাপারে তার ছাত্রদের অবগত করতেন। হাদিসগুলোর অবস্থা জানাতেন। এটাই তখনকার সময়ে অনেকের সহ্য হতো না। তাই তো তারা তাকে গালাগাল করতো। গীবতকারী বলতো। বলতো ইয়াহইয়া ইবনু মায়িন গীবত-শেকায়েতকে ইবাদাত হিসেবে গ্রহণ করা ব্যক্তি। এমনও অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আসতো যে, তিনি নাকি আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতিকারী। কিন্তু তবুও তিনি কেবল হাদিসের বিশুদ্ধতা প্রমাণ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে “টু” শব্দটিও করেননি।
হাদিস শাস্ত্রের বাহিরে তাঁর মজবুত পদচারণা ছিলো। আর সেটা হলো কবিতা সাহিত্যে। তিনি ছিলেন একজন স্বভাব কবি। তৎকালীন খুবই জাঁদরেল কবিদের অন্যতম একজন ছিলেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধবাদীরা কাব্যের মাধ্যমে তাঁর বিরুদ্ধে অমূলক-অন্যায় সমালোচনা করতো। ঘৃণামুখি কবিতার চাষাবাদ করা হতো এই মহান মানুষটির বিরুদ্ধে। এতো কিছুর পরেও তিনি তাদের বিরুদ্ধে একলাইনেরও একটা কবিতা লিখে জবাব দিয়েছেন বলে প্রমাণ পাইনি আমরা। কিন্তু তাঁর পক্ষ হয়ে অনেকে অন্যায় সমালোচনাকারীদের জবাব দিয়েছেন। মোটাদাগে সে সময়ে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে গেছে যে, তাঁর পক্ষে-বিপক্ষে কবিতাকে সমালোচনার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে কবিতা যুদ্ধ চলতো। সমালোচকরা যেভাবে ওনাকে কবিতার মাধ্যমে সমালোচনা করতো, তদ্রূপ ওনার শুভাকাঙ্ক্ষীগণও কবিতার মাধ্যমেই তাঁর পক্ষাবলম্বন করতেন। তাঁকে ডিফেণ্ড করতো।
এই মহান মনীষী জন্মগ্রহণ করেন ১৫৮ সালে। বাগদাদ শহরে। বসবাসও করতেন সেখানেই। মৃত্যু বরণ করেন ২৩৩ সালে মদিনায়। তাঁর জীবনী থেকে জানা যায় তিনি বনু মুরবার আযাকৃত দাস ছিলেন। অথচ তাঁর বাবা সরকারি অফিসে কর্মরত ছিলেন। ছিলো প্রচুর প্রাচুর্য তথা অঢেল অর্থসম্পদ। কিন্তু তবুও কীভাবে কেনো দাস হলেন তিনি তা অস্পষ্ট। যাইহোক, যখন তিনি আযাদ হলেন, তখন উত্তারাধিকার সূত্রে পিতার সেই বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিকানা লাভ করেছেন তিনি। ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মায়িন এখন অঢেল সম্পদের মালিক।
আল্লাহ সুবহানাহু ওতাআলা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “জেনে রেখো, তোমাদের ধন-সম্পদ আর সন্তান-সন্ততি হচ্ছে পরীক্ষার সামগ্রী মাত্র (এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হবে তাদের জন্য) আল্লাহর নিকট রয়েছে মহাপুরস্কার।”
এই যে এতো অর্থবিত্ত, এই অর্থসম্পদ কখনো কখনো মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কিন্তু এই অঢেল অর্থ তাঁকে কখনো বিপথগামী করেনি। একটা সিঙেল মোমেন্টের জন্যেও অর্থসম্পদ তাঁকে ভুলপথে চালিত করেনি। তিনি আগাগোড়া খাঁটি আল্লাহ ভীরু প্রাজ্ঞ-মেধাবী ও আবেদ একজন মানুষ ছিলেন। তিনি এই সম্পদের যে পরীক্ষা, সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এক মহাপুরুষ।
তিনি যে দশলাখ হাদিস নিজ হাতে লিপিবদ্ধ করতে পেরেছেন, এর পেছনে আমি মনে করি তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহ-উদ্যোগ ও চেষ্টা-সাধনার পাশাপাশি আর্থিক অবস্থার ভূমিকাও ছিলো। কারণ, তিনি জীবীকার পেছনে ছুটতে হয়নি। সময় ব্যয়ে করতে হয়নি। যার কারণে তাঁর পক্ষে এভাবে অনবরত সময় দিয়ে দ্বীনি ইল্ম চর্চা ও বিতরণের কাজ খুবই সহজ হয়েছে। এটা আল্লাহ সুবহানাহু ওতাআলার পক্ষ থেকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার ফলস্বরূপ এক মহাসম্মানজনক পুরস্কারও বটে। শুধুই তা-ই নয়, আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাঁর হাতেই ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ইমাম বুখারি, ইমাম মুসলিমদের মতো উম্মাহর কিংবদন্তি শ্রেষ্ঠ সন্তানদের তৈরি করেছেন। মানে এই মহান ইমামদের শিক্ষক ছিলেন তিনি। তারা ছিলেন সবাই-ই তাঁর ছাত্র। এঁদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দিতেন, সবচেয়ে বেশি উঁচু মাকামের মনে করতেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-কে। তাঁর প্রতিই বেশি তুষ্ট ছিলেন তিনি। তাঁর সম্পর্কে তিনি বলেছেন; আমি তাঁর মাঝে এমন কিছু চরিত্র দেখেছি, যা অন্যদের মধ্যে কখনো দেখিনি। সে সময় প্রায় সকলেই আহমদ ইবনে হাম্বলের মতো হবার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতো। তিনি স্পষ্টভাবে বলতেন আহমদ ইবনে হাম্বলের মতো হবার সাধ্য কারোরই নেই। তিনি নিজেকেও তাঁর ছাত্রের চেয়ে উত্তম মনে করতেন না। তাই তো তিনি বলেন, “আমাদের তাঁর মতো হবার শক্তি নেই। তাঁর পথে চলার সাধ্যও নেই।
ইমাম ইয়াহিয়া ইবনু মায়িনের কুনিয়াত বা উপনাম ছিলো আবু যাকারিয়া। তিনি হাজ্জে বাইতুল্লায় যান ২৩৩ সালে। সেখানে তিনি স্বপ্ন সাক্ষাৎ পান নবি করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামের। নবি পাক সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম তাঁকে ডেকে বলছেন; হে আবু যাকারিয়া ! আমার সাহর্য ছেড়ে কোথায় যাচ্ছো? এরপর তিনি মদিনাতেই থেকে যান। এবং এই স্বপ্ন দেখার তিনদিন পর তিনি সেখানেই ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাহি ইলাইহি রাজিউন !
তাঁর আরো একটি মহাসৌভাগ্য হচ্ছে এই যে, রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লামকে যে খাটে রেখে গোসল দেওয়া হয়, মৃত্যুপরবর্তী তাঁকেও সে একই খাটে রেখে গোসল দেওয়া হয়। মানুষ পৃথিবী থেকে চলে গেলে তাকে তার প্রিয়জন-আপনজনসহ অনেকেই স্বপ্ন দেখেন। তদ্রূপ ইমাম ইয়াহইয়া ইবনু মায়িনকেও অনেকে স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্নে যখন তাঁকে দেখার পর জিজ্ঞেস করা হয়েছে তুমি কেমন আছো? আল্লাহ তোমার সাথে কেমন ব্যবহার করছে? জবাবে তিনি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন, এবং জানান যে আল্লাহ তাঁর সাথে তিনশতাধিক হুরের বিবাহ দিয়েছেন। এই মহা মনীষী যাঁদের সাহচার্য পেয়েছেন, যাঁদের থেকে জ্ঞানার্জন করেছেন, তাঁরা হলেন; মুতামির ইবনু সুলায়মান, ইবনুল মুবারাক, হাসিম-সহ অন্যান্য।
মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওতাআলা নববী ইল্মের এই পুষ্পকে জান্নাতুল ফিরদৌসের মেহমান বানিয়ে দিন। তাঁর সমস্ত ভালো কাজগুলোকে কবুল করে নিন । আ-মী-ন!
মন্তব্য: ০