Alapon

শিক্ষাগুরুর মর্যাদা আজ যাদুঘরে মাত্র!

রাত ১২ টা । শীতে কাঁপতে কাঁপতে বাসায় ফিরছি। প্রেস ক্লাবের সামনে আসতেই ধমকে দাঁড়ালাম। গায়ে পাতলা একটি কম্বল জড়িয়ে সারি সারি হয়ে শুয়ে আছেন, মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকবৃদ্ধ।


খুব সম্ভবত শিশির পড়ার কারণে, কম্বলগুলো ভিজে যায়। যার কারণে কতককে দেখলাম, কম্বলের উপর পলিথিন মুড়িয়ে নিয়েছে। আমার সঙ্গে থাকা বড়ভাই বললেন, ‘ইন্টারেস্টিং তো। দুই একটা ছবি তুলে নাও।’


জবাবে বললাম, ‘এই মানুষগুলোর ছবি, আমি তুলতে পারব না। ভাববেন না, এখানে শুধু কতগুলো মানুষ শুয়ে আছে। বরঞ্জ এখানে পুরো বাংলাদেশই শুয়ে আছে।’


বাড়ির পাশেই আমার প্রাইমারী স্কুলের হেড স্যারের বাড়ি। ছোটবেলায় খেয়াল করতাম, মাঝে মাঝে স্যার মাসের শেষের দিকে আব্বার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। স্যারের সঙ্গে দু’এক মিনিট কথা বলে, আব্বা আবারো নিজের রুমে ফিরে আসতেন। মিনিট খানেক পর আব্বা আবারো স্যারের কাছে ফিরে যেতেন। ‍তিন চার মাস বিরতি দিয়ে এমন দৃশ্য প্রায়ই দেখা যেত।


সেই দৃশ্যের হেতু তখন না বুঝলেও এখন বুঝতে পারি। বেতনের সামান্য কিছু টাকা দিয়ে সংসারের ব্যয় চালানো যখন আর সম্ভব হচ্ছিল না, ঠিক তখনই স্যারকে অসহায় আত্নসমর্পন করতে হয়। এই অসহায় আত্নসমর্পন শুধু স্যারের একারই ছিল না। এ ছিল পুরো বাংলাদেশের অসহায় আত্নসমর্পন।


স্কুল জীবনে স্কাউটিং করতাম। ক্লাস টেনে থাকতে আমাদের স্কুল থেকে জাতীয় স্কাউট জাম্বুরীতে অংশ গ্রহণ করি। একজন স্যার যখন একই তাঁবুর নিচে তার ৮ জন ষ্টুডেন্টকে নিয়ে ১০-১২ দিন বসবাস করেন, তখন তাদের মাঝে পারসোনাল লাইফ বলতে আর কিছু থাকে না।


জাম্বুরী থাকা অবস্থায় একদিন তাঁবুতে ফিরে দেখি, সবাই কি নিয়ে যেন খুব হাসাহাসি করছে। ঘটনা জানতে চাইলে, তারা আমাকে স্যারের ব্যবহৃত একটি আন্ডারওয়ার দেখায়। সেই আন্ডারওয়ারের হাজারো ফুঁটো। তারা বলছিল, ‘সহস্রাধিক ফুঁটোর এই আন্ডারওয়ার পরার চেয়ে তো না পরাই ভালো। স্যার এইটা পরে কেন...’ তারপর হাসি।


আমি কেন জানি হাসতে পারিনি। পরিচিতজনরা মাঝে মাঝেই আমাকে কটাক্ষ করে বলেন, ‘অতিআবেগী। সেই আবেগের তাড়নায় কিনা আমার চোখ দু’টো ভিজে গেল। দু’ফোটা পানি কপল বেয়ে গড়িয়েও পড়ল।


এগুলোতো আন্ডারওয়ারের ফুটো নয়। এগুলো আমার বাংলাদেশের ফুটো। আমার বাংলাদেশ আজ সহস্রাধিক ফুঁটো হয়ে গেছে।


শিক্ষক! এই মানুষগুলোকে আমরা বলি, মানুষ গড়ার কারিগর। অথচ এই কারিগরদের মাস গড়ালেই, সংসারের খরচের চাকা গড়ানোর চিন্তায় কপাল ভাঁজ করতে হয়। স্যার যখন ব্লাকবোর্ডে পীথাগোরাসের উপপাদ্য বোঝান ঠিক তখনই তার মনের কোনে সংসারের খরচের দুঃশ্চিন্তার বাদ্য বেজে ওঠে!


দেশের নাকি এতো এতো উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু আমাদের শিক্ষকদের কোন উন্নতি নেই। তাঁরা যে লাউ ছিলেন আজও সেই কদুই রয়ে গেছেন। মনে রাখা উচিত, যে জাতির শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির জন্য রাস্তায় নামতে হয়, সে জাতির ভাগ্যে আর যাই থাকুক, তাদের কখনো উন্নতি হতে পারে না। আর যাই হোক, তারা কখনো শ্রেষ্ঠ জাতি হতে পারবে না।

পঠিত : ৫৩৮ বার

মন্তব্য: ০