Alapon

ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতিতে মুসলমানদের অবদান



মুসলমানদের আগমনের পূর্বে ভারতীয়রা ছিল ভীষণ সঙ্কীর্ণ চিন্তার অধিকারী। বিশ্বের অন্যান্য জাতি সম্পর্কে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না এবং জানারও কারো আগ্রহ ছিল না। নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্যে তারা আবদ্ধ ছিল। তারা যেমন বহির্বিশ্বে প্রচার ও বিকাশমুখী ছিল না, তেমনি বাইরের কিছুকে গ্রহণও করতো না। এক প্রকার বিচ্ছিন্ন ও সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে ভারতীয় সংস্কৃতি ছিল স্থিত।

প্রখ্যাত ভারত তত্ত্ববিদ আল বিরুনী বলেন : ‘ভারতীয়দের অবিচল বিশ্বাস যে, ভারতই শ্রেষ্ঠ, ভারতীয়রাই শ্রেষ্ঠ জাতি, ভারতীয় রাজপুরুষরাই শ্রেষ্ঠ রাজন্যবর্গ, ভারতের ধর্মই শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানই শ্রেষ্ঠ জ্ঞান, শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান।’ ভারতীয় বিদ্বানমণ্ডলীর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি আরো লিখেছেন : জ্ঞান কার্পণ্য স্বভাব এমন কি স্বজাতির নিম্নবর্ণ থেকেও শাস্ত্র জ্ঞান সযত্নে তারা লুকিয়ে রাখে। সুতরাং ভিন্ন জাতির কথা বলাইবাহুল্য। পৃথিবীতে ভারত ছাড়া আরো দেশ আছে, আছে আরো বহু জাতি এবং তাদের রয়েছে বিভিন্ন শাস্ত্র ও শাস্ত্র জ্ঞান এটা তাদের কল্পনার বাইরে। এমন কি পারস্য ও খোরাশানের জ্ঞানীগুণীদের সম্পর্কেও তারা বিস্ময় জড়িত অজ্ঞতা প্রকাশ করে।

ভারতের কুম্ভকর্ণ এই দরজায় মুসলমানদের করাঘাত তাদের জন্যই কল্যাণই বয়ে আনে। তাদের সহস্র বছরের ভুল ভেঙে যায়। নতুন যুগে প্রবেশ করে ভারত। একজন প্রখ্যাত গবেষক তাই লিখেছেন : ভারতের সহিত মুসলমানদের সংশ্রবকালে ভারত একরূপ একক ও নিঃসঙ্গ জীবন-যাপন করিতেছিল। ভারতবাসী মনে করিতেন তাদের এ নিঃসঙ্গ জীবন পরিপূর্ণ জীবন। এই আত্মতৃপ্ত ও আত্মসমাহিত জীবনের ফাঁকে ফাঁকে যে অপরিপূর্ণতা বিরাজ করিতেছিল, তাহা তখনও ভারতবাসীর নিকট প্রকট হইয়া ধরা পড়ে নাই। ভারতে মুসলমানদের আগমনে, ভারতীয় সংস্কৃতির দুর্বলতা ভারতবাসীর নিকট প্রকট হইয়া ওঠে। মুসলিম সংস্কৃতিকে সম্মুখে উপস্থিত দেখিয়া তাহার সহিত তুলনামূলক আলোচনায় ভারতীয় মন মানস এই সময় হইতে আপন সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট ও স্বাভাবিকভাবেই সজাগ হইয়া উঠিতে থাকে। দ্বিতীয়তঃ মুসলমানদের আগমনেই ভারতের সহিত বহির্জগতের প্রকৃত যোগাযোগ সংস্থাপিত হয় এবং ভারতের নিঃসঙ্গতা ভাঙ্গিয়া পড়ে। প্রাচীনতম কাল হইতে অমূল্য ও অফুরন্ত প্রাকৃতিক ও শ্রমজাত সম্পদের অধিকারী হইলেও আপন নিঃসঙ্গতার জন্য এই সমস্ত সম্পদের বিষয় ভারত বিশেষভাবে অবহিত ছিল না। মুসলমান বণিকরাই ভারতের এই সম্পদ একদিকে স্বয়ং ভারতের নিকট এবং অন্যদিকে ইউরোপ ও আফ্রিকার নিকট পরিচিত করে দেন। এইরূপ ভারতের নিকট ভারতের পরিচয় এবং পরিচয়ের সঙ্গে জগতে তাহার প্রতিষ্ঠা ভারতীয় সংস্কৃতিতে মুসলমানেরই এই অপূর্ব অবদান।

মুসলমানদের সিন্ধু বিজয় সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। মুসলিম সংস্কৃতির উপর এ অভিযানের প্রভাব ছিল গভীর ও সুদূরপ্রসারী।

ব্রাহ্মণ্যবাদের নিষ্পেষণে, বৌদ্ধ ধর্মের কণ্ঠরোধ এবং নিম্নবর্ণ হিন্দুদের দুরবস্থা সিন্ধুতে মুসলিম আগমনকে উৎসাহিত করেছে। সিন্ধু বিজয়ের পরেই মুহাম্মদ বিন কাসিম শাসন পদ্ধতিতে মুসলমান বিজেতাদের চিরাচরিত রীতি অনুসরণ করেন। মুসলমান অধিকৃত সিন্ধুদেশের বিভিন্ন অংশ কতকগুলো বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। এছাড়া ভারতীয় হিন্দুদের পাশাপাশি বসবাসের ফলে মুসলমানগণ হিন্দু দর্শন, আয়ুর্বেদ শাস্ত্র, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, সঙ্গীত ও চিত্রশিল্পের জ্ঞান অর্জন করেছিল। মুসলমানদের মাধ্যমেই এই সব বিষয়ের জ্ঞান ইউরোপীয় দেশে বিস্তার লাভ করেছিল। বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে অবশিষ্ট যে সম্পর্ক মুসলমান এবং ভারতীয়দের মধ্যে চলছিল সিন্ধু বিজয়ের অব্যবহিত পর হতে তা দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত থাকে। উপমহাদেশে বাণিজ্যই ছিল মুসলমানদের প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র। এখানে বাণিজ্য ছাড়া ইসলামের প্রচার ছিল তাদের অন্যতম কর্ম। তাদের এখানে বসবাস এবং এ অঞ্চলের মানুষের সাথে মেলামেশার ফলে ভারতীয়দের নতুন নতুন অভিজ্ঞান লাভ হয়। এ সময় অনেক সুফী ভারতে আগমন করেন। তাঁদের চরিত্র মাহাত্ম্য সরল জীবন ধারা এবং ইসলামের শাশ্বত ও সাম্যবাদী জীবনধারার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকে মানুষ। মুসলমানদের রাজনৈতিক বিজয়ের পথ সুগম হতে থাকে। একাদশ শতকের একেবারে শুরুর দিকে যখন তুর্কি মুসলমানরা ভারত আগমন করে তখনো সুফীরা ভারতে ছিল। সুতরাং মূল ক্ষেত্রটা তারাই প্রস্তুত করেছিলেন। ভারত থেকেই বাংলার সুফীরা আগমন করেছিলেন। খ্রিস্ট্রিয় একাদশ-শতাব্দী থেকে ভারতে সুফী প্রভাব পড়েছিল এবং মুসলমানদের বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ভারতের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। সুফীদের আগমন যে আরো অনেক আগ থেকেই শুরু হয়েছিল এমন বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়। রোলান্তসন বলেন, সপ্তম শতাব্দীর শেষদিকে আরবরা মালাবার উপকূলে তাদের প্রথম বসতি স্থাপন করেন। সপ্তাম শতকের পরে পারসিক ও আরবীয় বণিকরা ভারতের পশ্চিম উপকূলের বিভিন্ন বন্দরে বিপুল সংখ্যায় বসতি স্থাপন করেন এবং স্থানীয় মেয়েদের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে শুরু করেন। একশ বছরের মধ্যেই তারা মালাবারে সুপ্রতিষ্ঠিত হন। তারা এখানে ভূমি লাভ ও প্রকাশ্যে ধর্ম পালনে অবাধ সুযোগ লাভ করেন। এই সুযোগে তাদের বিশ্বাসের অঙ্গ হিসেবে মুসলমানরা ধর্ম প্রচারেও ব্রতী হন। রক্ষণশীল হিন্দুরা এতে সারা দেয়। তাদের এই সারার পেছনে যে বড় কারণ ছিল তা হলো ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধর্মীয় মতবাদসমূহের মধ্যে সংঘাত চলছিল। হিন্দু মতবাদ আপন কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বৌদ্ধ ও জৈন মতবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিল। তাছাড়া রাজনৈতিকভাবেও সেটা ছিল স্থিতিহীনতা ও উত্থান পতনের কাল।

ভারতে মুসলমানদের রাজনৈতিক বিজয়ের পর পুরো ভারত মানস এক নতুন প্রেরণায় জেগে উঠে। মুসলিম বিজয় ভারতীয় সংস্কৃতির বিবর্তনে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। বাহ্যিকভাবে এর ফলে সবকিছু ওলট পালট হয়ে যায়। ইসলাম দেশগত বা জাতিগত ধর্ম নয়, তা সব মানুষের একমাত্র ধর্ম হবার স্পর্ধা রাখে। ভারতে ধর্মীয় সংস্কৃতির যে জঘন্য রূপ ধর্মীয় আধিপত্যবাদ ইসলামের সাম্য ও প্রগতিশীলতার কাছে তা মাথানত করে। একই ধর্মীয় অনুসারীদের মধ্যে যে কৌলিন্য ও ভেদপ্রথা বিদ্যমান ছিল তার প্রেক্ষিতে দলিতরা স্বভাবতই ইসলামী শিক্ষার সহায়তা লাভ করে। ইসলাম কোনো বিশেষ জাতির ধর্ম নয়, প্রচারশীল ধর্ম। ইহা অন্যকে জয়করেই ক্ষান্ত হয় না, কোলে টেনে নেয়। তাই ইসলামের বিজেতা ও বিজাতীয় প্রচারকের দল ভারতে জনগণকে বিন্দুমাত্রও অবজ্ঞা করেনি। এ জন্য দলিত হিন্দুরা সহজেই ইসলামের ছায়াতলে স্থান নিল। শত জাতপাতের দঙ্গল ডিঙ্গিয়ে একই কাতারে সবাই শামিল হলো। এ যেনো এক অদ্ভূত পুনর্জাগরণ। প্রচণ্ড মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত হ্যাভেল তাঁর Aryan Rule in India গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন : ‘হিন্দুসমাজ জীবনে মুসলমান রাজনৈতিক মতবাদের ফল ফলেছে দু’ রকমে, জাতিভেদের গোঁড়ামিকে এ যেমন একদিকে শক্ত করেছে তেমনি তার বিরুদ্ধেও সৃষ্টি করেছে এক বিদ্রোহ। হিন্দু সমাজের নিম্নস্তরের চোখের সামনে তা এঁকেছে এক প্রলুব্ধকর ভবিষ্যতের ছবি, শূদ্রকে এনে দিয়েছে মুক্ত মানুষের অধিকার আর ব্রাহ্মণদের উপরেও প্রভুত্ব করার ক্ষমতা। ইউরোপের পুনর্জাগরণের মতো চিন্তা জড়তে এও তুলেছে তরঙ্গাভিঘাত, জন্ম দিয়েছে অগণিত দৃঢ় মানুষের আর অনেক মৌলিক প্রতিভার। পুনর্জাগরণের মতোই এও ছিল আসলে এক পৌর আদর্শ মোটের উপর এরই ফলে গড়ে ওঠলো বাঁচার আনন্দে পরিপূর্ণ এক বিরাট মানবতা।’

তাঁর সাথে সুর মিলিয়েই প্রখ্যাত, র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট, কম্যুনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতা কমরেড এম এন রায় লিখেন : ইসলামের সমাজ ব্যবস্থা ভারতীয় জনগণের সমর্থন লাভ করলো, তার কারণ পেছনের জীবনের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, হিন্দু দর্শনের চাইতে তা ছিল শ্রেয়; কেন না হিন্দু দর্শন সমাজদেহে এনেছিল বিরাট বিশৃঙ্খলা আর ইসলামই তা থেকে ভারতীয় জনসাধারণকে মুক্তির পথ দেখায়।’

ভারতীয় সভ্যতায় মুসলিম সংশ্লিষ্টতার অনেক বৈশিষ্ট্য আষ্টেপৃষ্টে জড়িত। আগে ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় একটিমাত্র রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল না। হিন্দু শাসিত সম্রাজ্যগুলো ছিল কয়েকটি স্বাধীন প্রদেশের সমষ্টি। এদের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক ও সামাজিক জাতীয়তা ছিল না। ভাষা ও শাসনপদ্ধতির কোনো ঐক্য ছিল না। অথচ বাদশাহ আকবর হতে মুহাম্মদ শাহ পর্যন্ত (১৫৫৬-১৭৪৯) শাসনামলে উত্তর ভারত ও দাক্ষিণাত্যের অধিকাংশ স্থানে এক সরকারি ভাষা একই শাসন পদ্ধতি ও একক মুদ্রা প্রবর্তিত হয়। সর্বশ্রেণী লোকের মধ্যে একই জনপ্রিয় মিশ্র ভাষার সৃষ্টি হয়। শাহী সম্রাজ্যের বিশটি সুবা একই শাসনযন্ত্রের সাহায্যে একই রীতিতে শাসিত হতো। সমস্ত সরকারি দলিল দস্তাবেজ, পাট্টা, সনদ ফরমান, চিঠিপত্র, রশিদ ফারসীতে লিখিত হতো। সাম্রাজ্যের একই মুদ্রানীতি, মুদ্রার একই নাম ও আকার ছিল। সুতরাং এই বিশাল রাষ্ট্রের যে কোথাও গেলে বুঝা যেতো এটা একটি কেন্দ্রীয় শাসনাধীন রাষ্ট্র। সর্বভারতীয় শাসন কাঠামো এই প্রথম একটি শক্তিশালী আধুনিক ভিত্তি লাভ করে। পূর্ববর্তী যুগের রাষ্ট্রের কেন্দ্রহীন ভারতীয় সমাজের উপর তারা স্থাপন করেন নিজেদের এক শাসনব্যবস্থা। মুসলিম রাজ্যের উজীর, কাজী, মুন্সী প্রভৃতি আমলাদের নাম ও পদবী এবং রাজপথে ব্যবহৃত ফারসী ভাষাই ক্রমে দেশীয় শাসনের ধারা হয়ে উঠে। হিন্দু রাজ্যেও তা গৃহীত হয়। ঠিক এইরূপে রাজপুরুষদের ও অভিজাতদের আদব কায়দা, খেতাব খেলাত, উর্দি, কুর্তা প্রভৃতি ও মুসলমানদের নিকট থেকে ভারতীয়রা লাভ করে, তা আজো ভারতের হিন্দু মুসলমান সকলের দরবারী পোশাক ও কায়দা-কানুন।

ভারতীয় সাহিত্য মুসলমানদের কাছে চিরঋণী। বিজেতারা অন্যভাষী হলেও স্থানীয় ভাষাকে প্রথম রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। বাংলা হিন্দি প্রভৃতি ভাষাকে শক্ত ভিত্তি ও সাহিত্যিক রূপ প্রদানে তাদের অবদান নিয়ে অনেক গ্রন্থও রচিত হয়েছে। গোপাল হালদার লিখেছেন : ইহাদের আসরে দেশীয় ভাষাগুলোর আদর বাড়িল। তাই সাধারণ লোকের সাহিত্য এইবার রূপলাভ করিতে লাগিল, ভারতবাসীর সাহিত্য সৃষ্টি আর প্রধানত দোভাষায় আবদ্ধ রহিল না। এইভাবে বাংলা হিন্দি প্রভৃতি বর্তমান ভারতীয় ভাষাগুলো এই সময়েই প্রথম সৃষ্টি লাভ করিল। বাংলায় ইহার প্রমাণ পরাগল খাঁ ও ছুটি খাঁ মহাভারত লেখানো। বস্তুত হুসেন শাহের সভাতে বাংলা কাব্যের পুষ্টি, বাংলা আমলা মুন্সী প্রভৃতি ফারসী জানা কায়স্থ, ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, ভদ্রলোকদের মধ্যবিত্তদের তাহা জন্মধাম। তাহার পরে আকবরের পরবর্তী মুঘল যুুগ এবং চৈতন্যযুগও বিচিত্র যুগ। এদিকে পাঠান যুগেই হিন্দিতে আমরা পাই মালিক মুহাম্মদ জৈসীর ‘পদ্মাবৎ’ কবীরের দোহাবলী আর তুলসীদাসের রামরচিত মানস মুঘল যুগের প্রশস্ত অবকাশে এই সকল ভাষা ক্রমে ক্রমে প্রকৃত সাহিত্যিক রূপলাভ করিয়াছে। বাংলাভাষার বিকাশে মুসলমানদের যে অবদান তাহা অবিস্মরণীয়। হিন্দু শাস্ত্রজ্ঞরা যেখানে এই ভাষা চর্চাকারীকে নরকবাসী হওয়ার কারণ মনে করিতেন সেখানে মুসলিম পরিপোষকতায় এ ভাষা নতুন প্রাণ ফিরে পায়। মুসলমান সম্রাট ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্যই রাজদ্বারে দীনহীন বঙ্গভাষার প্রথম আহ্বান পড়িয়াছিল। গৌড়েশ্বরগণ যে ভাষাকে উৎসাহ প্রদান করিলেন হিন্দু রাজাগণ তাহাকে আগ্রাহ্য করিতে পারিলেন না।’

ইতিহাস সাহিত্যে ভারতীয়দের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। কাল নিরূপণ শাস্ত্রে হিন্দুদের জ্ঞান ছিল অত্যন্ত অসম্পূর্ণ। মুসলিম শাসনের পূর্বে তারা আদৌ কোনো প্রকৃত ইতিহাস রচনা করেনি। সংস্কৃত ভাষায় মাত্র চারটি রাজনৈতিক জীবন বৃত্তান্ত রক্ষিত আছে যা অত্যন্ত অগোছালো ও সন তারিখহীন। বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম পুরোধা মুসলমানরা প্রথম ভারতীয় ইতিহাসকে একটি সুসংবদ্ধ রূপ প্রদান করেন এবং ইতিহাস রচনার প্রতি প্রকৃত পথ দেখান।

স্থাপত্যে মুসলমানদের বিস্ময়কর কাজ হয়েছিল ভারতে। আজো সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম তাজমহলসহ শত শত স্থাপতশৈলী কালের গৌরব গাঁথা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভারতের রাজনীতি, শাসনপদ্ধতি, সমাজব্যবস্থা, অর্থনীতি, শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে মুসলমানদের অবদান কতভাবে যে যুক্ত হয়ে আছে তা এ ুদ্র পরিসরে বর্ণনা অসম্ভব। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, অনেক ভারতীয় ইতিহাস লেখক মুসলিম যুগকে নানাভাবে হেয়প্রতিপন্ন করেছেন। এমন কি কেউ কেউ এ যুগের নতুন সংস্কৃতির উপাদানগুলোকে বিতর্কিত করেছেন এবং করেছেন অস্বীকারও। এটি তাদের জঘন্য হীনম্মন্যতার বহিঃপ্রকাশ।

বিশ্ববিখ্যাত মানবতাবাদী ও সুদক্ষ প্রভাবশালী কয়েকজন মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে কালিমা লেপনেও এরা পিছপা হননি। তবে সত্যসন্ধানী কিছু গবেষক প্রকৃত ইতিহাস উন্মোচন করেছেন। তাঁদের গবেষণা ও লিখনী প্রকৃত ইতিহাস উন্মোচন থেকে সঠিক বক্তব্যকে আলোকিত করেছে। ভারতীয় কিছু অসাধু ইতিহাস লেখকদের এই ধৃষ্টতার প্রতি ইঙ্গিত করে ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক খুশবন্ত সিংহ লিখেছেন। আমাদের মুসলিম শাসকগোষ্ঠীর প্রতি আমাদের ইতিহাস ও পাঠ্যপুস্তকগুলো যে কতদূর অসাধু হয়েছে, বর্তমান প্রজন্ম তা সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারে না। তারা অধিকাংশ হিন্দু খাদক, বিগ্রহ, সংহারক ও তরবারির সাহায্যে ধর্মান্তকারীরূপে চিত্রিত। আমি যদি আপনাদের বলি যে, এই কালো চিত্রগুলো সত্যের বিকৃতি, মুসলিম অবিশ্বাসকে চিরস্থায়ী করার জন্য ভেবেচিন্তে মিথ্যা উদ্ভাবন করা হয়েছে, তাহলে আপনাদের অধিকাংশই আমাকে বিশ্বাস করবেন না। কাজেই আমি আপনাদের সুপারিশ করি, ‘ইসলাম এন্ড ইন্ডিয়ান কালচার’ শিরোনামে প্রকাশিত উড়িষ্যার রাজ্যপাল বিএন পান্ডে প্রদত্ত তিনটি বক্তৃতায় একখানি সঙ্কলনের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিন।’

ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে আজও যে দ্বন্দ্ব অবিশ্বাস তা প্রধানত তাদের হীনম্মন্যতা ও গোঁড়ামীর ফসল। কম্যুনিজমের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও লেলিনের সহচর এম এন রায় লিখেছেন : শত শত বৎসরব্যাপী দুটো সম্প্রদায় একসঙ্গে একই দেশে বসবাস করলো অথচ পরস্পরের সভ্যতা সংস্কৃতি সহানুভূতির সঙ্গে বুঝবার চেষ্টা করলো না, পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যি এমন দৃষ্টান্ত আর মেলে না। পৃথিবীর কোনো সভ্য জাতিই ভারতীয় হিন্দুদের মতো ইসলামের ইতিহাস সম্বন্ধে এমন অজ্ঞ নয় এবং ইসলাম সম্বন্ধে এমন ঘৃণার ভাবও পোষণ করে না।

~আব্দুল হালীম খাঁ

পঠিত : ৮৬৩ বার

মন্তব্য: ০