Alapon

একাধিক বিয়ে করা কি আবশ্যক?



ছুদিন আগে হঠাৎ একজন ভদ্রলোকের কথায় শুনলাম যে, কারও সামর্থ্য থাকলে তার ওপর নাকি একাধিক বিয়ে করা আবশ্যক। এক বিয়েতে সীমাবদ্ধ থাকলে গুনাহ হবে! আমি তো আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলাম। পরে এমন লোকের কথাও জানলাম যারা নাকি এর ওপর আমলের জন্য খুবই উৎসাহী!
.
আমার সামান্য পড়াশোনায় এমন অদ্ভুত মাস'আলা তো আমি ইসলামের মূলধারার কোনো আলিম থেকে পড়িনি,শুনিও নি। উল্টা শাফিঈ মাযহাব মোতাবেক তো এক বিয়ে করাই মুস্তাহাব। ইমাম শাফিঈ [রাহ.] বলেন-
.
وأحب له أن يقتصر على واحدة وإن أبيح له أكثر
.
"একাধিক বিয়ে করা বৈধ হলেও এক বিয়েতে সীমাবদ্ধ থাকাকেই আমি পছন্দ করি"
.
ইয়ামানের শাইখুশ শাওয়াফি ইমাম ইমরানী [রাহ.] বলেন-
.
أن غير النبي صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إنما كان الأفضل في حقه الاقتصار على واحدة
.
"নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্যদের জন্য উত্তম হচ্ছে সে এক বিয়েতে সীমাবদ্ধ থাকবে"[১]
.
একইভাবে হাম্বলীদের অবস্থান বর্ণনা করে ইমাম মারদাউই [রাহ.] বলেন,
.
وَيُسْتَحَبُّ أَيْضًا : أَنْ لَا يَزِيدَ عَلَى وَاحِدَةٍ ، إنْ حَصَلَ بِهَا الْإِعْفَافُ ، عَلَى الصَّحِيحِ مِنْ الْمَذْهَبِ
.
"পবিত্রতা অর্জিত হয়ে গেলে একের অধিক বিয়ে না করাই মুস্তাহাব, এটাই মাযহাবের সঠিক মত।"[২] একই কথা ইমাম হাজ্জাউইও [রাহ] উল্লেখ করেছেন[৩]
.
অন্যদিকে হানাফীদের অবস্থান হচ্ছে-
وَيَرَى الْحَنَفِيَّةُ إِبَاحَةَ تَعَدُّدِ الزَّوْجَاتِ إِلَى أَرْبَعٍ إِذَا أَمِنَ عَدَمَ الْجَوْرِ بَيْنَهُنَّ
.
"যদি স্ত্রীদের মাঝে অন্যায় করা থেকে নিরাপদ হয় তাহলে চারটা পর্যন্ত বিবাহ করা মুবাহ বলে হানাফীগণ মনে করেন"[৪]
.
মোট কথা হচ্ছে একাধিক বিয়ে করাকে কোনো মাযহাব মুস্তাহাব মনে করেছে বলে আমার জানা তো নেই, আমরা তেমনটা দেখিও না। এটা একদমই ব্র্যান্ড নিউ চিন্তাধারা। তার ওপর একে সুন্নাহ বলা কিংবা আরও আগ বেড়ে না করলে গুনাহগার হবে বলা তো আরও আশ্চর্যজনক কথা।
.
চার মাযহাবের ফিকহের এক্সপার্ট বলে স্বীকৃত ড. ওয়াহবাহ আয যুহাইলী [রাহ.] বলেন-
.
إن نظام وحدة الزوجة هو الأفضل وهو الغالب وهو الأصل شرعاً، وأما تعدد الزوجات فهو أمر نادر استثنائي وخلاف الأصل، لا يلجأ إليه إلا عند الحاجة الملحة، ولم توجبه الشريعة على أحد، بل ولم ترغب فيه، وإنما أباحته الشريعة لأسباب عامة وخاصة
.
"মূল নিয়মটা হচ্ছে একজন স্ত্রী থাকা, এটাই উত্তম, এটাই প্রধান অবস্থান এটাই শরী'আতের মূল বিধান। অন্যদিকে একাধিক স্ত্রী থাকা বিরল ব্যতিক্রমী বিষয়, যা মূল বিধানের বিপরীত। একান্ত বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত কেউ এর দারস্থ হয় না। শরী'আত কারো উপর একাধিক স্ত্রী রাখাকে ওয়াজিব বা আবশ্যক করেনি। এমনকি একাধিক বিয়ের উৎসাহও প্রদান করেনি। কেবল বিশেষ বা ব্যাপক কিছু কারণের জন্য একাধিক বিয়ের বৈধতা দিয়েছে মাত্র"[৫]
.
ড. যুহাইলীর কথায় মূল বিষয় একদমই সরলভাবে বোধগম্য হওয়ার কথা। ফকিহগণ এই বিধান তো এমনি এমনি আনেন নি, যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস বলছে-
.
‌مَنْ ‌كَانَتْ ‌لَهُ ‌امْرَأَتَانِ يَمِيلُ لِإِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى، جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَأَحَدُ شِقَّيْهِ سَاقِطٌ
.
"যার দুজন স্ত্রী রয়েছে, আর সে তাদের একজনের প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়ে, সে ব্যক্তি কিয়ামতের দিন অর্ধাংগ অবশ অবস্থায় আসবে"[৬]
.
এখানে অধিক ঝুঁকে পড়া মানে أي فضَّل إحداهما على الأخرى একের ওপর অপরকে প্রাধান্য দেয়া।[৭]অবশ্য এই প্রাধান্য মুহাব্বাতের ক্ষেত্রে না কেননা এটা মানব সামর্থ্যের ঊর্ধে, মানুষের মন তো একদিকে ঝুঁকেই যায়, এক্ষেত্রে খরচ, সময় ও অন্যান্য বিষয়ে সমতা রক্ষা আবশ্যক বলে প্রমাণিত হয়, অন্যদিকে মুহাব্বাত কারও প্রতি বেশি হলেও ক্ষতি নেই[৮]
.
কিন্তু রিস্ক থাকে বিধায়ই ফকিহগণ একাধিক বিয়েকে মুস্তাহাব বলেন নি; বরং জাস্ট মুবাহ বা জায়েয বলেছেন। ইসলামের সকল মাযহাবেই কমবেশি এই কথাই পাবেন। এখন কারও যদি প্রয়োজন পড়ে সে একাধিক বিয়ে করতেই পারে এতে গুনাহ নেই, তাই বলে একে প্রমোট করতে গিয়ে সুন্নাহ এমনকি ওয়াজিব পর্যন্ত বলে দেয়া বাড়াবাড়ি যা ফকিহুগণ করেন নি।
.
শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন[রাহ] সুন্দর বলেছেন-
.
فنقول: الاقتصار على الواحدة أسلم ، ولكن مع ذلك إذا كان الإنسان يرى من نفسه أن الواحدة لا تكفيه ولا تعفه ، فإننا نأمره بأن يتزوج ثانية وثالثة ورابعة ، حتى يحصل له الطمأنينة ، وغض البصر، وراحة النفس
.
"আমরা বলি, এক স্ত্রীতে সীমাবদ্ধ থাকাই অধিক নিরাপদ। তবে এরপরো যদি ব্যক্তি দেখে যে এক স্ত্রীতে তার পর্যাপ্ত হচ্ছে না এবং চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষিত হচ্ছে না, তাহলে আমরা বলি যে সে যেন ২য়, ৩য় এমনকি ৪র্থ বিয়ে করে, যতক্ষণনা সে প্রশান্তি অর্জন করছে, তার দৃষ্টি অবনত হচ্ছে এবং তার প্রাণ শান্তি পাচ্ছে"[৯]
.
.
[১) ইমাম ইমরানী (রাহ), আল বায়ান ফি মাযহাবিল ইমাম আশ শাফিঈ: ১১/১৮৯-৯০; জেদ্দাহ: দারুল মিনহাজ, ২০০০ ঈ.
২) ইমাম মারদাউই (রাহ), আল ইনসাফ: ৮/১৬
৩) ইমাম হাজ্জাউই (রাহ), কাশশাফুল কিনা: ১১/১৪৮
৪) আল মাউসু'আতুল ফিকহিয়্যাহ: ৪১/২২০
৫) ড. ওয়াহবাহ আয যুহাইলী (রাহ), আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু: ৯/৬৬৭০; দামেস্ক: দারুল ফিকর
৬) ইমাম আহমাদ (রাহ), আল মুসনাদ, হা: ৮৫৬৮, আল্লামা শু'আইব আরনাউত্বের (রাহ) মতে ইমাম বুখারি ও মুসলিমের শর্তে সহিহ;
৭) আল্লামা খলিল আহমাদ সাহারানপুরি (রাহ), বাযলুল মাজহুদ: ৮/৬৩; ভারত: মারকাযুশ শাইখ আবিল হাসান আন নাদউই, ২০০৬ ঈ.
৮) ইমাম আযিম-আবাদী (রাহ), আউনুল মা'বুদ: ৬/১২১; দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ
৯) শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন (রাহ), শরহুল মুমতি': ১২/১২]

- উস্তাদ Manzurul Karim

পঠিত : ৩৯২ বার

মন্তব্য: ০