Alapon

আলী রা.-এর শাহদাত ও আমাদের দুর্গতি



আজ ২৯ জানুয়ারি। মুসলিমদের খুব দুঃখের দিন। এই দিন ইসলামী খিলাফতের পতন হয়েছে। এই পতন কোনো বিধর্মীদের হাতে হয়নি। মুসলিমরা নিজেরাই খিলাফত ধ্বংস করে দিয়ে বংশীয় মুলুকিয়াত বা রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে।

এখন থেকে ১৩৬১ বছর আগের কথা। আজকের এই দিনে ৬৬১ সালে আলী ইবনে আবি তালিব রা. শাহদাতবরণ করেন। ২৭ জানুয়ারি তিনি কুফার শাহী মসজিদে বিষাক্ত তরবারির আঘাতে আহত। দু'দিন পর ২৯ জানুয়ারি তিনি প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান।

৬৫৬ সালে হযরত উসমানের রা.-এর শাহাদাতের পর বিদ্রোহীরা হযরত তালহা, যুবাইর ও আলীকে রা. খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য চাপ দেয়। প্রত্যেকেই অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে অস্বীকৃতি জানান। বিভিন্ন বর্ণনার মাধ্যমে জানা যায়, হযরত আলী রা. বার বার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে থাকেন। অবশেষে মদীনাবাসীরা হযরত আলীর রা. কাছে গিয়ে বলেন, খিলাফতের এ পদ এভাবে শূণ্য থাকতে পারে না। বর্তমানে এ পদের জন্য আপনার চেয়ে অধিক উপযুক্ত ব্যক্তি নেই। আপনিই এর হকদার।

মানুষের পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত তিনি খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হন। তবে শর্ত আরোপ করেন যে, আমার বাইয়াত গোপনে হতে পারবে না। এজন্য সর্বশ্রেণীর মুসলমানের সম্মতি প্রয়োজন। মসজিদে নববীতে সাধারণ সভা হলো। মাত্র ষোল অথবা সতেরো জন সাহাবা ছাড়া সকল মুহাজির ও আনসার আলীর রা. হাতে বাইয়াত করেন।

অত্যন্ত জটিল এক পরিস্থিতির মধ্যে হযরত আলীর রা. খিলাফতের সূচনা হয়। খলীফা হওয়ার পর তাঁর প্রথম কাজ ছিল হযরত উসমানের রা. হত্যাকারীদের শাস্তি বিধান করা। কিন্তু কাজটি সহজ ছিল না।

প্রথমতঃ হত্যাকারীদের কেউ চিনতে পারেনি। হযরত উসমানের স্ত্রী হযরত নায়িলা হত্যাকারীদের দেখেছিলেন। কিন্তু তিনি তাদের কাউকে চিনতে পারেননি।

দ্বিতীয়তঃ মদিনা তখন হাজার হাজার বিদ্রোহীদের কব্জায়। তারা হযরত আলীর রা. সেনাবাহিনীর মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু তাঁর এই অসহায় অবস্থা তৎকালীন অনেক মুসলমানই উপলব্ধি করেননি। তাঁরা হযরত আলীর রা. নিকট তক্ষুনি হযরত উসমানের রা. ‘কিসাস’ দাবী করেন। এই দাবী উত্থাপনকারীদের মধ্যে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা রা. সহ তাল্‌হা ও যুবাইরের রা. মত বিশিষ্ট সাহাবীরাও ছিলেন।

তাঁরা হযরত আয়িশার রা. নেতৃত্বে সেনাবাহিনী সহ মক্কা থেকে বসরার দিকে যাত্রা করেন। সেখানে তাঁদের সমর্থকদের সংখ্যা ছিল বেশী। আলীও রা. তাঁর বাহিনীসহ সেখানে পৌঁছেন। বসরার উপকণ্ঠে বিরোধী দুই বাহিনী মুখোমুখি হয়। হযরত আয়িশা রা. আলীর রা. কাছে তাঁর দাবী পেশ করেন। আলীও রা. তাঁর সমস্যাসমূহ তুলে ধরেন। যেহেতু উভয় পক্ষেই ছিল সততা ও নিষ্ঠা তাই নিষ্পত্তি হয়ে যায়।

হযরত তালহা ও যুবাইর ফিরে চললেন। আয়িশাও ফেরার প্রস্তুতি শুরু করলেন। কিন্তু হাংগামা ও অশান্তি সৃষ্টিকারীরা উভয় বাহিনীতেই ছিল। তাই আপোষ মীমাংসায় তারা ভীত হয়ে পড়ে। তারা সুপরিকল্পিতভাবে রাতের অন্ধকারে এক পক্ষ অন্য পক্ষের শিবিরে হামলা চালিয়ে দেয়। ফল এই দাঁড়ায়, উভয় পক্ষের মনে এই ধারণা জন্মালো যে, আপোষ মীমাংসার নামে ধোঁকা দিয়ে প্রতিপক্ষ তাঁদের ওপর হামলা করে বসেছে। পরিপূর্ণ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আলীর রা. জয় হয়। তিনি বিষয়টি হযরত আয়িশাকে রা. বুঝাতে সক্ষম হন। আয়িশা রা. বসরা থেকে মদীনায় ফিরে যান।

যুদ্ধের সময় আয়িশা উটের ওপর সওয়ার ছিলেন। ইতিহাসে তাই এ যুদ্ধ ‘উটের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। হিজরী ৩৬ সনের জামাদিউস সানী মাসে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আশারায়ে মুবাশ্‌শারার সদস্য হযরত তাল্‌হা ও যুবাইরসহ উভয় পক্ষে বহু মুসলমান শহীদ হন। হযরত আলী রা. পনের দিন বসরায় অবস্থানের পর কুফায় চলে যান। রাজধানী মদীনা থেকে কুফায় স্থানান্তরিত হয়।

এই উটের যু্দ্ধ ছিল মুসলমানদের প্রথম আত্মঘাতী সংঘর্ষ। অনেক সাহাবী এ যুদ্ধে কোন পক্ষেই যোগদান করেননি। এই আত্মঘাতী সংঘর্ষের জন্য তাঁরা ব্যথিতও হয়েছিলেন। আলীর রা. বাহিনী যখন মদীনা থেকে রওয়ানা হয়, মদীনাবাসীরা তখন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন।

হযরত আয়িশার রা. সাথে তো একটা আপোষরফায় আসা গেল। কিন্তু সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়ার রা. সাথে কোন মীমাংসায় পৌঁছা গেল না। হযরত আলী রা. তাঁকে সিরিয়ার গভর্ণর পদ থেকে বরখাস্ত করেন। হযরত মুয়াবিয়া রা. বেঁকে বসলেন। আলীর রা. নির্দেশ মানতে অস্বীকার করলেন। তাঁর বক্তব্যের মূলকথা ছিল, ‘উসমান রা. হত্যার কিসাস না হওয়া পর্যন্ত তিনি আলীকে রা. খলীফা বলে মানবেন না।’

হিজরী ৩৭ সনের সফর মাসে ‘সিফ্‌ফীন’ নামক স্থানে হযরত আলী ও হযরত মুয়াবিয়ার রা. বাহিনীর মধ্যে এক সংঘর্ষ ঘটে যায়। এ সংঘর্ষ ছিল উটের যুদ্ধ থেকেও ভয়াবহ। উভয় পক্ষে হাজার হাজার মুসলমান শাহাদাত বরণ করেন। তাঁদের মধ্যে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত ’আম্মার বিন ইয়াসীর, খুযাইমা ইবন সাবিত, ও আবু আম্মারা আল-মাযিনীও ছিলেন। তাঁরা সকলেই আলীর রা. পক্ষে মুয়াবিয়ার রা.-এর বাহিনীর হাতে শহীদ হন।

উল্লেখ্য যে, আম্মার বিন ইয়াসির সম্পর্কে রাসূল সা. বলেছিলেনঃ ‘আফসুস, একটি বিদ্রোহী দল আম্মারকে হত্যা করবে।’ (সহীহুল বুখারী) সাতাশ জন প্রখ্যাত সাহাবী এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হযরত মুয়াবিয়াও হাদীসটির একজন বর্ণনাকারী। অবশ্য হযরত মুয়াবিয়া রা. হাদীসটির ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এত কিছুর পরেও বিষয়টির ফায়সালা হলো না।

সিফ্‌ফীনের সর্বশেষ সংঘর্ষে, যাকে ‘লাইলাতুল হার’ বলা হয়, হযরত আলীর রা. জয় হতে চলেছিল। হযরত মুয়াবিয়া রা. পরাজয়ের ভাব বুঝতে পেরে পবিত্র কুরআনের মাধ্যমে মীমাংসার আহ্‌বান জানালেন। তাঁর সৈন্যরা বর্শার মাথায় কুরআন ঝুলিয়ে উঁচু করে ধরে বলতে থাকে, এই কুরআন আমাদের এ দ্বন্দ্বের ফায়সালা করবে। যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হলো। হযরত আলীর রা. পক্ষে আবু মুসা আশয়ারী রা. এবং হযরত মুয়াবিয়ার রা. পক্ষে হযরত ‘আমর ইবনুল ‘আস হাকাম বা সালিশ নিযুক্ত হলেন।

সিদ্ধান্ত হলো, এই দুইজনের সম্মিলিত ফায়সালা বিরোধী দু’পক্ষই মেনে নেবেন। ‘দুমাতুল জান্দাল’ নামক স্থানে মুসলমানদের বড় আকারের এক সম্মেলন হয়। কিন্তু সব ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণ করলে যে সিদ্ধান্তটি পাওয়া যায় তা হলো, হযরত ‘আমর ইবনুল আস রা. হযরত আবু মুসা আশয়ারীর রা. সাথে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, শেষ মুহূর্তে তা থেকে সরে আসায় এ সালিশী বোর্ড ‍শান্তি স্থাপনে ব্যর্থ হয়। দুমাতুল জান্দাল থেকে হতাশ হয়ে মুসলমানরা ফিরে গেল। অতঃপর আলী রা. ও মুয়াবিয়া রা. অনর্থক রক্তপাত বন্ধ করার লক্ষ্যে সন্ধি করলেন। এ দিন থেকে মূলতঃ মুসলিম খিলাফত দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়।

এসময় ‘খারেজী’ নামে নতুন একটি দলের জন্ম হয়। প্রথমে তারা ছিল আলী সমর্থক। কিন্তু পরে তারা এ বিশ্বাস প্রচার করতে থাকে যে, দ্বীনের ব্যাপারে কোন মানুষকে ‘হাকাম’ বা সালিশ নিযুক্ত করা কুফরী কাজ। আলী রা. আবু মুসা আশয়ারীকে রা. ‘হাকাম’ মেনে নিয়ে কুরআনের খেলাফ কাজ করেছেন। সুতরাং হযরত আলী তাঁর আনুগত্য দাবী করার বৈধতা হারিয়ে ফেলেছেন। তারা হযরত আলী থেকে পৃথক হয়ে যায়। তারা ছিল অত্যন্ত চরমপন্থী। তাদের সাথে আলীর রা. একটি যুদ্ধ হয় এবং তাতে বহু লোক হতাহত হয়। এটি নাহরাওয়ান যুদ্ধ নামে পরিচিত।

এই খারেজী সম্প্রদায়ের তিন ব্যক্তি আবদুর রহমান মুলজিম, আল-বারাক ইবন আবদিল্লাহ ও ‘আমের ইবন বকর আত-তামীমী, নাহরাওয়ানের যুদ্ধের পর এক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়। দীর্ঘ আলোচনার পর তারা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, মুসলিম উম্মার অন্তর্কলহের জন্য দায়ী মূলতঃ আলী, মুয়াবিয়া ও ’আমর ইবনুল আস রা.। সুতরাং এ তিন ব্যক্তিকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে।

সিদ্ধান্ত মুতাবিক মুলজিম দায়িত্ব নিল আলীর রা. এবং আল-বারাক ও ‘আমর দায়িত্ব নিল যথাক্রমে মুয়াবিয়া ও ‘আমর ইবনুল আসের রা.। তারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, মারবে নয় তো মরবে। হিজরী ৪০ সনের ১৭ রমজান ফজরের নামাযের সময়টি এ কাজের জন্য নির্ধারিত হয়। অতঃপর ইবন মুলজিম কুফা, আল-বারাক দিমাশ্‌ক ও ’আমর মিসরে চলে যায়।

হিজরী ৪০ সনের ১৬ রমজান শুক্রবার দিবাগত রাতে আততায়ীরা আপন আপন স্থানে ওৎ পেতে থাকে। ফজরের সময় হযরত আলী রা. অভ্যাসমত আস-সালাত বলে মানুষকে নামাযের জন্য ডাকতে ডাকতে যখন মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন, পাপাত্মা ইবন মুলজিম শাণিত তরবারি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁকে আহত করে। আহত অবস্থায় আততায়ীকে ধরার নির্দেশ দিলেন। সন্তানদের ডেকে অসীয়াত করলেন। চার বছর নয় মাস খিলাফত পরিচালনার পর ২৯ জানুয়ারি কুফায় শাহাদাত বরণ করেন।

একই দিন একই সময় হযরত মুয়াবিয়া যখন মসজিদে যাচ্ছিলেন, তাঁরও ওপর হামলা হয়। কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। তিনি সামান্য আহত হন। অন্য দিকে ‘আমর ইবনুল আস অসুস্থতার কারণে সেদিন মসজিদে যাননি। তার পরিবর্তে পুলিশ বাহিনী প্রধান খারেজ ইবন হুজাফা ইমামতির দায়িত্ব পালনের জন্য মসজিদে যাচ্ছিলেন। তাঁকেই ‘আমর ইবনুল আস মনে করে হত্যা করা হয়। এভাবে মুয়াবিয়া ও ‘আমর ইবনুল ’আস রা. প্রাণে রক্ষা পান।

হযরত আলীর রা. নামাযে জানাযার ইমামতি করেন হযরত হাসান ইবন আলী রা.। কুফা জামে’ মসজিদের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়। তবে অন্য একটি বর্ণনা মতে নাজফে আশরাফে তাঁকে সমাহিত করা হয়। ‍মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।

আততায়ী ইবন মুলজিমকে ধরে আনা হলে আলী রা. নির্দেশ দেনঃ ‘সে কয়েদী। তার থাকা-খাওয়ার সুব্যবস্থা করো। আমি বেঁচে গেলে তাঁকে হত্যা অথবা ক্ষমা করতে পারি। যদি আমি মারা যাই, তোমরা তাকে ঠিক ততটুকু আঘাত করবে যতটুকু সে আমাকে করেছে। তোমরা বাড়াবাড়ি করো না। যারা বাড়াবাড়ি করে আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন না।’ (তাবাকাতঃ ৩/৩৫)

আজকের এই দিনে আলী রা. শাহদাতবরণ করেন। সেই সাথে পৃথিবী হারিয়ে ফেলে ইসলামী খিলাফত। সেই খিলাফত মাঝেমধ্যে একটু আধটু ধরা দিলেও সামগ্রিকভাবে অধরাই থেকে গেলো। ৬২২ সালে প্রতিষ্ঠিত খিলাফত ৬৬১ সাল পর্যন্ত মাত্র ৩৯ বছর টিকেছিলো।

পঠিত : ৩৯৯ বার

মন্তব্য: ০