Alapon

~বাঙালি মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তির কয়েকটি কক্ষপথ~



//১//
বিংশ শতাব্দীতে যে কয়েকজন বাঙালি মুসলিম দর্শন চর্চার সূচনা করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন—মোহম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল হাশিম এবং দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। তিনজনের বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম তিন রকমের। বরকতুল্লাহ ছিলেন পেশায় প্রধানত একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। আবুল হাশিম ছিলেন মূলত একজন রাজনীতিবিদ। আর দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন একজন আজীবন শিক্ষাবিদ। কিন্তু পেশাগত জীবনের এই বৈচিত্র্য সত্ত্বেও এরা তিনজনই দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব চর্চা করেছেন।
বরকতুল্লাহ মেজাজের দিক থেকে ছিলেন উদারনৈতিক ও আধুনিক। আবুল হাশিম ছিলেন আধুনিক এবং কিছুটা সাম্যবাদ-ঘেঁষা। আর দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ শুরু করেছিলেন আধুনিক-অজ্ঞেয়বাদী হয়ে; মাঝপথে বাম দিকেও কিছুটা ঝুঁকেছিলেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত থিতু হয়েছিলেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দর্শন এবং ইসলামের এক অনবদ্য সমন্বয়ক হিশেবে।
প্রত্যেকের দর্শনে এবং বিশেষ করে জ্ঞানতত্ত্বে নিজস্বতা থাকলেও এদের প্রত্যেকেই ছিলেন কমবেশি অতিন্দ্রীয় স্বজ্ঞাবাদী। বুদ্ধিবাদ, অভিজ্ঞতাবাদ এবং বিচারবাদকে এরা সবাই যার যার মত করে সমীহ করলেও প্রত্যেকেই মনে করতেন যে সুনিশ্চিত সত্য অর্জন করা সম্ভব একমাত্র স্বজ্ঞার মাধ্যমেই। এটি কিন্তু এদের তিনজনের মাঝে একটি আশ্চর্য মিল এবং ঐক্য। যা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক এবং উৎসাহজনক।
এই কারণে এরা তিনজনই দিনশেষে ইসলামের প্রত্যাদেশভিত্তিক ঐশী সত্যকে দার্শনিকভাবে উপলব্ধি করে তা মনেপ্রাণে মেনে নিয়েছেন। তা নিজেদের জীবনে যেমন চর্চা করেছেন, অন্যদেরকেও অনুশীলন করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। এটি তারা সবাই করেছেন মূলত তাদের লেখালেখি ও বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে।
//২//
উপমহাদেশের আরেকটু আগের পর্বের কবি ও দার্শনিক ইকবালের চিন্তা ও সৃজনশীলতার সাপেক্ষে যদি উপরে উল্লেখিত তিনজনকে দেখতে চাই, তাহলে বলা যাবে যে বরকতুল্লাহ, হাশিম এবং আজরফ—এরা তিনজনই ইকবালের চিন্তাকেন্দ্র থেকে কমবেশি লিবারেল-বাম দিকে ঝুঁকেছিলেন। যদিও ইকবালের খুদি ও বেখুদি দর্শন এবং মুসলিম স্বাতন্ত্র্যচেতনার সঙ্গে এদের তিনজনেরই একটা অল্পবিস্তর নাড়ির বন্ধন টের পাওয়া যায়।
বাঙালি মুসলমান ইতিপূর্বে উনিশ শতকের সত্তর দশক থেকে একধরনের আধুনিক রেনেসাঁ বা নবজাগরণের ছোঁয়া পেয়েছিল। কিন্তু সেটা ছিল মূলত কলকাতা ভিত্তিক। এর ভাষা, আঙ্গিক ও প্রকরণে কলকাতার বাঙালি হিন্দু রেনেসাঁর প্রভূত প্রভাব ছিল। এছাড়া এই আংশিক ও সীমিত রেনেসাঁয় পূর্ব বাংলা বা ঢাকার অংশগ্রহণ প্রায় ছিল না বললেই চলে।
এরপরে অবশ্য ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ' কর্তৃক "বুদ্ধির মুক্তি" নামক একটি আন্দোলন হয়েছিল। একে অন্নদাশঙ্কর রায় বাংলার দ্বিতীয় রেনেসাঁ বলে চিহ্নিত করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯), আবুল হুসেন (১৮৯৬-১৯৩৮), কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১) এবং অন্যান্যদের মধ্যে কাজী আবদুল ওদুদ (১৮৯৪-১৯৭০), আবুল ফজল (১৯০৩-১৯৮৩) ও মোতাহের হোসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬) এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। 'শিখা' পত্রিকা ছিল এদের মুখপত্র।
//৩//
অন্যদিকে বাঙালি মুসলিম এই তিন দার্শনিকের পরবর্তী প্রজন্ম থেকে দুটি বিপরীতমুখী ধারার উৎপত্তি হয়েছিল বলা যায়। পরবর্তী প্রজন্মের প্রথম ধারাটি ছিল কলকাতায় গড়ে ওঠা 'পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি' এবং ঢাকায় গড়ে ওঠা 'পাকিস্তান রেনেসাঁ সংসদ'-কে আবর্তন করে। দুটিই গড়ে উঠেছিল চল্লিশের দশকে আজাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ইকবালের চিন্তার অনুপ্রেরণায়। প্রজন্মের এই ধারায় যোগ দিয়েছিলেন আবুল কালাম শামসুদ্দীন, মুজিবুর রহমান খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, হাবিবউল্লাহ বাহার, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ আলী আশরাফ, শাহেদ আলী প্রমুখ। পরবর্তীকালে হাসান জামানও এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।
কিন্তু রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয় চল্লিশ দশকের শেষে। বিশেষ করে পঞ্চাশ দশকের সূচনায়। এর ফলে একটি উত্তরপ্রজন্ম গড়ে ওঠে। যারা বাঙালি মুসলমানের ইসলামকেন্দ্রিক বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানকান্ডকে ক্রমশ ইউরোকেন্দ্রিক এবং ইন্দোকেন্দ্রিক করে তোলে। এই উত্তরপ্রজন্মের শুরুতে আমরা দেখতে পাই আবদুল হক, শওকত ওসমান, মুনীর চৌধুরী, আহমদ শরীফ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রাহমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, বদরুদ্দীন উমর, আনিসুজ্জামান, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান শেলী, সৈয়দ শামসুল হক, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ। একাত্তর উত্তর কালে এই ধারাটিতে আরো যুক্ত হন আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ, ফরহাদ মজহার, আকবর আলী খান, গোলাম মুরশিদ, আফসান চৌধুরী, তসলিমা নাসরীন, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সলিমুল্লাহ খান প্রমুখ।
//৪//

আবার অন্যদিকে আশি দশক ও বিশেষ করে নব্বই দশক থেকে ইসলামকেন্দ্রিক জ্ঞানকান্ডের একটি পুনরাবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। একাত্তর পরবর্তী কালে নিস্তেজিত এই ধারাটিতে আবার জোয়ার নিয়ে এসেছেন কয়েকজন মেধাবী প্রবীণ ও নবীন মনীষা। যেমন এবনে গোলাম সামাদ, মুঈনুদ্দীন আহমদ খান, আবদুল করিম, মুহাম্মদ মোহর আলী, আল মাহমুদ, মাহমুদুর রহমান, মোহাম্মদ আবদুল মান্নান, ফাহমিদ-উর-রহমান প্রমুখ।
এই ধারাটিতে মওলানা আবুল আ'লা মওদূদীর চিন্তা ও আন্দোলনের অনুসারী হিশেবে আরেকটি প্রশাখা এসে যুক্ত হয়েছে। এই প্রশাখাটির জ্ঞানতাত্ত্বিক বিনির্মাণে বিপুল অবদান রেখেছেন মওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম, শাহ আবদুল হান্নান প্রমুখ। ইকবালের দর্শন ও সাহিত্যের সাপেক্ষে যদি এই প্রশাখাটিকে দেখা হয় তাহলে এটা বলা যায় যে এটি ইকবালের অবস্থান থেকে আরো কিছুটা ডানমুখী। আর সে কারণে এই প্রশাখাটির সঙ্গেই ইউরোকেন্দ্রিক এবং ইন্দোকেন্দ্রিক ধারাটির সম্মুখ সংঘর্ষ বা হেড-অন-কলিশন সংঘটিত হচ্ছে।
অন্যদিকে ক্রমবর্ধিষ্ণূ-ঐতিহ্যবাদী উলামারা এদেশে মূলত এক অরাজনৈতিক/বিরাজনৈতিক, সম্প্রদায়ভিত্তিক ও সামাজিক ইসলামের চর্চা করে আসছেন। মক্তব, মাদরাসা ও মসজিদভিত্তিক এই কওমি ধারাটি বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক ধর্মীয় আচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে জনপরিসরে ভূমিকা পালন করে থাকে। ওয়াজ মাহফিলের মাধ্যমেও একধরনের ওরাল ধর্মীয় গণশিক্ষা ও দীক্ষা কার্যক্রমে এদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। তবে এদের মধ্যেও ইদানীং একধরনের অগোছালো দলীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ডের প্রবণতা লক্ষণীয়। যা তাদেরকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলির নিবিড় নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের টার্গেটে পরিণত করছে।
তবে এই পরিমন্ডলেও একটি ইলমী অবদানের স্রোত ফল্গুধারার মত প্রবহমান। যেমন সমসাময়িক কালে তাদের আকাবিরদের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে মওলানা মুহীউদ্দীন খান, মুফতি আবদুছ ছালাম চাটগামী, শায়খ মুসা আল হাফিজ প্রমুখ এক গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞানগত ও সাহিত্যিক ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। আলহামদুলিল্লাহ।
//৫//
বিংশ শতাব্দীর শুরুতে অন্তিম উপনিবেশকাল ও এরপর থেকে চলমান বিউপনিবেশায়নের প্রেক্ষাপটে বাঙালি মুসলমানের দার্শনিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক এই উত্থান-পতন ও পুনরুত্থানের রেখাচিত্র অনুসরণ করলে অনেক ধরনের বয়ান ও কক্ষপথ লক্ষ করা যায়। আর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অধিগঠন এখনো সম্পন্ন না হবার কারণে এখানে যে রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতা চলছে, সেটির যখন একধরনের নিষ্পত্তি হবে, কেবল তখনই এদেশে চিন্তার বিভিন্নমুখী পদ্ধতিগত উড্ডয়ন ও পরিযাত্রা আমরা দেখতে পাব। ইনশাআল্লাহ।


~বাঙালি মুসলিম বুদ্ধিবৃত্তির কয়েকটি কক্ষপথ~
-মনোয়ার সামসি সাখাওয়াত

পঠিত : ৮৫৫ বার

মন্তব্য: ০