Alapon

বাগদাদ পতনের ফল



৫০৭ বছরের ঐতিহ্যবাহী আব্বাসি খিলাফত ও সৌন্দর্যের ঐশ্বর্যপুরী বাগদাদের ধ্বংস ছিল মানবেতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা। মুসলমানদের অন্তরে এই ঘটনার মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এটা ছিল তাদের জন্য আল্লাহর আজাব ও কঠিন শাস্তিস্বরূপ। মোঙ্গলদের হাতে তাদের ইজ্জত-সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হয়। তারা আব্বাসি খিলাফত ও আল্লাহর রাসুলের বংশধর বনু আব্বাসকে তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমদের ও সভ্যতার ওপর এই ঘটনার অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যেমন :
#১. সাহিত্য-সভ্যতা ও চিন্তাশক্তির বিনাশ
সাধারণ মুসলমানগণ খিলাফতকে অনেক মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখত। তাদের কাছে খিলাফত ছিল সমগ্র মুসলিমবিশ্বের জন্য দর্পণস্বরূপ। তাই খিলাফত ছাড়া তারা অন্য কিছু ভাবতে পারত না। ইসলাম ও মুসলমানের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য খিলাফতকে তারা আবশ্যক জ্ঞান করত। আর এ কারণে যিনি খিলাফতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হতেন, তাঁকে (খলিফাকে) তারা অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সমীহের চোখে দেখত। তাঁর যেকোনো দীনি তৎপরতা তাদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করত।
কয়েক শতাব্দী ধরে বলতে গেলে খিলাফতের জাগতিক শক্তি যদিও নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু তা ঠিকই সভ্যতার আলো বিলিয়ে চলছিল। চেতনাশক্তি ধরে রেখেছিল। তবে বাগদাদের যখন পতন ঘটে এবং খলিফাকে হত্যা করা হয়, তখন সেটাও নিঃশেষ হয়ে যায় এবং রাজধানী সম্পূর্ণরূপে তার দীনি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।
#২. বাগদাদের অবনমন : খিলাফতের রাজধানী থেকে নগণ্য শহর
মোঙ্গল আগ্রাসনের পূর্বে বাগদাদ ছিল প্রাচ্যের সমস্ত মুসলিম দেশের শাসনব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র। তাই বিভিন্ন অঞ্চলের শাসক-প্রশাসক, আমিরগণ সেখানে আসতেন এবং এভাবে অন্যান্য রাজধানীর সঙ্গে বাগদাদের সংযোগ ও যোগাযোগ রক্ষা হতো। কিন্তু মোঙ্গলদের হাতে পতনের পর বাগদাদ সাধারণ শহরের পর্যায়ে নেমে আসে। সেখানে একজন সাধারণ গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। উত্তরের শহর আজারবাইজান তখন বাগদাদের স্থান দখল করে। রাজনৈতিক সমস্ত তৎপরতা সেখান থেকে পরিচালিত হতে থাকে। সেটি তখন রাজধানীর ‍ভূমিকা পালন করতে থাকে।
স্টিভেন রান্সিম্যান (Steven Runciman) বলেন, ‘বাগদাদ ধীরে ধীরে তার পরিচ্ছন্নতা ফিরিয়ে আনতে এবং পূর্বের শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনায় ফিরে যেতে শুরু করে; কিন্তু পূর্বাবস্থার এক-দশমাংশ ফিরিয়ে আনতেও তার ৪০ বছর সময়ে লেগে যায়।’
বাগদাদ পতনের মধ্য দিয়ে প্রাচ্যের মুসলিমবিশ্বে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। হালাকু খানের মৃত্যুর পর তার ছেলেরা ক্ষমতার অধিকারী হয়। কারাকোরামে মোঙ্গলদের যে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ছিল, তারা সেখান থেকে সরে এসে পারস্যে (ইরানে) এক নতুন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তাদের এই সাম্রাজ্যের নাম িছল ইলখানি সাম্রাজ্য।
#৩. জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চায় স্থবিরতা এবং আরবি ভাষার গুরুত্ব হ্রাস
বাগদাদ ছিল জ্ঞানবিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের প্রাণকেন্দ্র। যেহেতু আব্বাসিরা জ্ঞানানুরাগী ছিল, তাই তাদের শাসনামলে জ্ঞানবিজ্ঞানের অনেক উৎকর্ষ সাধিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞানপিপাসুরা বাগদাদে ছুটে আসত এবং ইসলামি শিক্ষা-সংস্কৃতির আলোয় আলোকিত হতো। ইসলামি সভ্যতা ও জ্ঞানবিজ্ঞানের উর্বর লালনভূমি বাগদাদে অনেক বড় বড় আলিম, গবেষক, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও কবির অবস্থান ছিল। মুসলিমবিশ্বে জ্ঞানের নেতৃত্ব দিত এঁরাই। মোঙ্গলদের হাতে যখন বাগদাদের পতন ঘটে, তখন মোঙ্গলরা তাদের সবাইকে হত্যা করে। শুধু অল্প কজন প্রাণে বেঁচে গিয়ে মিসর, শাম ও অন্যান্য ভূখণ্ডে আশ্রয় নিয়েছেন।
মোঙ্গলরা সমস্ত গ্রন্থাগার, মসজিদ-মাদরাসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেয়। কয়েক শতাব্দী সাধনা করে অসংখ্য শিল্পী ও কলাকুশলীর প্রচেষ্টায় ইসলামি স্থাপত্যকলার যেসব নিদর্শন তৈরি করা হয়েছিল, সেগুলো মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। জ্ঞানবিজ্ঞানের যে ঐতিহ্য গড়ে তোলা হয়, তার নামনিশানা মুছে ফেলে তারা।
মোটকথা, জ্ঞান ও সভ্যতার লালনক্ষেত্র বুখারা, িনশাপুর, রায় প্রভৃতি শহরের পতনের পর বাগদাদের পতন ছিল ইসলামি সভ্যতা-সংস্কৃতি ও কৃষ্টি-কালচারের ওপর একটি মারাত্মক আঘাত। সাহিত্য ও সংস্কৃতির ময়দানে আরবি ভাষার যে মর্যাদা ও গুরুত্ব ছিল, বাগদাদ পতনের ফলে তা হারিয়ে যায়। শুধু আরবি ভাষাই নয়, ফারসি ভাষার অগ্রগতির পথও চূড়ান্তভাবে রুদ্ধ হয়। ইরানে যদিও তখনো জ্ঞানবিজ্ঞান ও সাহিত্যের ভাষা হিসেবে আরবি অবশিষ্ট ছিল, কবি-সািহত্যিকরা এ ভাষায় গ্রন্থ রচনা করত; কিন্তু ফারসির প্রতি তাদের গুরুত্ব ছিল আরও অধিক। কেননা, সাধারণ মানুষ মনের ভাব প্রকাশে ফারসি ভাষায় বেশি আগ্রহ বোধ করত। তাদের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে এ ভাষা বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ই. জি. ব্রাউন বলেন, মুসলিমবিশ্বের রাজধানী বাগদাদের পতনের কারণে মুসলমানদের ঐক্য যেমন মারাত্মকভাবে বিনষ্ট হয়, তেমনি ইরানে আরবি ভাষাও তার গুরুত্ব হারায়। এর ব্যবহার শুধু ফিকহি বিষয়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। তাই খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকে এসে আমরা ইরানে আরবি ভাষায় রচিত খুব স্বল্পসংখ্যক গ্রন্থেরই সন্ধান পাই।
#৪. বাগদাদ পতনে খ্রিষ্টানদের আনন্দ-উল্লাস
আব্বাসি খিলাফতের পতনে সারা বিশ্বের খ্রিষ্টানদের মধ্যে আনন্দ-উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু সভ্যতার লীলাভূমি বাগদাদ ধ্বংসে অসভ্য তাতারদের সঙ্গে খ্রিষ্টানরাও যোগ দিয়েছিল, তাই তাদের উল্লাস ছিল বাঁধভাঙা; যুদ্ধজয়ের মতো। খ্রিষ্টান অধ্যুষিত আরমেনিয়া, জর্জিয়া ও ইনতাকিয়ার (এন্টিয়ক) সম্রাট তাতারদের সঙ্গে এই হামলায় অংশ নেয়। খ্রিষ্টানরা আরও একটা কারণে অনেক উল্লসিত ছিল। তাতাররা তাদের কোনো ক্ষতি না করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেটা রক্ষা করে। শুধু তা-ই নয়, হালাকু খ্রিষ্টান ধর্মযাজক মাকিকাকে মূল্যবান অনেক উপহার দেয়। তাকে দিজলার তীরবর্তী আব্বাসি খলিফাদের বিশাল একটি প্রাসাদ দান করে এবং তার উপদেষ্টা-পরিষদ ও নবগঠিত শাসন-কমিটির অন্তর্ভুক্ত করে। মাকিকা ছিল তার নৈকট্যপ্রাপ্তদের একজন।
সভ্যতার লীলাভূমি বাগদাদ ও শানদার আব্বাসি খিলাফতের পতনে খ্রিষ্টানদের আনন্দ সীমা ছাড়িয়ে যায়। তারা হালাকু ও তার স্ত্রী দোকুজ খাতুনের নামে জয়ধ্বনি দেয়। দোকুজ খাতুন ছিল একজন নেস্টোরিয়ান খ্রিষ্টান। তার তদবিরেই খ্রিষ্টানরা তাতারদের বর্বরতা থেকে রক্ষা পায়। তাই তারা তাকে ও তার স্বামী হালাকুকে তাদের ত্রাণকর্তা এবং ইসা মাসিহের শত্রুদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মৃত্যুদূত বলে বিশ্বাস করত। তবে খ্রিষ্টানদের এই আনন্দ-উল্লাস বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কেননা, এর দু-বছর পরই ৬৫৮ হিজরিতে আইন জালুতযুদ্ধে তাতাররা মামলুকদের হাতে পরাজিত হয়। সামনে এ সম্পর্কে আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ।

মোঙ্গল ও তাতারদের ইতিহাস :
ড. আলি মুহাম্মাদ সাল্লাবি
অনুবাদ : যায়েদ আলতাফ
কালান্তর প্রকাশনী

পঠিত : ৫৪৮ বার

মন্তব্য: ০