Alapon

অর্থ-সম্পদ সম্পর্কে ইসলামের মূল দর্শন




ওয়াজ নসিহত সবার আগে আমার জন্য, শুধুমাত্র মানুষকে করার জন্য নয়। এটা মনে হয় আমরা বেশিরভাগ বক্তা ভুলে গেছি। আমরা হুজুরদের কথায় মানুষ হেদায়াত না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, "আমরা মানুষকে বলি তোমরা দুনিয়া ছেড়ে দাও, টাকা টাকা কোর না সারাদিন, আল্লাহ মূখী হও, আখিরাতমূখী হও, দুনিয়ার জন্য পাগল হয়ে যেও না। অল্প আহার, এক গ্লাস পানি ও দুটো খেজুর এবং কুঁড়েঘরের কাহিনী শুনাই আমরা সারাদিন"। অথচ আমরা নিজেরাই সারাদিন থাকি টাকার ধান্দায়। হাদিয়া সামান্য কম দিলে মন খারাপ হয়ে যায় আমাদের। সেখানে এর পরের বছর আর দাওয়াত রাখি না। খেতে বসলে এমনভাবে খাই যে শ্বাস নেয়ার জায়গাও খালি রাখি না। মাদ্রাসা মসজিদের নামে টাকা কালেকশন করে অনেক হুজুর কোটিপতি হয়ে গেছেন, কিন্তু মাদ্রাসা মসজিদের উন্নতি হয়নি, এমন নজির ভুরি ভুরি আছে। মানুষকে আমরা বলি আল্লাহর রাস্তায় দান কর, জাকাত দাও, গরীব মিসকিন ইয়াতিম অসহায়দের জন্য খরচ কর। অথচ বেশিরভাগ হুজুর নিজেরা ফরজ জাকাত পর্যন্ত সঠিকভাবে হিসাব করে আদায় করেন না। মানুষকে নফল দান সদকা করা তো দূরে থাক।
এমনকি টাকা উপার্জনের যে সঠিক দর্শন ইসলাম দিয়েছে আমাদেরকে সেটাও তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা মানুষের সামনে।
ইসলাম টাকা উপার্জনকে কখনোই অনুৎসাহিত করে না৷ বরং হারাম পথে টাকা উপার্জনকে অনুৎসাহিত করে। বৈধ পথে কেউ যদি বিলিওনেয়ার হতে পারে এটাকে উৎসাহিত করে ইসলাম। কারণ কুরআন মাজিদে ধন-সম্পদকে খায়র বা কল্যাণ, নিয়ামত বলা হয়েছে, অকল্যাণ বা শার বলা হয়নি। "ওয়া ইন্নাহু লিহুব্বিল খাইরি লাশাদিদ"
وَإِنَّهُ لِحُبِّ الْخَيْرِ لَشَدِيدٌ
এবং সে নিশ্চিতই ধন-সম্পদের ভালবাসায় মত্ত। (১০০ঃ৮).
ধন-সম্পদ তখনি অকল্যাণকর হবে যখন মানুষ তা অবৈধ পথে উপার্জন করবে এবং অবৈধ কাজে তা খরচ করবে। হালাল হারামের বাছ বিচার যখন করবে না মানুষ। যখন দুনিয়া পেতে গিয়ে ফরজ নামাজের জন্য মানুষের হাতে সময় থাকবে না, আল্লাহর হক ও বান্দার হক নষ্ট করবে তখন ধন সম্পদ অকল্যাণকর। যখন সে কোটিপতি হয়েও হিসাব করে জাকাত আদায় করবে না, মানুষকে নফল দান সদকা করবে না, টাকা জমাতেই থাকবে, জমাতেই থাকবে কিন্তু উম্মতের জন্য তার টাকা খরচ করতে মন চাইবে না, তখন সম্পদ অকল্যাণের। বৈধ পথে কোটিপতি হওয়াকে ইসলাম এনকারেজ করেছে। কারণ ইসলাম জাকাত দিতে বলেছে, জাকাত খেতে বলে নাই। আর জাকাত দিতে হলে আগে আপনার জাকাত দেয়া পরিমাণ সম্পদের মালিক তথা সাহিবুন নিসাব হতে হবে আপনাকে।
বুখারির সহিহ হাদিস হজরত সা'দ ইবনে আবি ওয়াকাস রা. যখন প্রচন্ড অসুস্থ অবস্থায় তাঁর সকল কিছু দান করে দিতে চাইলেন, তখন নবী করিম ﷺ মানা করলেন। বললেন, ৩ ভাগের ১ ভাগ দান করতে পার। আর ৩ ভাগের ১ ভাগও অনেক বেশি। "হে সা'দ! তুমি এতটুকু পরিমাণ সম্পদ রেখে যাও, যেন তোমার মৃত্যুর পর তোমার সন্তানেরা মানুষের কাছে গিয়ে হাত পাততে না হয়!"
তাবিই হজরত আবু বকর ইবনু আবি মারইয়াম রাহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সাহাবি হজরত মিকদাম ইবনে মা'দি কারিব রা.র (নিকট অনেক পশু ছিল) একজন দাসী ছিল, যে তাঁর জন্য দুধ বিক্রি করত। মিকদাম রা. সেই মূল্য নিজের কাছে নিয়ে নিতেন। (অর্থ্যাৎ দুধ বিক্রির টাকা মিকদাম রাঃ নিজের কাছে নিয়ে নিতেন)! অতঃপর (সমাজের মানুষ এই বিষয়টিকে খারাপ চোখে দেখতে লাগল) তাঁকে বলা হল, সুবহানাল্লাহ! সেই দাসীটি দুধ বিক্রি করে আর আপনি তার মূল্য জব্দ করে নেন? (অর্থ্যাৎ হয়ত আপনি দুধ বিক্রি করা বন্ধ করে সমাজের মানুষের মাঝে ফ্রিতে তা বন্টন করে দিন, আর না হয় দুধ বিক্রি করা সেই টাকা আপনার দাসীকে দান করে দিন)!
মিকদাম রা. বললেন, হ্যাঁ, এতে কোন সমস্যাই নেই। আমি রাসুলুল্লাহ ﷺকে বলতে শুনেছি, "মানুষের জন্য এমন একটা সময় আসবে যখন দিনার ও দিরহাম (অর্থ্যাৎ অর্থ টাকা পয়সা) ছাড়া আর কোনকিছুই তার জন্য কাজে আসবে না।"
(মুসনাদ আহমদ ইবনে হাম্বল, হাদিস নং- ১৬৯৩৮)
হজরত ওসমাম জুন্নুরাইন রা., হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রা., সা'দ ইবনে আবি ওয়াকাস রা. সহ আরো অনেক সাহাবাই অনেক ধনী ছিলেন। ধনবান হওয়া তাঁদের তাকওয়ার কোন ক্ষতি করতে পারে নাই। কারণ সম্পদ তাঁদের হাতে ছিল, তাঁদের অন্তরে প্রবেশ করে নাই। যখনই ইসলামের জন্য দান করার প্রয়োজন পড়েছে তখন তাঁরা অকাতরে দান করেছেন। বেশি বেশি দান খয়রাত করতেন বলে হজরত ওসমান রা. কে সবাই গনি বলে ডাকতে শুরু করেন। অধিক টাকার জন্য নয় বরং মনের ধনে ধনী ছিলেন বলে হজরত ওসমান জুন্নুরাইন রা. কে গনী ডাকা হত। টাকাপয়সার মায়া উনার অন্তরে প্রবেশ করতে পারে নাই। অন্তরে থাকা উচিত কেবল আল্লাহ পাক ও তাঁর হাবিবের জন্য, দ্বীনের জন্য ভালোবাসা, মুসলিম মিল্লাতের জন্য ভালোবাসা।
সেজন্য দোয়া শিখিয়ে দেয়া হয়েছে, তোমরা বল, "আল্লাহুম্মাজয়া'লিদ দুনইয়া ফি ইয়াদি ওয়া লা তাজয়া'লিদ দুনইয়া ফি কালবি"! হে আল্লাহ দুনিয়াকে আমাদের হাতে রাখুন, দুনিয়া যেন আমাদের অন্তরে প্রবেশ না করে৷
হালালপথে টাকা উপার্জনের জন্য পরিশ্রম করা, ভাগদৌড় করা, ঘাম ছুটানোকে ইসলামে উৎসাহীত করা হয়েছে।
“একবার এক ব্যক্তি নবীজীর ﷺপাশ দিয়ে হেঁটে গেলেন। সাহাবায়ে কেরাম দেখলেন জীবিকা অর্জনে সে ব্যক্তি খুবই তৎপর ও মনোযোগী। তখন উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম (ওই ব্যক্তিকে ইঙ্গিত করে) নবীজীর সামনে আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! যদি ওই ব্যক্তির এই দৌড়ঝাঁপ ও মনোযোগ আল্লাহর পথে নিবেদিত হতো তাহলে কত উত্তম হতো! তখন নবীজী এরশাদ করলেন, যদি সে নিজের সন্তান-সন্তুতির লালন-পালনের জন্য এই দৌড়ঝাঁপ করে থাকে তাহলে সেটাই আল্লাহর পথে দৌড়ঝাঁপের মধ্যে গণ্য হয়ে যাবে। আর যদি সে নিজের জন্য চেষ্টা-শ্রম ব্যয় করে থাকে আর তার উদ্দেশ্য থাকে মানুষের সামনে নিজের হাত পাতা থেকে বেঁচে থাকা তাহলে এই চেষ্টাও আল্লাহর পথের চেষ্টা হিসেবে গণ্য হবে।”
- আল মুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৪২২৬; আল মুজামুল কাবীর, তবারানী, ১৯/১২৯
কাজেই কেউ যদি বৈধ পথে বড় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা হতে চান, হোন। যদি কেউ বিলিওনেয়ার হতে চান, চেষ্টা করুন। নতুন নতুন ব্যবসার আইডিয়া ডেভলপ করুন, উদ্যোক্তা হোন। হালালভাবে কর্পোরেট জব করুন। ধনী হোন, জাকাত দিন। গরীব- মিসকিন, ইয়াতিম -অসহায়দের জন্য খরচ করুন। নবীর উম্মতের কল্যাণে খরচ করুন। নিজের গরীব আত্মীয় -স্বজনদেরকে সাহায্য করুন। নিজের জন্য ও নিজের পরিবারের জন্য খরচ করুন। কারণ প্রিয় রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, "আল্লাহ পাক ভালোবাসেন তাঁর বান্দার মাঝে তাঁর দেয়া নিয়ামতের প্রতিফলন দেখতে।" নিজের জন্য ও পরিবারের সদস্যদের জন্য ভালো ভালো কাজে বেশি বেশি খরচ করাও (হারাম কাজে না হলে, অপচয় না হলে) নাজায়েজ কিছু নয়।
কৃতঃ সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া আজহারী

পঠিত : ২৫৬ বার

মন্তব্য: ০