Alapon

|| ইসলামি শাসনব্যবস্থায় বাক-স্বাধীনতা || .


.
‘বাক-স্বাধীনতা’ তথা ‘Freedom of Speech’ এর অধিকার নিয়ে পশ্চিমারা কথা বলছে। চারিদিক থেকে বাহবা আসতে লাগল। সমাজে থাকি বলে আমিও বাহবার আওয়াজে কিছুটা হতচকিত হয়ে উঠি। ভাবি— কীসের এতো হইচই? পরে ঘটনার বাস্তবতা টের পাই। কিছুকাল আগের উগ্ররা এখন বাক-স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলছে! কিন্তু কী আর করার, সব জেনেও পদ টিকিয়ে রাখতে সবার সাথে সুর মিলিয়ে আমিও বলে উঠি— ‘বাহবা! পশ্চিমাবাদ জিন্দাবাদ!’ পরে পশ্চিমাদের আসল রূপ মানুষের সামনে আসতে থাকে। মনে মনে ভাবলেম, এখন বুঝি তারা গ্রহণযোগ্যতা-প্রতিপত্তি হারাবে। কিন্তু না, কিছু হলো না। কারণ ততদিনে জাদুর ছড়ি সবার উপর ঘোরানো হয়ে গিয়েছে। কিছু মানুষ জাদুর জট ভেদ করে বের হতে চাইলেও কিছুকাল পর ভুলে যায়, যেন লক্ষহীন, যেন কিছুই হয়নি। হাজারো হৃদয়বিদারক ঘটনা থেকে সাম্প্রতিক একটি ঘটনা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ফ্রান্সে মহানবি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উদ্দেশ্য করে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শিত হলে ইমানুয়েল সরকার (লা‘নাতুল্লাহি আলাইহি) খোলাখুলিভাবে একে সমর্থন জানায় এবং উল্টো মুসলিমদের উপর ক্ষোভ প্রকাশ করে। তারা একে ‘বাক-স্বাধীনতা’ তথা ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ হিশেবে আখ্যায়িত করে এবং এর বিরোধিতা করাকে উগ্রবাদ হিশেবে সংজ্ঞায়িত করে। অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোও এতে সমর্থন জানায়। কেটে গেল অনেক মাস। একজন ফরাসি আর্টিস্ট হিটলারের ছবিতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাকরনের চেহারা বসিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সাটিয়ে দেয়। এবার কিন্তু আগের মতো হলো না। ফরাসি ইমানুয়েল সরকার সেই আর্টিস্টের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা ঠুকে দেয়। দেখুন কারবার! এ থেকে সুস্পষ্ট যে, বিধর্মীরা/পশ্চিমারা ‘ইসলামকে অপমান করা’কে বাক-স্বাধীনতার মোড়কে লেবেলিং করে মানুষের কাছে এক্সপোর্ট করে। আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন!
এখন আমরা ইসলামে বাক-স্বাধীনতার গুটিকয়েক নমুনা দেখে নিই।
খিলাফাতের দায়ভার গ্রহণের পর ভাষণ দিতে গিয়ে আমিরুল মুমিনীন উমার রদিয়াল্লাহু আনহু বলেছিলেন, “যদি তোমরা আমার মধ্যে কোনো বক্রতা দেখতে পাও, তবে আমাকে সোজা করে দিও।” সমবেত লোকেদের মধ্য থেকে একজন বলে উঠল, “তোমার মধ্যে কোনো বক্রতা দেখলে আমরা তোমাকে তীক্ষ্ণধার তলোয়ার দিয়ে সোজা করে দেবো।” শুনে উমার রদিয়াল্লাহু আনহু দু‘আ করতে লাগলেন, “আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া যে তিনি উমারের খিলাফাতের মধ্যে এমন ব্যক্তিও সৃষ্টি করেছেন, যে উমারকে তীক্ষ্ণধার তলোয়ার দিয়ে সোজা করতে পারে।”
এখানে লোকটি সেই উমারকে তলোয়ার দিয়ে সোজা করে দেওয়ার কথা বলছে—যে উমারকে শয়তান পর্যন্ত ভয় পেতো। যে উমার ছিলো আরবের শ্রেষ্ঠ বীর, মাদিনায় হিজরতের সময় সকলে গোপনে রাতে মক্কা ত্যাগ করলেও তিনি প্রকাশ্য দিবালোকে ঘোষণা দিয়ে মক্কা ত্যাগ করেন। সে যুগে বাকস্বাধীনতা কতো উচ্চ পর্যায়ে ছিলো, একজন সাধারণ নাগরিকও শাসকের কাছে তাঁর মনের কথা খুলে বলতে ভয় পেতো না। তা উল্লেখিত ঘটনার মাধ্যমে সহজেই অনুমেয়।
অন্য একটি বর্ণনায় পাওয়া যায়। মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রদিয়াল্লাহু আনহুকে উমার রদিয়াল্লাহু আনহু নিজের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল তিনি বলেন,
“যদি আপনি অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন, তাহ’লে আমরা আপনাকে সোজা করে দিব, যেমনটি তীর নিশানার দিকে সোজা করা হয়।” তখন উমার রদিয়াল্লাহু আনহু বললেন— “আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা, যিনি আমাকে এমন একটি জাতির উপর কর্তৃত্ব প্রদান করেছেন, যারা আমি অন্যায় করলে আমাকে সোজা করে দেয়।” [১]
অবাক করার বিষয় হলো, সেসময় মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ রদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন উমার রদিয়াল্লাহু আনহুর অধীনে কর্মরত হিশাব দপ্তরের প্রধান পরিদর্শক। [২]
সেক্যুলাররা “বাক-স্বাধীনতা” নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন তৈরি করেছে। খুব ভালো ব্যাপার। কিন্তু ওই আইনের বাস্তবায়ন ততক্ষণ পর্যন্ত বন্ধ থাকে, যতক্ষণ তা ইসলামের বিরুদ্ধে যায়। যখনই বাক-স্বাধীনতার বুলি তাদের নিজেদের বিরুদ্ধে যায় তখনই তকমা লাগানো হয় ‘সাম্প্রদায়িক’ অথবা ‘সন্ত্রাসী’ অথবা দুটি শব্দের মেলবন্ধনে যা হয়। এ প্রসঙ্গে ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রহিমাহুল্লাহর একটি উক্তি খুব মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন—
“তাদের (পশ্চিমাদের) এ ‚বহুত্ববাদ’ বড় অদ্ভুত! আমেরিকান, ব্রিটিশ, আইরিশ বা অন্য কোনো দেশের খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী কোনো সন্ত্রাসীকে ‘খ্রিস্টান সন্ত্রাসী’ বললে, তাঁরা আহত হন এবং এরূপ বলাকে অসহিষ্ণুতা বলে মনে করেন; কারণ এতে ধর্মপ্রাণ সৎ খ্রিস্টানগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া হয়। কিন্তু ইসলাম ধর্মের অনুসারী কোনো সন্ত্রাসীকে ‘মুসলিম সন্ত্রাসী’ বলতে অসুবিধা আছে বলে মনে করেন না। উপরন্তু ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম মুসলিমদেরকে সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করলেও কোনোরূপ অসহিষ্ণুতা হয় বলে তারা মনে করেন না, বরং একথার প্রতিবাদই (তাদের কাছে) অসহিষ্ণুতা! এ বহুত্ববাদের কারণে ইসলাম বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাসে আঘাত দিয়ে বক্তব্য, কার্টুন, সিনেমা, সাহিত্য ইত্যাদিকে ‘বাক-স্বাধীনতা’ বলে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু ‘এন্টি সেমিটিযম’ (Anti-Semitism) আইনের নামে ইহুদি জাতি ও ইহুদি ধর্ম বিষয়ক ঐতিহাসিক গবেষণা ও মতপ্রকাশ নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় করা হয়েছে। ‘ব্লাস্ফেমি’ (Blasphemy) আইনের মাধ্যমে খ্রিস্টধর্মের বিরুদ্ধে বক্তব্য নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় করা হয়েছে!”
বর্তমানে কোনো নাগরিক ওই দেশের শাসককে উসকানি, হুমকি অথবা অবমাননামূলক মন্তব্য করলে তাকে অন্ততপক্ষে একমাসের জেল এবং এক লক্ষ টাকা অর্থমূল্যের জরিমানা গুণতে হবে। বাক-স্বাধীনতা নিয়ে সরব যেকোনো উন্নত দেশে এর চেয়ে কঠোর শাস্তির আইন রয়েছে। আমি তো এখানে ‘অন্ততপক্ষের’ কথা বললাম। সেখানে উমারের মতো কটাক্ষকারীর জন্য কল্যাণ কামনা তো বহুদূরের কথা।
অন্যবারের ঘটনা। উমার রদিয়াল্লাহু আনহুর খিলাফাতকালে মুসলমানদের হাতে গণিমতের মাল (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ) হিশেবে কিছু ইয়ামানী কাপড় হস্তগত হয়। বণ্টন করে দেওয়া হলে সকলে এক টুকরো করে কাপড় পায়। উমার রদিয়াল্লাহু আনহু সেই কাপড় দিয়ে জামা তৈরি করেন। তিনি যেহেতু শারীরিক গঠনে লম্বা-চওড়া ছিলেন, এক টুকরো কাপড়ে তাঁর জামা হতো না, তাই তাঁর ছেলে আব্দুল্লাহ রদিয়াল্লাহু আনহু নিজের ভাগের কাপড়টিও তাকে দিয়েছিলেন।
বিপত্তি বাঁধল তখন, যখন তিনি মিম্বারে খুতবা দেওয়ার জন্য দাঁড়ালেন। একজন লোক স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় সে তাঁর খুতবা শুনবে না। উমার রদিয়াল্লাহু আনহু এর কারণ জানতে চাইলে সে বলল, “আপনি যে জামা পরেছেন, তা এক টুকরো কাপড়ে বানানো সম্ভব নয়। এর উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত আমরা আপনার খুতবা শুনবো না।” তখন উমার রদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর ছেলেকে আল্লাহর কসম করে এ ঘটনার সত্যতা বলতে বলেন। এতে আব্দুল্লাহ ইবনু উমার রদিয়াল্লাহু আনহু সবার উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি আমার ভাগের কাপড়টিও আব্বাকে জামা বানানোর জন্য দিয়েছি।” তখন লোকটি মেনে নিল। [৩]
.
______________________________
[১] ইমাম ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশক: ৫৫/২৭৭; ইমাম যাহাবি, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা: ২/৩৭২
[২] ইমাম যাহাবি, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা: ২/৩৭০
[৩] ইমাম ইবনুল কাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কিয়িন: ২/১২৩; সিফাতুস সাফওয়াহ: ১/২০৩
.
|| ইসলামি শাসনব্যবস্থায় বাক-স্বাধীনতা ||
—সাফওয়ান বিন বাসার
.

পঠিত : ৯০১ বার

মন্তব্য: ০