Alapon

পাকিস্তানিদের বর্বরতা বনাম ইংরেজদের বর্বরতা


আমরা পাকিস্তানিদের বর্বরতার ইতিহাস পড়ি। অশ্রু ফেলি। তাদের ঘৃণা করি। অথচ ওদের চেয়েও লম্বা সময় ধরে ইংরেজরা আমাদের অনেকগুণ বেশি অত্যাচার করেছে। দুর্ভিক্ষ দিয়ে, নীল চাষ করিয়ে, বন্দুক দিয়ে— আমাদের হত্যা করেছে। আমাদের ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতিতে এক গোলামীর শেকল পরিয়েছে। সে গোলামীর শেকল থেকে স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও আমরা মুক্ত হতে পারি নি। আজো বাংলার ঘরে ঘরে যতোটা না গুরুত্ব দিয়ে বাংলা শেখানো হয়, তারচে' গুরুত্ব দিয়ে ইংরেজি শেখানো হয়।

আমরা ইংরেজদের ঘৃণা করি না কেন? ওদের দেশকে বর্জন করি না কেন? কারণ, ওরা আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত। পাকিস্তানের মতো যুদ্ধ-বিদ্ধস্ত না। পাকিস্তান উন্নত হলে হয়তো আমরা তখন নিজেদের খাতিরেই চেতনাটাকে একপাশে রাখতাম। আজ যেমন লন্ডন, বার্মিংহামের জন্য লালা ফেলি, ভিসার জন্য দৌড়াই— তখন হয়তো লাহোর, করাচির জন্যেও একই কাজ করতাম। ছোটবেলায় সুর করে এ, বি, সি, ডি— না শিখে আলিফ, বে, পে, তে— শিখতাম।

পাকিস্তানিরা বর্বরতা নিশ্চয়ই করেছে। আমাদের ৫২ দিয়েছে, ৬৬ দিয়েছে, ৬৯ দিয়েছে, দিয়েছে ৭১। আর ইংরেজরা? ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, তিতুমীরের আন্দোলন, নীল বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ— এমন শতশত আন্দোলন জন্ম নিয়েছে তাদের দুইশো বছরের শোষণের ইতিহাসে। তিতুমীর, মঙ্গলপাণ্ডে, টিপু সুলতান, ভগৎ সিং, আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ— সহ আরো কতো মানুষের রক্ত-ঘাম মিশে আছে এ স্বাধীনতায়।

শুধু ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের কথাই ধরা যাক। এটাকে ‘বিদ্রোহ’ বলছি, কারণ এটা ‘বিদ্রোহ’ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবী হিসেবে সুপরিচিত সলিমুল্লাহ খান একটা বই লিখেছেন ‘স্বাধীনতা ব্যবসায়’ — নামে। তিনি এ বইয়ের ১৭নং অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন ‘১৮৫৭ সালের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ’। ১৮নং অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন ‘প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ১৫০ বছর’। অর্থাৎ, তিনি ১৮৫৭ সালের সংগ্রামকে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবে দেখেছেন। যদিও আমাদেরকে ছোট থেকেই তার উল্টোটা শেখানো হয়েছে। আমাদের বলা হয়েছে, বন্দুকের টোটায় শুকর ও গরুর মাংসের চর্বি থাকা নিয়ে গুজব উঠায় এ বিদ্রোহ হয়েছিলো। অথচ, হিন্দু ও মুসলিম সৈন্যরা কিন্তু সেই টোটা ব্যবহার করেই যুদ্ধ করেছিলো। সেটাতে তাদের সমস্যা হয় নি।

মজার ব্যাপার, আমাদের ইতিহাস শুরুই হয় বায়ান্ন থেকে। যারা একটু উদার(!), তারা শুরু করেন ‘বঙ্গভঙ্গ’ থেকে। অথচ এ যুদ্ধে আমাদের বাঙ্গালিদের গৌরবময় ইতিহাস আছে। আমার জেনে খুব ভালো লেগেছিলো, বেঙ্গল আর্মি থেকে নব্বই হাজার সৈন্য সরাসরি এই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। বেঙ্গল আর্মির ছাউনি সেই মিরাট থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিলো। সব মিলিয়ে প্রায় দেড় লাখ সৈন্য এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো। সাথে সাধারণ মানুষের সংখ্যাও ছিলো অনেক। তবুও এই যুদ্ধ ব্যর্থ হয়েছিলো কেন?

কারণ, সৈন্যদের একটা অংশ যুদ্ধে অংশ নেয় নি। শুধু নেয়নি এমন না, ইংরেজদের সাহায্যও করেছিলো। পাঞ্জাবের শিখরা, নেপালের গোরখা সৈন্যরা এই যুদ্ধে মুক্তিকামী সৈন্যদের সবচে’ বেশি ক্ষতি করেছিলো। যাদের নেতৃত্বে আমরা ১৯৪৭ সালের তথাকথিত আজাদি পেয়েছি, তারাও ১৮৫৭ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো। আর ইংরেজরা খুব বর্বরতার সাথে এই যুদ্ধের মোকাবেলা করেছিলো। তারা অসংখ্য নারীদের ধর্ষণ করেছিলো।

যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো কিংবা যুদ্ধে যাদের পরোক্ষ সমর্থন ছিলো, তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিলো। রুদ্রাংশু মুখার্জী তার ‘Spectre of Violence’— বইতে এ বর্বরতার বর্ণনা দিয়েছেন। কীভাবে ইরেজরা বিদ্রোহীদের কূপে ফেলে, কামানে শরীর ঢুকিয়ে, গরম লোহা দিয়ে পুড়িয়ে, চোখে ও গোপনাঙ্গে মরিচ ছিটিয়ে হত্যা করেছিলো। সায়্যিদ হুসাইন আহমেদ মাদানিও তার বইতে ইংরেজদের এসব অত্যাচার নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। বইটা বাংলায় অনুবাদ হয়েছে ‘রেশমি রুমাল আন্দোলন’ নামে।

এ যুদ্ধে কয়জন মানুষ মারা গিয়েছিলো? আমরা সঠিক সংখ্যাটা জানি না। কোনোদিন জানবও না। কারণ ইংরেজরা এই যুদ্ধের কোনো ইতিহাসই লিখতে দিতো না। এ ব্যাপারে তারা কড়া নজর রাখত। তাই একেকজন একেক সংখ্যা বলেন। কেউ বলেন, সাত লাখ। কেউ দশ লাখ। অমরেশ মিশ্র তার বই ‘In War of Civilisations’— এ দাবি করেছেন, প্রায় এক কোটি মানুষ এই যুদ্ধের কারণে বা এর প্রভাবে মারা গিয়েছিলো। তিনি এর নাম দিয়েছেন ‘untold holocaust’। এটা বিশাল একটা সংখ্যা! কারণ, তখন পুরো ভারতবর্ষের জনসংখ্যা ছিলো মাত্র ১৭ কোটি!

মানুষের জান-মালের এতো ক্ষতি হয়েছিল যে, চেনা শহরও হয়ে গিয়েছিল অচেনা। শুধু দিল্লীতেই পাঁচশ আলেমকে হত্যা করা হয়েছিলো বিদ্রোহে সংশ্লিষ্টতার কারণে। দিল্লীতে এতো মুসলিম মারা গিয়েছিলো যে উইলিয়াম ড্যালরিম্পল তার বিখ্যাত বই ‘The Last Mughal’— এ বলেছেন, এ বিদ্রোহের কারণে মুসলিমপ্রধান শহর দিল্লী, হিন্দুপ্রধান শহরে পরিণত হয়েছিলো।

উর্দু ভাষার কিংবদন্তি কবি মির্জা গালিব ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের তাণ্ডবে এতোটা দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন যে প্রিয় শহর দিল্লীকেই আর চিনতে পারছিলেন না। এক বন্ধুকে লেখা চিঠিতে তিনি ইংরেজদের বর্বরতার কথা এভাবে লিখেছিলেন-

ایک عزیز کا ماتم کتنا سخت ہوتا ہے
جو اتنے عزیزوں کا ماتم دار ہو
اس کو زیست کیوں نہ دشوار ہو
ہائے اتنے یار مرے کہ جواب میں مروں گا
تو میرا کوئی رونے والا بھی نہ ہوگا

“একটা মৃত্যুই তো কতো ভারী মনে হয়।
যে হারিয়েছে এতো এতো কাছের মানুষকে-
তার বেঁচে থাকাটা কীভাবে কষ্টের না রয়?
হায়! আমি এতো এতো হারিয়েছি স্বজন
যখন আমি মারা যাব-
কেউ নেই যে করবে আমার জন্যে ক্রন্দন।”

~ইবনে শফি

পঠিত : ৪৪৭ বার

মন্তব্য: ০