Alapon

জানাযার নামাজে আপত্তির সামাজিক প্রভাব



রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনো এক সাহাবী চ্যাপ্টা তীরের আঘাতে আত্মহত্যা করেন। তার লাশ রাসূলুল্লাহর কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। রাসূলুল্লাহ মৃত্যুর কারণ যখন জানতে পারলেন আত্মহত্যা, তখন আর তার জানাযা পড়লেন না।
তবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে জানাযা না পড়লেও সাহাবীদেরকে পড়তে বলেন। ফলে, সাহাবীরা সেই আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়েন।
আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির জানাযা না পড়ার ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থান যতোটা না রিলিজিয়াস অবস্থান ছিলো, তারচেয়ে বেশি ছিলো সোশ্যাল। এর মাধ্যমে তিনি সমাজে একটি ম্যাসেজ দিলেন- 'পরবর্তীতে তোমাদের কেউ যদি আত্মহত্যা করে, আমি তার জানাযা পড়বো না'।
সাহাবীদের মধ্যে যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বে ইন্তেকাল করেন, তাদের কতো সৌভাগ্য যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে তাদের অনেকের জানাযা পড়ান।
বিপরীতে, কেউ যদি জানতে পারে, সে আত্মহত্যা করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জানাযা পড়তে আপত্তি জানাবেন, তাহলে তো সেটা তার জন্য বিব্রতকর। তার মৃত্যুর সামাজিক স্বীকৃতি দেয়া হবে না, তার মৃত্যুর কথা কেউ মনে করলে প্রশংসা তো করবেই না, উল্টো ধিক্কার জানাতে পারে।
মনে করুন, আপনার এলাকার মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল/মুহতামিম আপনাদের সবার প্রিয়। এলাকার লোকজন মারা গেলে তিনি জানাযা পড়ান। তিনি একদিন জানাযা পড়াতে এসে শুনলেন লোকটি মদ্যপায়ী/সুদখোর মহাজন/চোর/ডাকাত ছিলো। ফলে, তিনি জানাযা পড়ানোর একটু আগে বলে উঠলেন, "আপনারা কেউ জানাযা পড়ান, আমি এমন লোকের জানাযা পড়াবো না।"
একজন খারাপ লোক মারা গেলো, এটা নিয়ে যতোটা না আলোচনা হবে, তারচেয়ে বেশি আলোচনা হবে প্রিন্সিপাল/মুহতামিমের এমন লোকের জানাযা পড়াননি এই নিয়ে। ফলে, সেই প্রিন্সিপাল/মুহতামিম সমাজে একটি ম্যাসেজ দিয়ে দিলেন- 'আমি সবার জানাযা পড়াই না! সারাজীবন চুরি-বদমায়েশী করবেন, আর মারা গেলে বলবেন জানাযা পড়াতে; আমি পারবো না। অন্য কাউকে দিয়ে পড়ান'।
আমরা অনেকেই মনে করি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মনে হয় শুধুমাত্র আত্মহত্যাকারীর জানাযা পড়তে নিজে আপত্তি জানিয়েছেন। এমনটা না। যারা ঋণ রেখে যায় মারা যেতো এবং সেগুলো আদায় করার মতো অর্থ থাকতো না, তিনি তাদের জানাযাও পড়তেন না।
একবার একজন সাহাবী ইন্তেকাল করেন। তিনি ৩ দিনার ঋণ রেখে ইন্তেকাল করেন, ঋণ আদায়ের অর্থ তার ছিলো না। ফলে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদেরকে বললেন, "তোমরা তার জানাযা পড়ে নাও (আমি পড়বো না)।"
তখন আবু কাতাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু মৃত ঋণগ্রস্ত সাহাবীর ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব নেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার জানাযা পড়ান।
ঋণগ্রস্তের জানাযা না পড়ার পেছনের কারণটিও সামাজিক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সমাজে বার্তা পৌঁছে দিলেন- 'কেউ যেনো ঋণগ্রস্ত অবস্থায় ইন্তেকাল না করে। ইন্তেকালের আগমুহূর্তে হলেও ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে যায়'।
পরবর্তীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঋণগ্রস্ত সাহাবীদের ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা তিনি নিজেই করতেন। ততোদিনে মদীনা রাষ্ট্রে আর্থিক অবস্থার বেশ উন্নতি হয়।
সমাজের প্রভাবশালী কোনো আলেম যখন কারো বা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীর জানাযা পড়তে আপত্তি জানান, সেটার বড়ো একটি প্রভাব সমাজে পড়ে।
খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর রাহিমাহুল্লাহ সৌদি আরব থেকে পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরেন। এলাকার মানুষের কাছে তিনি তখন বেশ সম্মানিত, জনপ্রিয়।
তিনি তখন ঘোষণা দিলেন, তাঁর এলাকার বেনামাজীদের জানাযা তিনি পড়বেন না, অন্যরা পড়তে পারে।
এলাকার একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি যদি কারো জানাযা পড়তে আপত্তি জানান, সেটার প্রভাব এলাকায় পড়ে।
ফলে দেখা যায়, নিজেদের মৃত্যুর পরও অপমানিত না হবার জন্য, বিব্রত অবস্থায় না পড়তে অনেকেই নামাজ পড়া শুরু করে।
-----
জানাযার নামাজে আপত্তির সামাজিক প্রভাব
- আরিফুল ইসলাম
৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২

পঠিত : ২৮৪ বার

মন্তব্য: ০